আমাদের সংস্কৃতির গুরুত্বটা কী আমাদের জীবনে? কিংবা বিজ্ঞানের ভাষায়, এর প্রযুক্ত বলই বা কতটুকু আমাদের উপর? কিংবা আমাদের বিবর্তনের পিছনে কি আমাদেরই সংস্কৃতি কোনো অংশে দায়ী?
কাপড়, আশ্রয় থেকে শুরু করে বহিঃশক্তির হাত থেকে রেহাই দেওয়ার জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি। কতিপয় জীববিজ্ঞানীদের নিকট তাই মনে হয় মানব সংস্কৃতি আমাদের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা কিনা মানব জীবনে প্রযুক্তির ভূমিকার সাথে তুল্য।
তবে মানব সংস্কৃতির প্রভাব ধীরে ধীরে উপলদ্ধির ব্যপার। তাই এর প্রভাবে সমাজে কখনও মনুষ্য জাতির আগমন বেশি ঘটেছে আবার কখনও কোনো সমাজ পঙ্গু হয়ে গিয়েছে। তবে জীব বিজ্ঞানীরা এখন মানব সংস্কৃতিকে অন্য নতুন এক দৃষ্টিতে দেখছেন। তাঁরা মানব সংস্কৃতিকে আমাদের বিবর্তনের এক কারণ হিসেবেও দেখছেন।
বিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচন
আমাদের সংস্কৃতি কেবল আমাদের রক্ষাকবচ হিসেবেই কাজ করে না, প্রাকৃতিক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও গুরুত্ব বহন করে। কিন্ত এই প্রাকৃতিক নির্বাচন, বিবর্তন ব্যাপারগুলো আসলে কি?
এই শব্দ গুলো শুনলেই ডারউইনের কথা মনে পড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কেননা তিনিই মূলত এই ব্যাপারগুলোর সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
এক কথায় বিবর্তন হচ্ছে এমন এক জীববৈজ্ঞানিক ধারনা যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জীবের গাঠনিক ও চারিত্রিক ক্রমপরিবর্তনকে বুঝায়। জিনের পরিব্যক্তির বা মিউটেশনের কারণে জীবের নির্দিষ্ট কোনো বংশধরে নতুন কোনো বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটতে পারে বা পুরানো কোনো বৈশিষ্ট্যেরই পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। আর কোনো এক জনগোষ্ঠীতে প্রাণীর টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার প্রক্রিয়াই হচ্ছে প্রাকৃতিক নির্বাচন। তবে প্রাপ্ত নতুন বা পরিবর্তিত সকল বৈশিষ্টই যে কল্যাণকর হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
মানুষ কালে কালে জৈবনিক প্রক্রিয়ায় নিজ নিজ সংস্কৃতির সাথে নিজেদেরকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। যেমন আমাদের ভিন্ন ভিন্ন খাদ্যাভ্যাস। যা কিনা অন্য যে কোনো প্রাকৃতিক নির্বাচনমূলক শক্তি থেকে বেশি প্রভাববিস্তারকারী। ন্যাচার রিভিও জেনেটিক্সের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় কেভিন এন লেল্যান্ড (স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অফ এন্ড্রিওজের জীববিজ্ঞানী) এবং তাঁর সহকর্মীরা উল্লেখ করেন, “ কিছু বিতার্কিক ব্যপারকে ঊর্ধে রেখে জিন আর সংস্কৃতির মধ্যকার বিবর্তন মনুষ্য বিবর্তনের নেতৃত্ব দানকারী হিসেবে আচরণ করতে পারে।’’
বিগত কয়েক যুগ হতেই সংস্কৃতি আর জিনের মধ্যে যে বিবর্তনের এক সম্পর্ক লুকিয়ে আছে তা নিয়ে অনেকেরই ধারণা ছিল, যা সম্প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ বিষয়ে দুই জন বিশেষ প্রবক্তা ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া(লসএঙ্গেলস) রবার্ট বয়েড এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যলিফোর্নিয়ার(ডেভিস) পিটার জে রিচার্সনের মধ্যে এই বিষয়টিকে নিয়ে বিতর্ক ছিল। কিন্তু অবশেষে তাঁরা এই মতে পৌঁছাতে পেরেছেন যে, আমাদের বিবর্তনের পিছনে যে সংস্কৃতির প্রভাব আছে তা পূর্বে তাঁরা হয়ত ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেন নি।
দুধ হজমে বিবর্তন
তাঁদের কাছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের এক লক্ষ্যনীয় উদাহরণ ধরা পরে উত্তর ইউরোপের কয়েকটি অঞ্চলে। বেশিরভাগ মানুষের মাতৃদুগ্ধ পানকালীন সময় অতিক্রম হওয়ার পর দুধের ল্যাক্টোজ হজমক্রিয়ার জিন কিছু কালের জন্য নিষ্ক্রিয় থাকে কিন্ত উত্তর ইউরোপের কিছু অঞ্চল যেগুলোর উদ্ভব প্রায় ৬০০০ বছর পূর্বে ঘটেছিল বলে ধরা হয় এবং এই অঞ্চলগুলো পশু পালনের উপর নির্ভর করত, সেখানে ঐ ল্যাক্টোজ খেকেো জিন বয়স্ক অবস্থায় সক্রিয় থাকে।
কাঁচা দুধ( প্রক্রিয়াজাত নয়) পান করা অনেক সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ রীতি হিসেবে দাঁড়িয়েছে। কেননা দুধের ল্যাক্টোজ হজম সহনশীলতা আমাদের জিনের বিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। তাছাড়া কাঁচা দুধ পানের ফলশ্রুতিতে মানুষ অতিরিক্ত পুষ্টি পাচ্ছে আর অপেক্ষাকৃত বেশী হারে বংশধর রেখে যেতে পারছে, যাদের মাঝে এই অতিরিক্ত পুষ্টি সঞ্চারিত হচ্ছে। ল্যাক্টোজ হজমের সহনশীলতার জন্য এই যে জেনেটিক পরিবর্তন ঘটে তা কেবল ইউরোপে নয়, আফ্রিকার আরো তিন অঞ্চলে লক্ষ্য করা গিয়েছে। মাতৃদুগ্ধ পানের পর থেকে ল্যক্টোজ হজম যাতে না হয় তার প্রতিকার স্বরূপ জিনের যে পরিবর্তন ঘটেছে তা উপরিল্লেখিত চারটি অঞ্চলের ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে ঘটলেও ফলাফল কিন্ত একই ছিল।
জিন-সংস্কৃতির মধ্যকার এই সম্পর্কটি অনেকটা নতুন আবিষ্কার। ইতিমধ্যে বিজ্ঞানীরা মানুষের সবকটি জিন নিয়ে গবেষণা করতে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের সময় আমাদের জেনেটিক পরিবর্তনের চিত্র পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এখান থেকে তাঁরা দেখতে পেরেছেন যে, জিনের যে কোনো একটি প্রকরণের উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত বেশি দেখতে পাওয়া যায়, কেননা ঐ প্রকরণ বংশানুক্রমে সঞ্চারিত হয়ে আসছে তার অপেক্ষাকৃত বেশি টিকে থাকার যোগ্যতা নিয়ে। পর্যবেক্ষণ থেকে আরো জানা যায় যে, প্রায় ১০% জিন(প্রায় ২০০০ জিন) প্রাকৃতিক নির্বাচনের শিকার হয়ে বিবর্তনের স্বাক্ষর বহন করে। যা জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাংক ইনিসটিটিউট ফর ইভোলোশনারি এন্থ্রোপলজির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার মার্ক স্টোনেকিং এর মতে ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ বছর ধরে জিন এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের স্বীকার হচ্ছে। জীববিজ্ঞানীরা জিনের উপর প্রাকৃতিক নির্বাচনের এই বলের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন যদি তাঁরা সব জিনের স্ক্যান করতে পারেন। মানুষের ক্রোমোজোমের মধ্যে অবস্থিত আরো প্রায় ২০,০০০ জিনের কাজ এখনও ভালো করে বুঝা যায় নি, কিন্ত তারা যে প্রোটিন দিয়ে গঠিত তাদের বাহ্যিক গঠন পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে হয়ত তাদের কাজ সম্পর্কে তথ্য উদ্ধার করা সম্ভব।
জিনের এরূপ বিবর্তনের কারণে তারা পরিবেশের সাথে এক সময় খাপ খেয়ে যায়। ইউরোপ বা এশিয়ানদের ত্বকের ভিন্নতা এভাবে ভৌগলিক পরিবেশের সাথে অভিযোজন ক্রিয়ার ফল। আবার সংস্কৃতির প্রভাবেও জিনের বিবর্তন ঘটে। আমাদের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির যে বিচিত্র খাদ্যভাস তা কেবল আমাদের খাবার গ্রহনের ও পরিপাকের উপরই বিবর্তন আনে না, দশ হাজার বছর পূর্ব থেকে শুরু হয়ে আসা কৃষিকাজের মধ্যেও বিবর্তন ও বৈচিত্রতা আনে।
খাদ্যাভাস হতে চাষাবাদে বিবর্তন
আমাদের লালার শর্করা পরিপাককারী এনজাইম অ্যামাইলেজ। কৃষি প্রধান অঞ্চলে বসবাসকারীদের শর্করা গ্রহণের পরিমাণ পশু বা মাছ ভোক্তা এলাকাবাসীদের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি। ফলশ্রুতিতে কৃষি প্রধান অঞ্চলের লোকদের মাঝে অ্যামাইলেজ পরিপাককারী জিন অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি উপস্থিত থাকে।
স্বাদ ও ঘ্রাণ গ্রহণের পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক নির্বাচনকে প্রতিফলিত করে এর সাথে সাথে মানুষ যাযাবর থেকে যে স্থায়ী ভাবে বসাবাস করছে তার কারণকে প্রতিফলিত করে। এমনকি আমাদের হাড়ের গঠনেও প্রাকৃতিক বিবর্তনের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। পনের হাজার বছর ধরে আমাদের হাড়ের ওজন যে ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে তা তো এক প্রকার নির্দিষ্ট জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিবর্তনেরই ফল।
বিবর্তনের পথ ধরে কোন কোন জিনের উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত বেশি তা সংখ্যাতাত্বিকভাবে বিজ্ঞানীরা সনাক্ত করেছেন। শুধু তাই নয়, কোন জিন বিবর্তনের শিকার আর কোন জিন নয় তা ভালো করে নির্নয়ের জন্য তাঁরা কিভাবে কতিপয় জিনসমূহ বিবর্তনের কাছে হার মেনেছে তাও খতিয়ে দেখছেন।
ড. স্টোনেকিং এবং তাঁর সহকর্মীরা বিবর্তনের শিকার ৩ টি জিন নিয়ে সংখ্যাতাত্ত্বিকভাবে গবেষণা চালান। আমাদের মাথা কেশময় নাকি টাক থাকবে অর্থাৎ চুলের বেড়ে উঠা যে জিন নিয়ন্ত্রণ করে তা হল EDAR ( ectodysplasin A receptor), আর এই জিনের এক সাধারণ প্রকরণ হল A। যা পূর্ব এশিয়ান ও অ্যামেরিকানদের মধ্যে বিদ্যমান। যার উপস্থিতি আবার ইউরোপিয়ান বা আফ্রিকানদের মাঝে কম খুঁজে পাওয়া যায়। এর ফলশ্রুতিতে পূর্ব এশিয়ান ও অ্যামেরিকানদের চুল তুলনামূলকভাবে বেশি ঘন হয়ে থাকে। যদিও এই ঘন চুল থাকার আসল কারণ জানা যায় নি, তবে ধারণা করা হয় যে, সাইবেরিয়ান অঞ্চলের তাপ সহনশীলতার জন্য এই ঘন চুলের আবির্ভাব। এমনকি এও মনে করা হয় যে, আকর্ষনীয় যৌন সঙ্গী নির্বাচনের পথ ধরেই এই ঘন চুলের প্রাকৃতিক নির্বাচন ঘটেছে EDAR জিনের দ্বারা। কিংবা আরেক সম্ভাবনা তত্ত্ব আছে এক্ষেত্রে তাঁদের মতে যে, এই জিনের সাথে আমাদের পরিপাকীয় এক জিনের সংযোগ আছে। যা কিনা কোন কোন ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধের কাজ করে থাকে আর তারই পার্শপ্রতিক্রিয়া হিসেবে চুল ঘন হয়ে থাকে। তবে ড. স্টোনেকিং এর মতে তাঁদের এ নিয়ে আরো কাজ করার বাকি আছে। তিনি এ সূত্রে বৈজ্ঞানিকভাবে মানব সংস্কৃতি ও সমাজের উৎপত্তি নিয়ে গবেষণা করছেন।
উপরোক্ত গবেষণা প্রমাণ করে যে জীববিজ্ঞানীরা বিবর্তিত জিন সনাক্তকরণে কতটা সচেষ্ঠ। প্রাগঐতিহাসিক কাল থেকেই সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়ে আসছে তবে ধীরে ধীরে। প্রস্তর শিল্পের আবির্ভাব প্রায় আড়াই মিলিয়ন বছর পূর্বে ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়, যা প্রায় এক মিলিয়ন বছর পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। কিন্ত বিগত পঞ্চাশ হাজার বছর থেকে মানুষের সাংস্কৃতিক ব্যবহারের মধ্যে ক্রমান্বয়ে যে পরিবর্তন ঘটছে তা আমাদের বিবর্তন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে। যদিও জীববিজ্ঞানীরা এটাকে এক সম্ভাবনা বলে মনে করছেন। তাঁরা তো আর পুরানো জিনের চিহ্নিত করতে সক্ষম নন যেহেতু পরিব্যক্তির কারণে নতুন জিন পুরানোটার স্থান দখল করে নিয়েছে। তাই প্রকৃতঅর্থে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া পূর্বে বেশি ঘটেছিল নাকি সম্প্রতি বেশি ঘটছে।
কিন্ত জিন স্ক্যানের সময় কম পরিব্যক্ত হওয়া জিন ধরা পড়ছে না, তাই বিজ্ঞানীরা হয়ত কেবল পরিব্যক্ত হওয়া জিনগুলো সনাক্ত করতে সক্ষম হচ্ছেন।
আমাদের বিবর্তনের পিছনে আমাদের সংস্কৃতিই তাহলে অনেক প্রভাব ফেলছে বা বল প্রয়োগ করছে। এই প্রক্রিয়াইয় একসময় যদি আমাদের সংস্কৃতি প্রধান ভূমিকা পালন করে তবে মানুষ তখন তার নিজ তৈরীকৃত চাপ নিজ বলেই গ্রহন করতে সক্ষম হবে। অবশ্য তা হলে, আমাদের দেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা আরো অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ গ্রহন করতে পারবে সহজেই!
তথ্যসূত্রঃ
১. দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
২. উইকিপিডিয়া
Leave a Reply