আলোর স্রোতে পাল তুলেছে হাজার প্রজাপতি ।
আলোর ঢেউয়ে উঠল নেচে মল্লিকা মালতী ।
তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গের ছোট একটি অংশ হল দৃশ্যমান আলো। তার শ্রোতেই হাজার প্রজাপতিরা ডানা মেলে, তার ঢেউয়েই মল্লিকা মালতীরা রং ছড়ায়। তার প্রবাহেই চোখদুটো ডুবিয়ে আমরা দিন যাপন করি। দেখি। দেখে মুগ্ধ হই, দেখে শান্ত হই, দেখে রেগে যাই, দেখে ভীত হই। যদিও এই অনুভূতিগুলোর সাথে দেহ ও মগজের বহু রসায়ন জড়িত। তবে, চোখ এবং আলোর অবদান কিন্তু ফেলনা নয়। কিছু কিছু প্রাণী এবং পোকামাকড় নাকি অবলাল(সাপ) কিংবা অতি বেগুনী(প্রজাপতি) ব্যাপ্তি পর্যন্ত দেখতে পায়। এই পরিসর মানুষের চোখের জন্য অদৃশ্য। কেমন হত যদি আমরাও দেখতে পেতাম? তবে কি আমাদের মুগ্ধতা সহ অন্যান্য অনুভূতিগুলো অন্যরকম হতো? যন্ত্রের মাধ্যমে ধারন করা মহাকাশের অবলাল কিংবা অতিবেগুনী ছবিগুলো দেখে যে হা করে থাকি। তা কি খালি চোখেই দেখতে পেতাম?
যাই হোক, দৃশ্যমান আলোর কথা যদি বাদও দেই- আমাদের আধুনিক জীবন কিন্তু দেখা ছাড়াও নানান ভাবে আলোর প্রতি নির্ভরশীল। উচ্চগতির ইন্টারনেট ফাইবার-অপটিক ছাড়া ভাবাই যায়না। লেজারের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার টেরাবাইট তথ্য ডিস্কে লেখা হচ্ছে। অবলাল থেকে অতিবেগুনি ব্যাপ্তির সেন্সরযুক্ত টেলিস্কোপ মহাকাশ এবং মহাবিশ্বকে জানতে সাহায্য করছে। ভু-উপগ্রহের রিমোট সেন্সিং আমাদের পৃথিবী, আবহাওয়া, পরিবেশ দূষন এসব বিষয়ে তথ্য সংগ্রহে কাজে লাগছে। এত দূরের কথা যদি না ভাবি, তবে মেডিকেল ইমেজারি চিকিৎসাবিজ্ঞানকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। এখন অনেক ক্ষেত্রেই দেহের অভ্যন্তরের অংগের ত্রিমাত্রিক ছবি ধারন করে তা দেখে রোগ নির্নয় করা হচ্ছে, কোন রকম কাটা ছেড়া ছাড়াই। আলো ভিত্তিক থেরাপী ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যাবহৃত হচ্ছে, যা বেছে বেছে আক্রান্ত কোষগুলোকেই প্রভাবিত করে।
বর্তমান প্রযুক্তিগুলোর ব্যাবহারিক প্রয়োগ বদলে দিতে পারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুন্নত অঞ্চলের মানুষের জীবন, যেসব জায়গায় এখনো মানুষ বিদ্যুতের সুবিধা বঞ্চিত। শুধু আঁধারে আলোর ব্যাবস্থা সাহায্য করতে পারে একটা পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে বের হয়ে আসতেঃ যার সন্তানেরা দীর্ঘ সময় পড়াশোনার সুযোগ পাবে, বাবা-মা দিনের পরেও চাইলে উৎপাদনশীল কাজে যুক্ত হতে পারবেন। সাব-সাহারান আফ্রিকার ৬৫ শতাংশ জনসংখ্যার বিদ্যুৎ সুবিধা নেই, তবে তাদের সূর্যালোকের যোগান ব্যাপক। সোলার ল্যাম্প(যা দিনের বেলা সূর্যের আলোতে চার্জ হয়) হতে পারে এই অঞ্চলের জন্য একটি ভালো সমাধান। কেননা বহুল ব্যাবহৃত কেরোসিন একে তো ব্যায়বহুল, বিষাক্ত ধোঁয়া সৃষ্টিকারি আবার তার আলো পড়ালেখা করার উজ্জ্বল নয়। সামান্য বড় আকারের সোলার প্যানেলের মাধ্যমে এসব অঞ্চলে কমিউনিটি রেফ্রিজারেটর, সেল ফোন চার্জার ইত্যাদি যন্ত্রের ব্যাবহার জীবনযাত্রার মান উন্নত করে পারে।
সালোকসংশ্লেষনের কথা না বললেই নয়। এই প্রকৃয়ায় কার্বনডাই অক্সাইড এবং পানি থেকে শর্করা ও অক্সিজেন তৈরি হয়। যা আমাদের জ্বালানী ও অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়। এজন্যে আলো কিন্তু অপরিহার্য। এখন বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষন ব্যাবস্থা তৈরি করতে, যা সূর্যের আলোকে দক্ষভাবে কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। একশ বছর আগেও আমরা ভাবতে পারতামনা আলো আমাদের কত দূর নিতে পারে, এর বৈশিষ্ট্যগুলো কাজে লাগিয়ে কত বিচিত্র প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব। বিংশ শতক যেমন ইলেক্ট্রনিক্সের প্রতি নির্ভরশীল ছিলো, একুশ শতকে তেমনি হবে ফোটোনিক্সের জয়জয়কার। ফোটোনিক্স, ফোটোন কণা নিয়ন্ত্রনের বিজ্ঞানের ওপর দাড়িয়ে আছে আমাদের দৈনন্দিন নানা প্রযুক্তি যেমনঃ স্মার্টফোন, ইন্টারনেট কিংবা মেডিকেল যন্ত্রাংশ। ১০১৫ সালে প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক ইবনে আল হায়থামের(Ibn Al-Haytham)কিতাব আল-মানাযির(Book of Optics) থেকে শুরু করে বিংশ শতকের শুরুতে আইনস্টাইনের গবেষনা, কয়েকশ বছরের আলো বিষয়ে অর্জিত জ্ঞান থেকে এই প্রযুক্তিগুলোর বিকাশ ঘটেছে।
আজ থেকে ১০০০ বছর আগে ইবনে আল হায়থাম কিতাব আল-মানাযির প্রকাশ করেন। ২০০ বছর আগে অগাস্টিন জাঁ-ফ্রেসনেল(Augustin-Jean Fresnel) আলোর তরংগ তত্ব প্রদান করেন। ১৫০ বছর আগে জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের(James Clerk Maxwell) কাছ থেকে পাই আলোর তড়িৎচৌম্বক তত্ব। ১০০ বছর আগে ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন তার আপেক্ষিকতার সাধারন তত্বের মাধ্যমে স্থান ও কালের ধারনায় আলোর কেন্দ্রীয়তা নিশ্চিত করেন। সর্বশেষ ৫০ বছর আগে আর্নো পেনজিয়া(Arno Penzias) ও রবার্ট উড্রো উইলসন(Robert Woodrow Wilson) আবিষ্কার করেন কসমিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড(Cosmic Microwave Background) বিকিরন।
ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ন মাইলফলকগুলো স্মরন করে, দৈনন্দিন জীবনে আলো এবং আলো নির্ভর প্রযুক্তির ব্যাবহার, সমৃদ্ধ ভবিষ্যত গঠন ও সমাজের যুৎসই উন্নয়নে এদের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি আলোকপাত করার লক্ষ্যে ২০১৫ সালকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিকভাবে আলো ও আলোকভিত্তিক প্রযুক্তির বছর ঘোষনা করেছে।
Leave a Reply