wood light dawn landscape

ভালো থেকো সুন্দরবন

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

পৃথিবীতে কে বেশী শক্তিশালী? প্রাকৃতিক শক্তি নাকি মানুষের লোভ? একটা সময় মানুষ প্রকৃতির কাছে ধরাশায়ী হত। আর আজ মানুষ রাজত্ব করছে প্রকৃতির ওপর। আজ প্রাকৃতিক শক্তি দুর্বল, প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছে মানুষের কাছে। কিন্তু মানুষ জানে না, প্রকৃতিকে জিতিয়ে দেয়া উচিত তার নিজেরই প্রয়োজনে। নিজের তাগিদেই তাঁকে সংরক্ষণ করা উচিত। মানুষ যদি তা বুঝতেই পারত, তাহলে সুন্দরবনকে প্রতিনিয়ত এভাবে মানুষের কাছে হেরে যেতে হত না। মানুষ সুন্দরবনকে বাঁচতে দেয়নি রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কালো ছোবল থেকে। আর এবার তেলের ট্যাঙ্কার ডুবিয়ে তাঁকে মেরে ফেলার চেষ্টা।

গত ৯ই ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় ডুবে গেছে সাড়ে তিন লাখ লিটার জ্বালানি তেলসহ একটি ট্যাংকার। দুর্ঘটনার পর সেই ডুবন্ত জাহাজ থেকে তেল ছড়িয়ে পড়ে। এতবড় একটি ঘটনা ঘটে গেলো। পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো নড়েচড়ে বসলো। এলাকাবাসী আতঙ্কিত হল। কিন্তু সরকারি পর্যায়ের ব্যাক্তিবর্গদের কোন প্রকার মাথাব্যাথা হল বলে মনে হল না। এই অপরিসীম ক্ষতি নিরসনে তাদের তৎক্ষণাৎ কোন পদক্ষেপ দেখা গেল না। ট্যাংকার থেকে তেল ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শক্রমে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার হলেও মংলা কর্তৃপক্ষ বা বন বিভাগের সেরকম প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

tanker-sank_104433_0

শ্যালা নদীর দুই পাশে বনটি শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বনাঞ্চল, যা সাধারণত সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় দেখা যায়। ম্যানগ্রোভ বনের উদ্ভিদগুলো সুমদ্রের জোয়ার-ভাটা পরিবেশে অভিযোজিত ও মাটির উপরে উঠে আসা মুলে লেন্টিসেল নামক এক প্রকার ক্ষুদ্র ছিদ্র থাকে, যার মাধ্যমে বায়ু থেকে অক্সিজেন সংগ্রহ করে থাকে। জোয়ার-ভাটার সময় পানির ঢেউ এর মাধ্যমে দুর্ঘটনার ফলে ছড়িয়ে পড়া তেল মাটির উপরে উঠে আসা শ্বাসমূলীয় বৃক্ষের মুলে জড়িয়ে লেন্টিসেল নামক ছিদ্র বন্ধ করে দেয়। এর ফলে এগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সূর্য রশ্মি পানির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে পারবে না, ফলে ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন নামক ক্ষুদ্র জলজ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাঁধাগ্রস্ত হবে। জুয়োপ্ল্যাঙ্কটন হলো ছোট মাছের প্রধান খাদ্য। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটনের অভাবে জুয়োপ্ল্যাঙ্কটনের পরিমাণ কমে যাবে; জুয়োপ্ল্যাঙ্কটনের অভাবে ছোট মাছের সংখ্যা কমে যাবে; ছোট মাছের অভাবে ঐ এলাকার বড় মাছ ও ডলফিনের খাদ্য সংকট দেখা দেবে। অর্থাৎ, খাদ্য শৃঙ্খল ভেঙে পড়বে। নদী ও নদীর দুই পাশে বসবাসকারী প্রাণী সম্পদ, যেমন: মাছ, ছোট মাছের প্রধান খাদ্য প্ল্যাঙ্কটন, মাছের উপর নির্ভরশীল পাখী, ভোঁদড় ইত্যাদি প্রাণীর উপর ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।

সুন্দরবন এলাকার মানুষের অন্যতম প্রধান জীবিকা হলো বন হতে মধু সংগ্রহ ও নদী থেকে মৎস্য সম্পদ আহরণ। দুর্ঘটনার ফলে নদীর পানিতে ছড়িয়ে পড়া তেলের কারণে ঐ এলাকার নদী ও বনের বাস্তুসংস্থানের ব্যাপক ক্ষতি হবে যার সরাসরি প্রভাব পরবে মৎস্য ও বনজ সম্পদের উপর অর্থনৈতিক ভাবে নির্ভরশীল মানুষের উপর।

অতিরিক্ত পরিমাণে তেলের বাষ্পের-স্পর্শে আসলে মানুষের বমি-বমি ভাব, অতিরিক্ত রক্ত চাপ, চোখ জ্বালা, মাথা ব্যথা, ও মাথা ঘোরা দেখা যেতে পারে। রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি পদ্মা বলেছে, তারা সংগৃহীত তেল কিনে নেবেন সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। টাকার লোভে পড়ে বয়স্ক ও যুবক মানুষ বিশেষ করে যারা হাঁপানি ও পরিপাক তন্ত্রের সমস্যায় ভুগিতেছেন তারা যদি তেল সংগ্রহের নেমে পড়েন ও বেশি সময় ধরে তেলের বাষ্পের-স্পর্শে আসেন তবে তাদের ঐ সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে।

141215110717_bangla_sundarbans_oil_spills_pollution_640x360_afp_nocredit

সুন্দরবনে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন) গবেষণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বন বিভাগও আলাদাভাবে রিপোর্ট তৈরি করছে। শ্যালা নদী ও আশপাশের তেল ছড়িয়ে পড়া অঞ্চলে ৩১ থেকে ৪৩ ধরনের মাছ পাওয়া যেত। তেল ছড়ানোর পর এ অঞ্চলের ওপর গবেষণায় পাওয়া গেছে ১০ থেকে ১৪ ধরনের মাছ। মাছরাঙা, বকসহ ৫৭ ধরনের পাখি তেল ছড়িয়ে পড়ার আগে এ অঞ্চলে দেখা যেত। এখন কোনো মাছরাঙা দেখতে পাননি গবেষকরা। শীতে এ অঞ্চলে পরিযায়ী বা অতিথি পাখির ঢল নামে। তবে তেল ছড়িয়ে পড়ার পর কোনো পরিযায়ী পাখি দেখা যায়নি। সুন্দরবন অঞ্চলে তিন প্রজাতির গুইসাপ রয়েছে। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২১ থেকে ২৭টি গুইসাপ দেখা গেলেও তেল ছড়িয়ে পড়া অঞ্চলে দুটি গুইসাপ দেখা গেছে। সেগুলোর গায়ে আবার তেলের প্রলেপ রয়েছে। আর একটি গুইসাপ পাওয়া গেছে মৃত। সুন্দরবন এলাকায় চার প্রজাতির কাঁকড়া দেখা যায়। প্রতি বর্গকিলোমিটারে সুন্দরবনের স্বাভাবিক স্থানে কাঁকড়া দেখা যায় তিন থেকে সাতটি। তবে গবেষণা এলাকায় কোনো জীবিত কাঁকড়া দেখা যায়নি। অসংখ্য মরা কাঁকড়া দেখা গেছে। কাঁকড়া হলো পাখি ও কুমিরের খাদ্য। গবেষণার সময় তেল গায়ে লাগানো মাত্র দুটি কুমির দেখা গেছে। অথচ স্বাভাবিক অবস্থায় এ স্থানের প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় তিন থেকে ছয়টি কুমির দেখা যায়।

বাংলাদেশ-ভারত নৌ প্রটোকলভুক্ত ও বাংলাদেশ-ভারত ট্রানজিট পথের প্রধান অংশ মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথটি চরম নাব্যতা সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বিকল্প হিসেবে ২০১১ সালের মে মাস থেকে সুন্দরবনের শ্যালা নদীর রুটটি চালু করা হয়। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও প্রাণিজ সম্পদ রক্ষার জন্য বন বিভাগসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন এ পথটি বন্ধ করে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌপথটি চালুর কথা বলে আসছিল। কিন্তু তার আগেই এই বিপর্যয় ঘটে গেল। উপরন্তু, ২৬ দিন পর সুন্দরবনের শ্যালা নদী দিয়ে আবারও নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে। এদিন চার শতাধিক নৌযান বনের ভেতর দিয়ে মংলা বন্দরে যায়। তবে তেলবাহী কোনো কার্গো এ পথ দিয়ে আর চলাচল করতে পারবে না।

এতো কিছুর পরও আশার কথা হচ্ছে, সুন্দরবন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে স্বরূপে। যে আমাদের সকল ঝড়-ঝঞ্ঝা থেকে আগলে রাখে, সেতো নিজেকেও আগলে রাখতে পারবে, শুধু প্রয়োজন আমাদের একটু সহযোগীতা। সুন্দরবন, এ পৃথিবীর বুকে তুমি চিরদিন বেঁচে থাকো আপন মহিমায়।
তথ্যসূত্রঃ

১. ঃজাতিসংঘ দলের সঙ্গে সুন্দরবনে” দৈনিক প্রথম আলো, ৪ জানুয়ারি, ২০১৫

২. “হুমকিতে সুন্দরবনের প্রাণ ও পরিবেশ”, দৈনিক সমকাল, ০৯ জানুয়ারি ২০১৫

৩. “তেলের গ্রাসে সুন্দরবন”, দৈনিক প্রথম আলো, ১০ ডিসেম্বর ২০১৪

৪. সুন্দরবনে তেলের ট্যাঙ্কারডুবি, পরিবেশের উপর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া ও করণীয় ,  “মোস্তফা কামাল পলাশ”  -http://www.priyo.com/blog/2014/12/13/123140.html#sthash.rxlsrxd8.dpuf

৫. ৫. “তেলে জলে মেশে না !”, “মোহাম্মদ আরজু”, https://www.banglatribune.com/%E0%A6%A4%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%9C%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE

 







বিজ্ঞান নিউজলেটার

যুক্ত হোন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞান নিউজলেটারে!
আমরা সাপ্তাহিক ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। 
এ নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। থাকবে নতুন লেখার খবরও।


Loading

লেখাটি 182-বার পড়া হয়েছে।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য লেখা

  • ডাইনোসর বিলুপ্ত না হলে কেমন হতো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

    ডাইনোসর বিলুপ্ত না হলে কেমন হতো পৃথিবীর ভবিষ্যৎ

  • মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ  অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

    মুরগির মাংসে শনাক্ত ইশেরিশিয়া আলবার্টিঃ অজান্তেই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধের ঝুঁকি

  • আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

    আদতেই কি ফিরে এসেছে ডায়ার নেকড়ে?

  • ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

    ভুল নিদানে সন্তান হত্যার দায়ঃ একটি করুণ কেস স্টাডি

  • কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

    কমোডো ড্রাগন: উপকথার ড্রাগনদের পৃথিবীতে বিচরণ!

  • মহাবিশ্বের জ্যামিতি ও অন্তিম পরিণতি

    মহাবিশ্বের জ্যামিতি ও অন্তিম পরিণতি


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Response

  1. বিষয়টা দুঃখজনক হলেও এই মুহূর্তে সুন্দরবন মৃত একটা ইস্যু। কারো যেন কোন মাথাব্যাথা নেই। কারো যেন কোন দায়িত্ব নেই। ধন্যবাদ তোমাকে এ বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য।

Leave a Reply