১.
ফেব্রুয়ারি ১১ তারিখ, যেদিন মহাকর্ষ তরঙ্গের অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, অনেকের মতো আমিও এ বিষয়ে কৌতুহলী হয়ে উঠি। মহাকর্ষ তরঙ্গ বলে একটা জিনিস যে আছে তা প্রায় একশ বছর আগে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে বলে গেছেন। আবদুল গাফফার রনির “থিওরি অব রিলেটিভিটি” (অন্বেষা, ২০১৬) বইটি পড়ে ফেলি। লেখক সাবলীল ভাষায় এ তত্ত্বটির মূল ধারণাগুলোর সহজবোধ্য বর্ণনা দিয়েছেন। বইটি পদার্থবিজ্ঞানের বই হলেও বেশ উপভোগ্য, গাণিতিক সূত্রের ছড়াছড়ি নেই। এই জটিল বিষয়ে প্রাথমিক সাক্ষরতা লাভের জন্য চমৎকার উৎস। আইনস্টাইন, যাকে বলা হয় বিজ্ঞানের পোস্টার–বয়, বিজ্ঞানের রঙিন জগতের একজন তারকা, তিনি আরেকবার জিতলেন। তাঁর তত্ত্বটিতে কি বলা হয়েছে, কিংবা মহাকর্ষ তরঙ্গ জিনিসটা আসলে কি – এ সব বিষয় নিয়ে আমি কিছুই লিখবো না। কারণ বাংলা ভাষায় অনেকেই এ বিষয়গুলো নিয়ে খুব ভালো লিখছেন। আমার আগ্রহ হলো অন্য জায়গায়: আইনস্টাইন কিভাবে “আইনস্টাইন” হয়ে উঠলেন? আমরা যে শুনি তিনি তৎকালীন নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞানের ভিত নড়িয়ে দিয়ে নতুন ধরনের পদার্থবিজ্ঞান চালু করেছেন – এ রকম বিদ্রোহী কি একেবারে শুরু থেকেই ছিলেন? তিনি কাজ করতেন কিভাবে? তার কাছ থেকে তরুণরা কি শিখতে পারেন? যে কোন বড়সড় বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, কিংবা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পেছনে একটি প্রস্তুতির বিষয় থাকে। আমরা সেই বিরাট আবিষ্কার বা পরিবর্তন দেখে এতোটাই বিস্মিত হয়ে যাই, ঘটনার নায়কের প্রচলিত জীর্ণ–নিয়ম ভেঙে ফেলা–বিদ্রোহের সাফল্যে এতোটাই উদ্বেলিত হয়ে পড়ি যে পেছনের দীর্ঘ প্রস্তুতির পরিশ্রমটা চোখেই পড়ে না। আর সে প্রস্তুতি যে প্রচলিত রীতিমাফিকই হয়ে থাকে, সে কথাটাও ভুলে যাই। অনেক দিন আগে কাল নিউপোর্টের ব্লগে এ প্রসঙ্গে একটি লেখা পড়ি যেখানে তিনি আইনস্টাইনের প্রস্তুতির উপর আলো ফেলেছিলেন। সেখান থেকে একটা গল্প এখানে বলবো।
২.
আইনস্টাইনের এই কাহিনীটা প্রায় সবাই শুনেছেন। গল্পটা হলো এরকম:
“আইনস্টাইন শিক্ষাগত জীবনে বিদ্রোহী ছাত্র ছিলেন। গতানুগতিক পড়াশুনা তাঁর ভালো লাগতো না। ফলে পরীক্ষায় খারাপ নাম্বার পেতেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা শেষ হয়ে গেলো। কিন্তু তখনকার শিক্ষায়তন তার প্রতিভা উপেক্ষা করে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দিতে অস্বীকার করে। ফলে বেকার আইনস্টাইন অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা সর্বস্বান্ত হয়ে প্যাটেন্ট অফিসে ক্লার্ক হিসেবে নিচু পদের চাকরীতে যোগ দেন।
তবে এ চাকরী তার জন্য হিতে–বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। গতানুগতিক জ্ঞানচর্চার গন্ডী থেকে মুক্ত হয়ে তিনি সাহসী, মৌলিক চিন্তাভাবনা করার সুযোগ পান। পরবর্তীতে এ চিন্তাভাবনা তাবৎ পৃথিবীর পদার্থবিজ্ঞানকে বদলে দেয়।“
তবে বাস্তবতা এর চেয়ে জটিল ছিলো।
আইনস্টাইন বিদ্রোহী ছাত্র ছিলেন। কিন্তু তিনি স্কুলে ও এন্ট্রান্স পরীক্ষায় গণিত ও পদার্থবিদ্যায় সব সময়েই উচ্চ নাম্বার পেতেন। কলেজের পর আইনস্টাইনকে বেশ কষ্ট করতে হয়েছিলো। তবে অধ্যাপনার আবেদন করায় তাকে সেখানে নেয়া হয় নি – ঘটনা এমন নয়। তিনি গ্রাজুয়েশনের পর বিশ্ববিদ্যালয়–সহযোগী (ইউনিভার্সিটি এসিস্টেন্টশিপ) দায়িত্ব আবেদন করেছিলেন, পান নি। ইউনিভার্সিটি এসিস্টেন্টশিপ মূলতঃ গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীর ডক্টরাল গবেষণা চালানোর সময় জীবিকা নির্বাহের আর্থিক উৎস হিসেবে কাজ করে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে গ্রাজুয়েট শিক্ষার ক্ষেত্রে যাকে বলা হয় গবেষণা সহযোগী বা রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট।
এমন না আইনস্টাইনের প্রতিভা অগ্রাহ্য করা হয়েছিলো। বরং আইনস্টাইন “অসামান্য প্রতিভার ছাপ” রাখার মতো কোন কাজই তখনো করেন নি – তাঁর কর্মজীবনের মাত্র শুরু তখন। গ্রাজুয়েশনের পর কৌশিক প্রক্রিয়া (ক্যাপিলারি অ্যাকশন) নিয়ে তিনি যে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন সেটাও ছিলো মাঝামাঝি মানের। বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগী হিসেবে কাজ না পাওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিলো একজন অধ্যাপকের নেতিবাচক সুপারিশ; যিনি আবার আইনস্টাইনকে পছন্দ করতেন না।
আর উপরের গল্পে যে কথা অনুপস্থিত তা হলো প্যাটেন্ট অফিসের ক্লার্ক থাকা অবস্থাতেও আইনস্টাইন তার ডক্টরাল ডিগ্রির জন্য গবেষণা–কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর একজন উপদেষ্টাও ছিলেন। ডক্টরাল–উপদেষ্টার সাথে আইনস্টাইন নিয়মিত একটি পাঠচক্রে দেখা করতেন, লেখালেখিও করতেন একে অপরকে (ছবি দ্রষ্টব্য)।
যে বছর আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতার তত্ত্বটি প্রকাশ করেন (১৯০৫), একই বছরেও তিনি অভিসন্ধর্ভ (থিসিস/ ডিসার্টেশন) জমা দেন ও PhD ডিগ্রী পেয়ে যান। এর পরেই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার জন্য সুযোগ পেয়ে যান ও তাঁর একাডেমিক কর্মজীবন শুরু হয়। অন্যভাবে বলা যায়, আইনস্টাইনকে পিএইচডি গবেষণা চালানোর পাশাপাশি একটা চাকরী করতে হতো জীবিকা নির্বাহের জন্য। পিএইচডি গবেষণার পাশাপাশি চাকরী করা খুবই ঝামেলার একটা ব্যপার ও গবেষকের জন্য দূর্ভাগ্যজনক। তবুও আইনস্টাইনের স্নাতক পড়াশুনা থেকে শুরু করে অধ্যাপনার কাজে নিয়োগ হওয়ার সময়টা মোটামুটি রীতিমাফিক পথ ও প্রতিষ্ঠিত সময়সীমা ধরেই চলেছে।
৩.
এই গল্প বলার পেছনে কারণ হলো এখান থেকে আমাদের একটা (বদ)অভ্যাস ধরা পড়ে: আমরা উদ্ভাবক/আবিষ্কারকদের আগুন্তক হিসেবে দেখতে ভালোবাসি। আগুন্তক, কারণ তারা প্রথাকেন্দ্রীক প্রতিষ্ঠানের বাঁধন ছিড়ে মুক্ত মানুষ হিসেবে আবির্ভূত হন, পৃথিবীকে বদলে দেন। আগুন্তক, কারণ তাঁরা প্রচলিত নিয়ম ভাঙেন, নতুন কিছু তৈরি করেন অনেকটা হঠাৎ করেই। তবে বাস্তবতা হলো বৈপ্লবিক আবিষ্কার বা ভিন্ন ধর্মী কাজ করতে হলে এর আগে রীতিমাফিক প্রশিক্ষণ বা তালিমের দীর্ঘ সময় পরিশ্রম করে আসতে হয়।
আইনস্টাইন মেধাবী ও মৌলিক চিন্তার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ গ্রাজুয়েট শিক্ষা সম্পূর্ণ করার আগ পর্যন্ত তিনি যথেষ্ট পদার্থবিজ্ঞান জানতেন না; পদার্থবিজ্ঞানকে সামনে এগিয়ে নেয়া ছিলো আরো পরের ব্যাপার। অন্যান্য অাবিষ্কারকদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। স্টিভ জবস প্রথমে অ্যাপল কোম্পানী প্রতিষ্ঠা করে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন, দশ বছর অন্যান্য ব্যবসা করে আবার অ্যাপলে ফিরে আসেন। দ্বিতীয়বার অ্যাপলে ফিরে আসা ছিলো তার ভাগ্য ঘুরিয়ে দেয়ার ঘটনা – এর পর থেকে তিনি সাফল্যের সিড়ি বেয়ে তরতর করে উঠতে থাকেন। কারণ মধ্যখানের দশ বছর তিনি কঠিন সময় পার করেছেন ব্যবসা বিষয়ে ওস্তাদ হতে, দরকারী বিভিন্ন দক্ষতা শানিয়ে নিতে। এ দীর্ঘ সময় রূঢ় বাস্তবতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেকে তৈরি করার পরেই কেবল অ্যাপল–২ তে তাঁর মেধা প্রযুক্তির বাজার বদলে দেয়ার একটি ক্ষেত্র পায়।
আইনস্টাইন প্রথমেই বিপ্লবী বিজ্ঞানী হিসেবে আর্বির্ভূত হন নি। তাঁকে নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়েছে, স্নাতকের পর পিএইচডি করতে হয়েছে প্রচলিত রীতি অনুসারে। যে কোন যুগান্তকারী আবিষ্কার সম্পর্কে এটা তিক্ত সত্য। আমরা যদি অন্যান্যদের পৃথিবী বদলানোর জন্য উৎসাহিত করতে চাই, প্রথমে তাদেরকে ভেতর থেকে ভিত শক্ত করার জন্য কাজ করতে উৎসাহিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচাইতে কৌশলের জায়গা হলো প্রাতিষ্ঠানিক প্রথা, রীতি বা ঐতিহ্যমতো প্রশিক্ষণ বা তালিম নিয়ে দক্ষ হওয়ার পাশাপাশি নিজের মধ্যে ভিন্ন ভাবে ভাবার স্ফুলিঙ্গ বাঁচিয়ে রাখা। নতুন কিছু করা, নতুন ভাবে চারপাশকে দেখার ইচ্ছেটা একটি দীর্ঘ সময় ধরে জিঁইয়ে রাখা – যতক্ষন না সেই ভিন–ধারার কাজটি করার জন্য “যথেষ্ট–ভালো” একটি পর্যায়ে যাওয়া না যায়। কবীর সুমনের গানের কলি মনে পড়ে:
বন্ধু তোমার ভালোবাসার স্বপ্নটাকে রেখো,
বেঁচে নেবার স্বপ্নটাকে জাপটে ধরে থেকো,
দিনবদলের স্বপ্নটাকে হারিয়ে ফেলো না,
পালটে দেবার স্বপ্ন আমার এখনো গেলো না,
… হাল ছেড়ো না …
Leave a Reply