কাউকে কতটা বিশ্বাস করা উচিত কিংবা কারো সম্পর্কে জানতে হলে অন্যের কথা না শুনে এমন সমস্যার সম্মুখীন আমরা প্রায়ই হয়ে থাকি। কিন্তু এই সব সমস্যার সমাধান যদি ঐ ব্যক্তির মুখই করে দেয় তাহলে ব্যপারটা কেমন হয়?
আমাদের ব্যক্তিত্ব, সুস্বাস্থ্য, যৌনতা প্রভৃতির বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের চেহারার মাধ্যমে ফুটে উঠে। আমরা আমাদের গূঢ় রহস্যময় মনের কথা বুঝতে পারে এমন কাউকে পেতে হলে হয়ত কোনো মহান দার্শনিকের উপস্থিতিই আশা করবো। ডেভিড রবসন তাঁর সমীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন এই বিষয়টির উপর। কিন্তু গ্রিক চিন্তাবিদেরা এই কাজ দার্শনিকদের উপরই কেবল ছেড়ে দেন নি। এরিস্টটল এবং তাঁর অনুসারীরা চেহারার মাধ্যমে অন্য আরেক জনের মনের ভাব সাব বুঝে উঠার জন্য ও তা আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করার জন্য একের পর এক ভলিউম লিখে গিয়েছেন।
এখন আপনি ও আমিও শিখে নেই সে জাদু মন্ত্র।
মুখাবয়ব ও ব্যক্তিত্ব
“ নরম চুল ধারী কাপুরুষত্ব আর শক্ত, ঘন চুল সাহসিকতার পরিচয় বহন করে। অন্যদিকে, উজ্জ্বল বিস্তৃত নয়নধারী যাদের আবার নেত্রপল্লব অপেক্ষাকৃত একটু ভারি তারা সম্মান প্রদর্শনে কৃপনতা প্রকাশ করে। আর খানিকটা বিস্তৃত নাক অলসতার চিহ্ন বহন করে”, তাদের সমীক্ষায় এই সব তথ্য উঠে আসে।
প্রাচীন গ্রিকদের মতে, বিস্তৃত নাকধারী লোকেরা অলস হয়।
এবার আসা যাক ঠোঁটে। বড় এবং চর্বিময় ঠোঁট অন্ধবিশ্বাসী, নির্বোধ লোকের পরিচয় বহন করে।
কোনো বইকে কেবল তার প্রচ্ছদ দেখে বিবেচনা করা যায় না, এ শিক্ষাটাই এ খান থেকে পাওয়া যায়। যদিও কারো বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখেই তার সম্পর্কে সব বুঝে নেওয়া উচিত না, তবুও মনোবিজ্ঞানীরা আমাদের ভিতরের গূঢ় ব্যক্তিত্বের দিকগুলোকে আমাদেরই মুখা্বয়বের মাধ্যমে বুঝে উঠার চেষ্ঠা করছেন। এতে করে আপনি যতই শক্ত, বিরক্তির ভাব আপনার চেহারায় ধরে রাখুন না কেন আপনার মুখের গঠন বৈশিষ্ট্যই আপনার আসল ব্যক্তিত্ব অন্যের সামনে তুলে ধরবে।
নর্থ্রাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির কার্ম্যান লিফেভার মনে করেন, “বায়োলজি তথাপি জিন, হরমোন প্রভৃতি আমাদের বেড়ে উঠার ওপর যেমন প্রভাব ফেলে তেমনি আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করে।”
এবার মুখমণ্ডলের হাড়ের গঠনের উপর লক্ষ্য করা যাক। আপনারটা কি আকারে খুব ছোট বা প্রশস্ত নাকি হালকা?
লিফেভারের মতে, যে সকল মানুষের মাঝে টেস্টেসটেরনের পরিমাণ বেশি তাদের মুখমণ্ডল অপেক্ষাকৃত বড় চোয়ালের হাড় নিয়ে বিস্তৃত হয়ে থাকে, যা কিনা তাদের জেদি ব্যক্তিত্বধারী বলে ঘোষনা দেয়।
এই সব তথ্য কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে মিলিয়ে দেখা যেতে পারে। লিফেভার বেশ কয়েক স্বেচ্ছাসেবকের সহায়তায় অ্যামেরিকার পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রীদের মুখমণ্ডলের গঠন বৈশিষ্ট্য নিয়ে এক পরীক্ষা করেন। তিনি সেখানে দেখতে পেলেন যে ঐ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মুখাবয়ব তাদের কাজের লক্ষ্য ও মানকে প্রতিফলিত করে। জন এফ কেনেডির মুখমণ্ডল, ১৯ শতকের লেখক চেস্টার অপেক্ষা কিছুটা ভারি গোছের ছিল। তাঁদের মত এমন ঐতিহাসিক ব্যক্তিদের নিয়ে এ ধরনের গবেষণা অনেকের কাছেই ভালো করে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তবে এসব ছাড়াও সহযোগিতা পূর্ণ মনোভাব এবং বুদ্ধিমত্তাও একই ভাবে সফলতার জন্য জরুরী।
সুস্বাস্থ্যের বার্তা যখন আপনার কপোল বহন করে
আপনি এখন হয়ত আশা করে থাকবেন যেনো, আপনার স্বাস্থ্যের খবরাখবরও যদি আপনার মুখাবয়ব বলে দিত!
আপনার মুখাবয়বের উপর অতিরিক্ত চর্বি আপনার ওজন সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, পাতলা চেহারাধারী মানুষেরা অপেক্ষাকৃত কম জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় ফলশ্রুতিতে, তাদের অসুখ বিসুখও কম হয়। তাদের হতাশা হওয়ার হারও অপেক্ষাকৃত কম। আর এ কথা হয়ত আমরা সবাই জানি যে, মানসিক সুস্থতা আমাদের দৈহিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলে।
আপনার কপোল অর্থাৎ গাল কিভাবেই বা আপনার সম্পর্কে বলে দেয়?
ইউনিভার্সিটি অফ গ্লাসগোর বেনেডিক্ট জন্স মনে করেন যে, আমাদের দেহে চর্বির উপস্থিতির এক নতুন ব্যাখ্যা হয়ত উপরোক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। তার মতে, “আপনি কতখানি মোটা তা দিয়ে আপনার সুস্থতা নির্দেশিত হয় না, বরং আপনার চর্বি কোথায় আছে তাই দেখার বিষয়।” যাদের ট্রাঙ্ক (হাত, পা, মাথা ব্যতীত শরীরের অন্যান্য অংশ)স্লিম মানে অতিরিক্ত চর্বি যুক্ত নয় কিন্তু হিপস খানিকটা মোটা তারা তুলনামূলকভাবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়ে থাকে। অন্যদিকে যাদের ট্রাঙ্কের মধ্যবর্তী অংশ তুলনামূলক মোটা তাদের বুকের দিকে অবস্থিত এডিপোজ টিস্যুগুলো(এক ধরণের ফ্যাটি টিস্যু) এমন কিছু অণু নিঃসৃত করে যা কিনা আমাদের দেহের প্রধান প্রধান অঙ্গ গুলোকে ক্ষতি করে ফেলতে পারে। তাছাড়া আমাদের দেহের জমে থাকা চর্বি অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মুখমণ্ডলের বিপদজনক কিছু এলাকা দিয়ে প্রতিফলিত হতে পারে। কিংবা আমাদের মুখমণ্ডলের চর্বিই আমাদের জন্য অনেক সময় বিপদজনক হতে পারে।
ত্বকের রঙ
এইসব বাহ্যিক দিক বাদেও আমাদের চেহারার রঙ আমাদের অনেক গোপন তথ্যই ফাঁস করে দিতে পারে। আমরা সবাই জানি যে শাক-সবজী, ফল-মূল আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো যদিও আমাদের অনেকেই তা খেতে পছন্দ করি না। কিন্তু এই ফল-মূল, শাক-সবজী কেবল সুস্বাস্থ্যই নয় মুখমণ্ডলের সুন্দর রঙও প্রদান করে। যাদের ত্বকের রঙ কিছুটা হলুদ বা সোনালী ভাব তাদেরকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী বলে চিহ্নিত করা হয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে শাক সবজীর সাথে ত্বকের রঙের কি সম্পর্ক?
“আমাদের ত্বকের রঙের জন্য দায়ী ক্যারিটিনয়েড পিগমেন্ট যা আমরা লাল ও কমলা রঙের ফল ও শাক সবজীতে পেয়ে থাকি। এই পিগমেন্ট আমাদের পরিপাক ব্যবস্থাকে উন্নত করে। আমরা যখন এই শাক সবজী খাই তখন তা আমাদের ত্বকে স্তরীভূত হয় যা কিনা ধীরে ধীরে হলুদভাব রঙ ধারণ করে। এ খান থেকেই আমরা হলুদভাব ত্বক পেয়ে থাকি, কেননা এই পিগমেন্ট গুলো এ ক্ষেত্রে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার অংশ হিসেবে কাজ করে না বরং আমাদের ত্বকের রঙ প্রদানের কাজ করে”, বলছিলেন লিফেভার। আর বলার অপেক্ষায় থাকে না যে, ত্বকের রঙ আমাদের বাহ্যিক আকর্ষণের এক অন্যতম হাতিয়ার।
আবার ত্বকের গোলাপি আভা দ্বারা বোঝায় যে, ঐ ব্যক্তি ভালোই পরিশ্রমী। কেননা এ ক্ষেত্রে তার রক্ত পরিবহণ খুব ভালো ভাবে হচ্ছে যা গোলাপি আভার জন্য দায়ী। আর মহিলাদের ক্ষেত্রে আরেকটি বৈশিষ্ট্যের অর্থাৎ তাদের ভালো উর্বরতার পূর্বাভাস দেয় এই গোলাপি আভা। রজঃচক্র চালাকালীন সময়ে মেয়েদের ত্বক অনেকটা লালচে বর্ণ ধারণ করে এস্ট্রারয়েড(একটি যৌন হরমোন) এর কারণে যা কিনা তাদের আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।
স্মার্ট দেখতে চাইলে
কেউ চশমা পড়লেই যে বুদ্ধিদীপ্ত এমন কিন্তু নয়। পনার সেলফি দেখে কিন্তু এখন আপনি আপনার সম্পর্কে ভালো ধারণা পাবেন যে আপনি কি বুদ্ধিমান নাকি নির্বোধ। যদিও কে কতটা স্মার্ট তা পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য এখনও কোনো নির্দিষ্ট উপাত্ত বের করা সম্ভব হয় নি।
কিন্তু এই ক্ষেত্রে জীবনযাত্রা, ব্যক্তিত্ব প্রভৃতি পরবর্তিত হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্যনীয়। ১৯৩০ থেকে ১৯৯০ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে, যে সব পুরুষের চেহারায় বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে তারা তরুণ বয়সে কম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকারী হলেও ধীরে ধীরে যতই বয়সের ভার বাড়তে থাকে ততই তাদের কর্তৃত্ব পূর্ণ মনোভাব বেড়ে যায়। কেননা তরুণ বয়েসে তারা তাদের নরম স্বভাবের কারণে অনেকের কাছ হতেই হয়ত রূঢ় বাস্তবতা স্বীকার হয়েছিল।
বয়েসের বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে আরো ভালো ধারণা পাওয়া যায় তার মুখ দেখেই। কিশোর কাল থেকে ৩০ বছর অবধি যে সব নারীরা তাদের ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে সবার কাছে বেশি আকর্ষনীয় ছিল, ৫০ ঊর্ধ হওয়ার পর তাদের দৈহিক সৌন্দর্য ঐ সব নারীদের থেকে ভালো যারা যৌবন অবস্থায় ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে নয় বরং চেহারার দিক দিয়ে সুন্দর ছিল।
এর কারণ হিসেবে এটা বলা যেতে পারে যে, তারা জানত যে কি করে অন্যের নিকট ভালো ব্যক্তিত্ব শালী হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে হয় আর তাদের ভিতরের এই আত্নবিশ্বাসই বৃদ্ধ বয়েসে তাদের চেহারায় উজ্জ্বলতার সৃষ্টি করে।
অন্যের সম্পর্কে বলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কেবল হাড় বা অন্য কোনো বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যনীয় নয়।
গবেষকেরা এক দল স্বেচ্ছাসেবকদের বলে তাদের সবচেয়ে পছন্দের জামা পরে নিজেদের ছবি তুলতে। পরে তাদের এই ছবি গুলো তাদেরই অন্য সাধারণ জামা পড়ে তোলা ছবির সাথে মিলিয়ে বিচার করা হয়। যেখানে দেখা যায় যে, প্রিয় জামা পড়া ছবি গুলোতে তাদের আত্নবিশ্বাসের ভাবটি ভালো করেই ফুটে উঠে।
বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য দেখে এই ভাবে কারো ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করাকে “physiognomy” বলে। জন্সের এই সব তথ্য “physiognomy” শাখাকে আরো সমৃদ্ধ করে তুলবে।
তবে এইভাবে কারো সম্পর্কে অগোচরে জেনে ফেলা অনেকের কাছেই আপত্তিকর বলে ঠেকেছিল। যে কারণে বিংশ শতাব্দীর দিকে থিওডোর কিং হেনরি (অষ্টম)এই শাখাটাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে এই বিদ্যাকে একটি মার্জিত ধারায় আনা সম্ভব হয়েছে।
আমাদের মুখমণ্ডল কেবল বায়োলজির এক প্রডাক্ট নয়। আমরা আমাদের জিন বা হরমোনে পরিবর্তন আনতে পারব না কিন্তু আমরা যদি আমাদের ব্যক্তিত্বে আত্নবিশ্বাস ও আত্ননির্ভরশীলতার দিক গুলোকে বপন করতে পারি তাহলে তা হয়ত অন্যের নিকট আমাদের মুখাবয়বের গুরুত্ব পূর্ণ ছবি তুলে ধরতে সক্ষম।
তথ্যসূত্রঃ বিবিসি ফিউচার
Leave a Reply