গল্প বলতে আর শুনতে কার না ভাল লাগে। আর সে গল্প যদি হয় নিজেদের তাহলে তো কোন কথাই নেই। তাহলে চলুন শোনা যাক আমাদের নিজেদের গল্প। একটা বিখ্যাত উক্তি আছে যে, “আমরা সবাই নক্ষত্রের সন্তান”। তাহলে বলা চলে যে আমাদের গল্প মানেই হল নক্ষত্রের গল্প, আমাদের মহাবিশ্বের গল্প। আজ গল্প বলব আমাদের চারপাশের, গল্প বলব আমাদের আবির্ভাব আর সৃষ্টি নিয়ে; আমাদের উদ্ভব নিয়ে। কেমন ছিল শুরুটা? কি ছিল সেখানে? এর আগেই বা কি ছিল আর কিই বা থাকবে এর পরে? এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার একটা ক্ষুদ্র প্রয়াস; যদিও বেশিরভাগ প্রশ্নের উত্তর এখনো আমাদের আধুনিক বিজ্ঞানের কাছে অজানা! তবুও আপাতত যা জেনেছি তার মধ্যেই আমাদের গল্প সীমাবদ্ধ থাকবে। চলুন শুরু করি বিগ ব্যাং থেকে। এর আগের কথা বলার কিছুই নেই কারন সময়ের শুরু হয়েছিল ঠিক তখন থেকে। আর সময়ের আগে কিংবা ঋণাত্মক সময় নিয়ে আপাতত না ভাবলেই চলবে। আমরা ধনাত্মক সময় নিয়েই বকবক করব। তো যাই হোক, একটি ক্ষুদ্র, অসীম ক্ষুদ্র যা কল্পনারও বাইরে। এমন এক বিন্দু থেকে মহাবিশ্ব তৈরির মহাযজ্ঞ বিগ ব্যাংয়ের শুরু হয়েছিল। এর তাপ আর ভর ছিল অসীম। একে সিঙ্গুলারিটি বলা হয়। এখানে পদার্থ বিজ্ঞানের কোন সূত্রই আর কাজ করে না। সবকিছুই এখানে ভঙ্গুর। আমাদের চেনা মহাবিশ্বর কোন কিছুই এখানে খাটে না। সবকিছুই কেমন যেন ভূতুরে! চলুন শূন্য থেকে শুরু করি আর ব্যাখ্যা করি প্রিয় বিজ্ঞানের ভাষায়। দেখে নেয়া যাক নিচের পয়েন্ট গুলো। এগুলোই আমাদের মূল গল্প।
সময়ঃ ১০^-৪৩ সেকেন্ড> তাপমাত্রাঃ ১০^৩২ কেলভিন # এখান থেকেই পদার্থ বিজ্ঞানের শুরু। এর আগের কোনকিছুই পদার্থবিজ্ঞান বলতে পারে না। অনুমান করা হয় যে, এই সময় থেকেই মহাকর্ষ বল সিঙ্গেল ইউনিফাইড ফোর্স থেকে আলাদা হয় এবং বিগ ব্যাং এর সূচনা করে। তখন আমাদের মহাবিশ্ব ব্যাস ছিল মাত্র ১০^-২৮ সেন্টিমিটার। আমাদের মহাবিশ্ব ছিল অকল্পনিয়ভাবে গরম কিন্তু এর প্রসারণের সাথে সাথে এটি শীতল হচ্ছিল।
সময়ঃ ১০^-৩৫ সেকেন্ড> তাপমাত্রাঃ ১০^২৮ কেলভিন # শুরু হয় ‘কাল প্রসারণ’। তখন আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্বের ব্যাস ছিল ১০^-২৪ সেন্টিমিটার এবং এটি পর্যায়ক্রমে আরো শীতল হচ্ছিল। কিন্তু এটি প্রায় এর আগের অবস্থাতেই ছিল। যেমনটা ০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে বরফ হওয়ার আগে পানি তরল থাকে। এই সময়ে হটাত করে বিপরীত মহাকর্ষ বলের উদ্ভব হয় এবং প্রসারণ থেমে যায়। তখন পুনরায় আবার মহাবিশ্ব উত্তপ্ত হতে থাকে এবং শক্তিশালী ও দুর্বল বৈদ্যুতিক চার্জ আলাদা বল হিসেবে রূপ নিতে শুরু করে এবং তারা নতুন পরিচয়ে উদ্ভব হয়। শক্তি জমাট বেধে বস্তুতে রূপ নিতে শুরু করে। এমন সময় উদ্ভব হয় কোয়ার্ক আর ইলেকট্রনের। পাশাপাশি এদের বিপরীত প্রতিপদার্থেরও জন্ম হয়। এই সময়ে আমাদের মহাবিশ্ব প্রায় একটি ফুটবলের আকারে ছিল।
সময়ঃ ১০^-৩২ সেকেন্ড> তাপমাত্রাঃ ১০^২৭ কেলভিন # শেষ হয় কালের প্রসারণ। এই সময়টাতে মহাবিশ্ব ছিল একেবারেই সমসত্ত্ব। পদার্থ, প্রতিপদার্থ আর রেডিয়েশন ছিল একটি বাবলের মত অস্বচ্ছ স্যুপের ভিতর।
সময়ঃ ১০^-৬ সেকেন্ড> তাপমাত্রাঃ ১০^১৩ কেলভিন # এই সময়টাতে মহাবিশ্ব প্রায় আমাদের সৌরজগতের আকারে আসে। তাপমাত্রা কমে যায়। এই কম তাপমাত্রায় কোয়ার্ক প্রোটন আর নিউট্রনের গঠন সৃষ্টি করে। সংঘর্ষ শুরু হয় পদার্থ আর প্রতিপদার্থের। সৌভাগ্যবশত সেখানে হয়ত পদার্থের পরিমাণ কিছুটা বেশি ছিল। তাই সংঘর্ষে পদার্থের জয় হয় আর হেরে যায় প্রতিপদার্থরা। এই কারনেই আজ আমরা মহাবিশ্ব কেবল পদার্থেরই অস্তিত্ব পাই। যদি তখন পদার্থ আর প্রতিপদার্থের পরিমাণ সমান থাকত তাহলে আজ মহাবিশ্বে শুধুমাত্র শক্তি ছাড়া আর কিছুই থাকত না।
সময়ঃ ৩ মিনিট> তাপমাত্রাঃ ১০^৯ কেলভিন # প্রোটন আর নিউট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আবদ্ধ হতে শুরু করে। কিন্তু ইলেকট্রনের শক্তি তখনো খুব বেশি ছিল, যার কারনে সে পরমাণু গঠনে অংশ না নিয়েই ইতিউতি ছোটাছুটি করতে থাকে।
সময়ঃ ১০^৫ বছর> তাপমাত্রাঃ ৩০০০ কেলভিন # ইলেকট্রনের শক্তি কমে আসে এবং সে আবদ্ধ হয় নিউক্লিয়াসের কক্ষপথে এবং গঠন করে পরমাণু। বিকিরণ তখন বস্তু থেকে আলাদা হয় এবং এই সময়টাতেই আলোর ভ্রমণ শুরু হয়। আলো ভ্রমণ করতে থাকে স্থানের মধ্য দিয়ে।
সময়ঃ ১০^৯ বছর> তাপমাত্রাঃ ১৫ কেলভিন # কোয়াসারের সৃষ্টি হয়। মহাবিশ্ব আকার পেতে থাকে। তৈরি হয় গ্যালাক্সি, নিউট্রন স্টার, ব্ল্যাক হোল, সৌরজগৎ আর গ্রহের। আমাদের দৃশ্যমান মহাবিশ্ব আজকের এই রূপ ধারণ করে আর স্থিতিশীলতা পায়। শুরু করতে থাকে প্রসারণ যা আজও বিদ্যমান।
এই হল আমাদের মহাবিশ্বের মোটামুটি ক্ষুদ্র গল্প। এভাবেই শূন্য থেকে কোয়ান্টাম ফ্ল্যাকচুয়েশনের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়ে আজও সে বহমান। এভাবেই চলতে থাকবে সে আরো বহু কোটি বছর। বাড়তে থাকবে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি। একসময় এন্ট্রপি চূড়ান্ত রূপ পাবে। শুরু হবে মহা সংকোচন। নিভে যাবে একেবারে শেষের নক্ষত্রও। এমনকি লাল বামনেরাও। তখন থাকবে শুধু অন্ধকার। যেভাবে যাত্রা শুরু করেছিল ঠিক তার বিপরীতভাবে তার সেই মহাযাত্রার অন্তিম মহা শেষ ঘটবে। শুরু হবে নতুন কোন যাত্রা যা এখনো সম্পূর্ণ অজানা! আজ এ পর্যন্তই থাক। বাকিটা আজ আর জেনে কাজ নেই। যদি আরো কিছু জানতে পারি তাহলে অন্য কখনো সে গল্প বলা যাবে। আপাতত কেবল ভাবতে থাকি গল্পের পরের অংশ…
Leave a Reply