(প্রথম খন্ডের পর)
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ (নিউট্রিনো সনাক্তকরণ)
নিউক্লীয় বলের প্রতি সাড়া দেওয়ার ভিত্তিতে কণিকাগুলো দুই প্রকার, হেড্রন এবং লেপটন। নিউক্লীয় বল দুই প্রকার, সবল এবং দুর্বল (strong and weak nuclear forces) এটি আমরা অনেকেই জানি। যেসব কণিকা সবল বলটির প্রতি সাড়া দেয় তাদের বলা হয় হেড্রন আর যারা দুর্বল বলটির প্রতি সাড়া দেয় তাদের বলা হয় লেপটন। হেড্রন আবার দুই প্রকার: মেসন এবং ব্যরিয়ন। মেসনগুলো দুটি কোয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত আর ব্যরিয়ন গঠিত হয় তিনটি করে কোয়ার্ক দিয়ে। এই অর্থে প্রোটন, নিউট্রন এগুলো হচ্ছে ব্যরিয়ন। অপরদিকে ইলেক্ট্রন হলো লেপটন। ব্যারিয়ন এবং লেপটনের আবার তাদের বৈশিষ্ট্যসূচক ব্যারিয়ন ও লেপটন সংখ্যা থাকে। যেহেতু ইলেক্ট্রন একটি লেপটন তাই এর লেপটন সংখ্যা +১ এবং ব্যারিয়ন সংখ্যা ০। অপরদিকে প্রোটন এবং নিউট্রন উভয়েই ব্যারিয়ন হওয়ায় তাদের লেপটন সংখ্যা শূন্য এবং ব্যারিয়ন সংখ্যা +১।
এই কণিকাগুলোর সবারই আবার বিপরীত কণিকা বা প্রতিপদার্থ (anti-matter) আছে। একটি কণিকা যদি তার বিপরীত কণিকার সংস্পর্শে আসে তাহলে উভয়েই নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়ে ভরটুকু বিকিরিত শক্তি হিসেবে নিঃসৃত হয়। এই প্রক্রিয়ায় কোনো সংরক্ষণসূত্রের বিচ্যুতি ঘটে না। উদাহরণ হিসেবে ইলেক্ট্রন এবং তার বিপরীত কনিকা পজিট্রনের কথা বলা যায়। ইলেক্ট্রন এবং পজিট্রন সবদিক থেকেই একই রকম শুধুমাত্র এদের চার্জ একে অপরের বিপরীত। অর্থাৎ ইলেক্ট্রনের চার্জ যেহেতু -১ তাই পজিট্রনের চার্জ হবে +১। এরা যখন একে অপরের সংস্পর্শে আসবে তখন উভয়েরই চার্জ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। যেহেতু ইলেক্ট্রন ও পজিট্রনের মোট চার্জের সমষ্টি শূন্য ((-১) + (+১) = ০), তাই এদের উভয়ের চার্জ একত্রে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও তাতে চার্জের সংরক্ষণশীলতা নীতি লংঘিত হয় না। কাজেই বলা যায় ধনাত্মক ও ঋনাত্মক চার্জ একজোড়া করে সৃষ্টি বা একজোড়া করে ধ্বংস করা যাবে কিন্তু একক ভাবে সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যাবে না। লেপটন সংখ্যার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যেহেতু ইলেক্ট্রনের লেপটন সংখ্যা +১ তাই এন্টিইলেক্ট্রন তথা পজিট্রনকে লেপটনের সংরক্ষণশীলতা অটুট রাখার জন্য লেপটন সংখ্যা -১ বরাদ্দ দিতে হবে।
আমরা প্রথম পরিচ্ছেদে দেখেছি নিউট্রনের বিভাজনের মাধ্যমে ইলেক্ট্রন ও প্রোটন উৎপন্ন হওয়ার ক্ষেত্রে সংরক্ষরণশীলতা সূত্র অটুট রাখার জন্য তৃতীয় আরেকটি কণিকা (যার নাম দেওয়া হয়েছে নিউট্রিনো) কল্পনা করে নিতে হচ্ছে যদিও এই কণিকাটিকে কেউ সনাক্ত করেনি। এধরনের কণিকা ধরে নিতে হলে তা এমনভাবে করতে হবে যেন এটি সংবগুলো সংরক্ষনশীলতা সূত্রই মেনে চলে। যদি কিছু সূত্র রক্ষা করতে গিয়ে অন্য আরো কিছু সূত্র লংঘিত হয় তাহলে চলবে না। তাই নিউট্রিনোর উপর বিভিন্ন সংরক্ষণশীলতাবাচক সংখ্যাগুলোই সেভাবেই প্রযুক্ত করতে হবে। এবং তা করতে গিয়ে এর ব্যারিয়ন সংখ্যা হয় o, চার্জ সংখ্যা হয় ০ এবং লেপটন সংখ্যা হয় -১। কিন্তু একটি স্বাভাবিক কণিকার প্রতিকণিকাগুলোর ক্ষেত্রে লেপটন সংখ্যা ঋনাত্মক হিসেব প্রয়োগ করাই রীতি (পজিট্রনের ক্ষেত্রে যেমন আমরা দেখেছি)। তাই নিউট্রনের বিভাজনে উৎপন্ন নিউট্রিনোটিকে বরং প্রতিনিউট্রিনো এবং সেই প্রতিনিউট্রিনোর বিপরীত কণিকাটিকে নিউট্রিনো হিসেবে নামকরণ করা হয়। অর্থাৎ, নিউট্রনের বিভাজনে উৎপন্ন তিনটি কণিকা হলো প্রোটন, ইলেক্ট্রন ও প্রতিনিউট্রিনো। শেষোক্ত তিনটির প্রতিটি সংরক্ষণশীলতাবাচক মোট সংখ্যা নিউট্রনের সংরক্ষনশীলতাবাচক সংখ্যাগুলোর সমান হয়।
ডেস্কে বসে এই কাজগুলো করা খুব কষ্টসাধ্য কিছু নয় বরং আসল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এই অনুমিত ধারনাগুলোকে প্রমাণ করা। আর নিউট্রিনো যেন একটি সোনার হরিন, বিজ্ঞানীদের যাবতীয় প্রচেষ্টাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সে অধরাই থেকে যাচ্ছে। আবার এটি এত চমৎকারভাবে পরমাণুর মডেলে খাপ খেয়ে যায় যে এর অস্তিত্বও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। প্রকৃতপক্ষে, এখন আমরা জেনেছি যে, নিউট্রিনোর সাথে অন্য কণিকার মিথস্ক্রিয়া এতোই বিরল যে এটি বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার আগে গড়ে একটি সীসার দন্ড বরাবর ৩৫০০ আলোকবর্ষ অতিক্রম করে! তবে এটি গড় মান, বাস্তবে এটি উল্লেখিত দৈর্ঘ্যের মিলিয়নভাগের একভাগ অতিক্রম করেও আটকে যেতে পারে কিন্তু আরো মিলিয়নগুন দীর্ঘ দন্ডের ভিতর দিয়েও চলে যেতে পারে।
আবার এমনও তো হতে পারে আমরা কোনো একটা কিছু সনাক্ত করলাম এবং নিউট্রিনো ভেবে হৈ-হুল্লোড় জুড়ে দিলাম কিন্তু সেটি নিউট্রিনো না-ও হতে পারে। কাজেই নিউট্রিনো হতে হলে সেটিকে সুনির্দিষ্ট মিথস্ক্রিয়া হতে হবে যা অন্য কারো কাছ থেকে পাওয়া যায় না। একে তো নিউট্রিনো ধরাই দেয় না তার উপর এতসব শর্ত, বিজ্ঞানীরা প্রমাদ গুণলেন। তবে এত সহজে হাল ছেড়ে দিলে বিজ্ঞানীরা আর বিজ্ঞানী হয়ে উঠতেন না এবং তাঁরা সর্বকালের সবচেয়ে স্মরণীয় হয়েও থাকতেন না। প্রথমেই তাঁরা গবেষণার জন্য নিউট্রিনোর ভালো উৎসের খোঁজ করলেন। ইউরেনিয়ামের বিভাজনে নিউট্রন ভাঙ্গে এবং একটি ফিশন রিএক্টর থেকে প্রতিমূহুর্তে ঝাঁকে ঝাঁকে নিউট্রন ভেঙ্গে গিয়ে প্রতিটি থেকে একটি করে নিউট্রিনো (আসলে প্রতিনিউট্রিনো, কিন্তু সরলীকরণের জন্য অনেকসময় নিউট্রিনো বলেই চালিয়ে দেওয়া হয়) পাওয়া যাওয়ার কথা তাই ফিশন রিএক্টর নিউট্রিনোর একটি ভালো উৎসই হবে। একটি ফিশন রিএক্টর থেকে প্রতি সেকেন্ডে কয়েক বিলিয়ন নিউট্রিনো পাওয়া যেতে পারে।
পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হলো নিউট্রিনোর কাছ থেকে ঠিক কি ধরনের ব্যবহার আশা করা যায় যা আর কারো কাছ থেকে পাওয়া যাবে না, অর্থাৎ আমরা যদি কোনো কিছু সনাক্ত করি তাহলে সেটি নিউট্রিনো হিসেবে নিশ্চিত হতে পারি। আমরা জানি, একটি নিউট্রন ভেঙ্গে গিয়ে একটি প্রোটনের পরিণত হয়, যাতে একটি ইলেক্ট্রন এবং একটি প্রতিনিউট্রিনো নিঃসৃত হয়। আমরা কি এই প্রক্রিয়াটি বিপরীত দিকে চালাতে পারি যেন একটি প্রোটন একটি ইলেক্ট্রন ও একটি প্রতিনিউট্রিনো শোষন করে পুনরায় নিউট্রনে পরিণত হয়? এটা আসলে খুবই বেয়াড়া আবদার। এমনিতেই একটি প্রতিনিউট্রিনোর কোন প্রোটনকে আঘাত করার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। ঠিক একই সময়ে একটি ইলেক্ট্রন এবং একটি প্রতিনিউট্রিনো, একটি প্রোটনকে আঘাত করবে এধরনের কল্পনা অতিমাত্রায় বাড়াবাড়ি। এটি এতই বিরল ক্ষেত্রে ঘটতে পারে যে তা চিন্তা করা বাস্তবতাবিবর্জিত হবে। তবে এই বিষয়টিকে একটু ঘুরিয়েও চিন্তা করা যায়। একটি বস্তুর মধ্যে ইলেক্ট্রন প্রবেশ করা আর তার মধ্য থেকে একটি পজিট্রন বেরিয়ে যাওয়া সমতুল্য। কারণ উভয় ক্ষেত্রেই সংরক্ষনশীলতার সংখ্যাগুলো একই থাকবে। (বিষয়টি অনেকটা এরকম যে, কেউ আপনাকে একটি ডলার দান করল, আর কেউ আপনার পক্ষ থেকে কাউকে একটি ডলার দেনা শোধ করে দিলো এই দুটি ঘটনা সমতুল্য। উভয় ক্ষেত্রেই আপনার সম্পদের পরিমান আগের চেয়ে এক ডলার বৃদ্ধি পাবে।) প্রথম ক্ষেত্রটি বস্তবতা বিবর্জত হলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি খুব অসম্ভব কিছু নয়। তাই বিজ্ঞানীরা এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রটি সৃষ্টির সুযোগ তৈরি নিয়ে চিন্তা করা শুরু করলেন। তাঁরা ভাবলেন একটি প্রতিনিউট্রিনো একটি প্রোটনকে আঘাত করে নিউট্রনের পরিণত হতে পারে এবং এই প্রক্রিয়ার একটি পজিট্রন নির্গত হতে পারে।
পরিকল্পনাটি হলো এমন: একটি প্রতিনিউট্রিনোর উৎস থেকে একটি প্রতিনিউট্রিনো বেরিয়ে এসে একটি প্রোটনকে আঘাত করবে (এটি অত্যন্ত বিরল ঘটনা হবে তবে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করলে এমন একটি ঘটনা ঘটেও যেতে পারে) এবং যার ফলে একটি নিউট্রন ও একটি পজিট্রন উৎপন্ন হবে। পজিট্রনটি উৎপন্ন হওয়ার এক সেকন্ডের মিলিয়নভাগের মধ্যেই কাছাকাছি একটি ইলেক্ট্রনকে পেয়ে যাবে এবং উভয়ে মিলে নিশ্চিন্থ হয়ে গিয়ে ভরটুকু দুটি গামারশ্মি কণিকারূপে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে পরস্পর বিপরীত দিকে নির্গত হবে। উৎপন্ন নিউট্রনটি কাছাকাছি স্থাপিত একটি ক্যাডমিয়াম নিউক্লিয়াসে আঘাত করবে এবং অতিরিক্ত শক্তিটুকু সুনির্দিষ্ট শক্তির কয়েকটি ফোটন আকারে নির্গত হয়ে যাবে। উৎপন্ন গামা রশ্মির এবং ফোটনের দিক, শক্তি কেমন হবে এসব আগে থেকেই হিসেব করে বের করে সেই অনুযায়ী সরঞ্জামগুলো তৈরি করা হবে। প্রোটনের উৎস হিসেবে পানিপূর্ণ জলাধার ব্যবহার করা হলো এবং তাতে ক্যাডমিয়াম ক্লোরাইড দ্রবীভুত করে ক্যাডমিয়ামের উৎস নিশ্চিত করা হলো এবং এই ব্যবস্থাটিকে একটি ফিশন রিএক্টরের কাছে স্থাপন করা হলো। বিকিরণসমূহ সনাক্ত করার জন্য ডিটেক্টরগুলো জায়গামতো বসানো হলো। যদি ফলাফল পূর্বানুমানের সাথে মিলে যায় তাহলে বোঝা যাবে সত্যিই প্রতিনিউট্রিনো প্রোটনকে আঘাত করেছে। কারণ ঠিক এই ধরনের সম্মিলিত ফলাফল অন্য কোনোভাবে পাওয়া যাবে না। কিন্তু মুষ্কিল হচ্ছে আমাদের পরিবেশে এমনটিতেই নানারকম বিকিরণ ঘুরে বেড়াচ্ছে তাই এই সরঞ্জামগুলোকে যথযথভাবে শিল্ডিং করে নয়েজ কমানোর ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে হলো। ১৯৫৩ সাল থেকে এই ধরনের ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়ে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে আমেরিকার পদার্থবিদ ফ্রেডরিখ রাইনেস এবং ক্লাইড লোরেইন কাওয়ান অবশেষে পাউলির প্রস্তাবণার ২৬ বছর পরে ঘোষনা করলেন তাঁরা নিউট্রিনো সনাক্ত করেছেন।
তাঁদের ঘোষনার পর অন্যান্য বিজ্ঞানীরা আরো উন্নতমানের সরঞ্জাম দিয়ে, আরো নানা আঙ্গিকে পরীক্ষাটির পুনরাবৃত্তি করে নিশ্চিত করলেন নিউট্রিনোর সত্যিই অস্তিত্ব আছে। এটি আর অলীক এবং শুধুমাত্র হিসেব মেলানোর জন্য ধরে নেওয়া কণিকা রইল না। এটি বিজ্ঞানে যুক্তি এবং অনুমানের প্রয়োজনীয়তারও স্বীকৃতি। এবং সেই সাথে এটি প্রমান করল একটি ভালো তত্ত্ব যা নানাবিধ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তা নিতান্ত বাধ্য না হলে তাগ না করাই উচিৎ এবং তার সবরকম বিকল্প খুঁজে দেখা জরুরী।
ফিশন (নিউক্লিয়াসের ভাঙ্গন) প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন নিউট্রিনোটি আসলে প্রতিনিউট্রিনো, তাই এর বিপরীত প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ ফিউশন (একাধিক নিউক্লিয়াসের একীভবন) প্রক্রিয়ায় প্রতিনিউট্রিনোর বিপরীত কণিকা নিউট্রিনো উৎপন্ন হওয়ার কথা। বিজ্ঞানীরা তাই এবারে নিউট্রিনো সনাক্ত করতে চাইলেন। তবে ফিশন চুল্লী সারা বিশ্বে বহুল প্রচলিত হলেও ফিউশন চুল্লী এখনো পর্যন্ত বিরল। কিন্তু এই সমস্যাটির সমাধান হলো ফিশন চুল্লীর চেয়ে আরো অনেক অনেক সহজ প্রক্রিয়ায়। আমাদের সুর্য নিজেই একটি ফিউশন চুল্লী এবং একে যথাযথভাবে কাজে লাগালে আমরা বিপুল পরিমান নিউট্রিনো পেতে পারি। একটি নিউট্রিনোর ভাঙ্গনের মাধ্যমে প্রোটন ও ইলেক্ট্রন ও প্রতিনিউট্রিনোর উৎপন্ন হয়। এই প্রক্রিয়াটিই প্রতিনিউট্রিনো উৎপন্ন হওয়ার বদলে নিউট্রিনো শোষনের মাধ্যমেও ঘটতে পারে (ইতিপূর্বে আমরা যেমন: ইলেক্ট্রন আঘাতের বদলে বিকল্প হিসেবেপজিট্রন উৎপন্ন করেছিলাম এটিও তেমনই)। নিউট্রিনো সনাক্ত করা আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তা হলো সুর্যসংক্রান্ত গবেষনা। যেহেতু এরা পদার্থের সাথে সহজে প্রতিক্রিয়া দেখায় না তাই সুর্যের কেন্দ্র থেকে উৎপন্ন নিউট্রিনোগুলো সরাসরি সনাক্ত করা গেলে তা সূর্যের কেন্দ্র সম্বন্ধে আরো নির্ভরযোগ্য তথ্য প্রদান করবে।
প্রতিনিউট্রিনো সনাক্ত করার জন্য প্রোটনের উৎস হিসেবে পানি ব্যবহার করা হয়েছিলো। তেমনি, নিউট্রিনো সনাক্ত করার জন্যও নিউট্রন সমৃদ্ধ একটি উৎস লাগবে যেখানে নিউট্রিনো আঘাত করে একে প্রোটন ও ইলেক্ট্রনে পরিণত করবে। ইতালীয় পদার্থবিদ ব্রুনো এম. পন্টেকোর্ভো নিউট্রনের উৎস হিসেবে ক্লোরিন-৩৭ সমৃদ্ধ কোন বস্তু ব্যবহারের কথা প্রস্তাব করলেন কেননা যদি এতে নিউট্রিনো আঘাত করে তাহলে একটি নিউট্রন প্রোটনে পরিণত হওয়ার মাধ্যমে তা আর্গন গ্যাসে পরিণত হবে এবং তা সহজেই পৃথক করে সনাক্ত করা যাবে। অবশেষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো ক্লোরিন-৩৭ এর উৎস হিসেবে পারক্লোরোইথেন ব্যবহার করা হবে যা ড্রাইক্লিনিংএর দ্রাবক হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং তাই বেশ সহজলভ্য। যদি আর্গন গ্যাস উৎপন্ন হয় তাহলে তা তরল মিশ্রন থেকে হিলিয়ামের প্রবাহ চালিয়ে সহজেই পৃথক করা যাবে এবং এটি তেজস্ক্রিয় বলে খুব সামন্য পরিমানে উপস্থিত থাকলেও নজরে আসবে।
সত্তুরের দশকের শেষের দিকে রেইমন্ড ডেভিস এবং জন ব্যাকল সৌর নিউট্রিনোসমূহ শনাক্ত করার জন্য কাজ শুরু করেন। ডেভিস পারক্লোরোইথেনের বড় বড় ঘড়া নিয়ে সেগুলোকে মাটির গভীরে প্রায় এক মাইল বা তারও নিচে পুঁতে রাখলেন। এই উপরের দীর্ঘ মাটির স্তরটি নিউট্রিনো ছাড়া বাকী সবধরনের বিকিরণ এমনটি মহাজাগতিক রশ্মিকেও শুষে নেবে।(তবে পরীক্ষাধীন স্থানের আসেপাশে শিলার মধ্যেও তেজস্ক্রিয় বস্তু থাকতে পারে, যা থেকে কণিকা নিঃসরণ ঘটতে পারে।) সুর্য সংক্রান্ত গবেষনার জন্য সুর্য থেকে দূরে মাটির গভীরে যেতে হচ্ছে এটি একধরনের আয়রনি! তবে শেষ পর্যন্ত ডেভিস এই পদ্ধতিতে নিউট্রিনো সনাক্ত করলেন যদিও যে পরিমান নিউট্রিনো পাওয়ার কথা তার কেবলমাত্র একতৃতীয়াংশ সনাক্ত হয়েছিলো। বাকী দুই তৃতীয়াংশ কণিকা কোথায় গেলো সেটি নিয়ে তখন গবেষকরা অনেক ভেবেছেন কিন্তু সমাধান পাননি। তবে পরবর্তীতে এই রহস্যের সমাধান হয়েছিলো অভুতপূর্ব উপায়ে। এই ধরনের একট ব্যবস্থার মাধ্যমে আমেরিকান পদার্থবিদ রেইমন্ড ই. ডেভিস সর্বপ্রথম নিউট্রিনো সনাক্ত করেন।
(তৃতীয় খন্ডের লিংক)
Leave a Reply