সাম্প্রতিক জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এবং সম্ভাব্য বিপদ

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

এবোলা ভাইরাসের বাতাস ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন এক ভাইরাসের আবির্ভাব, জিকা ভাইরাস (ZIKV)। নতুন করে আবির্ভাব ঠিক নয় বরং প্রাদুর্ভাব বেড়েছে হটাৎ করেই। সাম্প্রতিক সময়ে এই ভাইরাস আলোচনার শীর্ষে কারন জিকা ভাইরাস আক্রমনের এক ভয়ঙ্কর দিক উন্মোচিত হয়েছে। সর্বপ্রথম ১৯৪৭ সালে উগান্ডায় অবস্থিত জিকা বনে রেসাস বানরদের মধ্যে এই ভাইরাস দেখা যায় (বনের নামেই নামকরণ)। এই সূত্রধরে কয়েক বছর বাদে ১৯৫২ সালে উগান্ডার মানুষের মধ্যেও এটি ধরা পড়ে। এরপর বিভিন্ন সময় এটাকে আফ্রিকা, আমেরিকা এবং এশিয়াতে দেখা যায় কিন্তু ততটা বিপজ্জনক নয় বলে অতটা ভাবা হয়নি। হঠাত করেই ২০১৪ সালের দিকে এটা প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে ফ্রেঞ্চ পলিনেশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকেই পরবর্তিতে ইস্টার আইল্যান্ড এবং ২০১৫ সালে মেক্সিকোসহ আমেরিকার বিভিন্নাঞ্চলে প্যান্ডেমিক আকার ধারন করে। অতি সম্প্রতি (মে ২০১৫) ব্রাজিলে এর প্রাদুর্ভাব প্রচন্ড আকার লাভ করেছে। ধারণা করা হচ্ছে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার থেকে ১৩ লক্ষ মানুষ।

চিত্রঃ জিকা ভাইরাসের বাহক এডিস মশা, A. aegypti

জিকা ভাইরাস ফ্লাভিভাইরাস (Flavivirus) গনের অন্তর্ভুক্ত একপ্রকার একসূত্রক আরএনএ (ssRNA) ভাইরাস। যতদূর জানা গেছে, জিকা ভাইরাসের জিনোমে প্রায় ১১ হাজার (১০৭৯৪) বেজ থাকে, যা একটি বৃহৎ পলিপ্রোটিন তৈরি করে। এই পলিপ্রোটিন পরবর্তিতে কয়েকটি ক্ষুদ্র প্রোটিনে ভেঙে যায়। একেকটা ক্ষুদ্র প্রোটিন ভাইরাসের বিভিন্ন অংশ গঠন করে, যেমনঃ ভাইরাসের আভ্যন্তরীণ খোলক (Capsid), ভাইরাল পর্দা (Membrane), বহিঃখোলক (Envelop) ইত্যাদি। এদের মধ্যে কিছু প্রোটিন থাকে যারা এসব গাঠনিক কাজে অংশ নেয়না যাদের বলা হয়, নন-স্ট্রাকচারাল (Non-Structural) প্রোটিন। এই নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিনগুলোই সম্ভবত ভিলেন হিসেবে কাজ করে।

চিত্রঃ জিকা ভাইরাসের গঠন

চিত্রঃ ভাইরাল পলিপ্রোটিন এবং এর ভাঙনে উৎপন্ন বিভিন্ন প্রোটিন

প্রাকৃতিকভাবে এডিস (Aedes) মশার (ডেঙ্গুর বাহক) কয়েকটা প্রজাতি (A. africanus, A. aegypti, A. vitattus) এই ভাইরাসের বাহক বা পোষক হিসাবে কাজ করে। এরা সাধারণত দিনের বেলায় কামড়ে থাকে এবং কামড়ের মাধ্যমে মানবদেহে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটায়। জিকা ভাইরাস আক্রান্ত রোগীকে কামড়ের মাধ্যমে মশাও ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনার মধ্য দিয়ে দেখা যাচ্ছে জিকা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের সাথে রক্ত আদান-প্রদান ও যৌনমিলনের মাধ্যমেও ছড়াতে পারে। তবে মাতৃদুগ্ধ পানের ক্ষেত্রে এমন প্রমান এখনো মেলেনি।

জিকা ভাইরাস মানবদেহে জিকা জ্বর সৃষ্টি করে। জিকা জ্বর অনেকটা ডেঙ্গুর মত তবে তেমন মারাত্মক নয়। জিকা ভাইরাসের সুপ্তাবস্থা এখনো জানা যায়নি তবে ধরনা করা হচ্ছে মশা কামড়ানো কয়েক দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশিত হয়। জিকা ভাইরাসের আক্রমনে শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যায়, চামড়ায় লাল ফুসকুড়ি, অস্থি সন্ধিতে ব্যাথাসহ চোখ লাল হয়ে যেতে পারে। এই অবস্থা মোটামুটি এক সপ্তাহ স্থায়ী হয়-তারপর এমনি ঠিক হয়ে যায়। জিকা জ্বরের প্রভাব গুরুত্বর না হওয়ায় বিশেষ কোন চিকিৎসার দরকার নাই। জিকা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথম চিকিৎসা প্রচুর পানি খেতে হবে এবং বিশ্রাম নিতে হবে। লক্ষন অনুযায়ী কিছু ওষুধ যেমন প্যারাসিটামল (Acetaminophen) খাওয়া যেতে পারে। জিকা জ্বরের পাশাপাশি ব্রাজিলে অনেক জিকা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের মধ্যে গিলেন-বার সিন্ড্রোম (Guillain-barre Syndrome) লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জিকা ভাইরাস এবং গিলেন-বার সিন্ড্রোমের মধ্যে কোন সম্পর্ক আছে কিনা সেজন্যে সিডিসি (CDC) এবং ব্রাজিলের স্বাস্থ্য মন্ত্রানালয় বর্তমানে একসাথে কাজ করছে। এমনটা হলে অবশ্য ভাববার অনেক কারন আছে। গিলেন-বার সিন্ড্রোম মুলত মানবদেহকে নিউরন কোষের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যাবস্থা (Immune) করে তোলে।

জিকা ভাইরাস এমনিতে ততটা ভয়ংকর নাহলেও, গর্ভাবস্থায় কেউ এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে এটি ভ্রুনের মস্তিষ্ক বিকাশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে। জিকা ভাইরাস রক্তের মাধ্যমে মায়ের শরীর থেকে ভ্রুনদেহে প্রবাহিত হতে পারে। সম্প্রতি বাজিলে দেখা গেছে এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক ছোট আকারের মাথা নিয়ে জন্মায়, যেটাকে ডাক্তারি ভাষায় বলে মাইক্রোসেফালি (Microcephaly)। এই রোগে আক্রান্ত শিশুর মস্তিষ্ক পুর্নতা লাভ করেনা এবং জন্মের পর মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধিও হয়না। ফলে এরা বুদ্ধি-প্রতিবন্ধি হয়ে জন্মায় এবং অনেকক্ষেত্রে জন্মের পরপরই মারা যায়। ব্রাজিলে ২০১৫ সালের শেষঅব্দি প্রায় ৩০০০ এর বেশি শিশু মাইক্রোসেফালি রোগাক্রান্ত হয়ে জন্মেছে। ফলে এটা নিয়ে ভাবা অতীব জরুরী হয়ে পড়েছে এখন। গত ৫ ফেব্রুয়ারিতে সিডিসি মাইক্রোসেফালি রোগাক্রান্ত চারটা সদ্য ভুমিষ্ট (দুটি জীবিত এবং দুটি মৃত) শিশুর উপর পরিক্ষা চালিয়ে তাদের মস্তিষ্কে জিকা ভাইরাস পেয়েছে এবং ভাইরাসগুলোর জেনেটিক এনালাইসিস ঐ এলাকা থেকে সংগৃহীত নমুনা ভাইরাসের সাথে ৯৯.৭% ম্যাচ করে। এই ফলাফল মাইক্রোসেফালির সাথে জিকা ভাইরাসের সম্পৃক্ততা নির্দেশ করে। মাইক্রোসেফালি রোগের সাথে জিকা ভাইরাসের সম্পৃক্ততা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত হলেও এটা ঠিক কিভাবে কাজ করে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। সম্প্রতি জিকা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স করা হয়েছে, এখন সম্ভবত জিনের ফাংশনাল এনালাইসিস করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, নন-স্টাকচারাল প্রোটিন-১ এ ঘটা কোন মিউটেশন বা পরিবর্তন রোগ ছড়ানোর সাথে জড়িত। তবে জিকা ভাইরাস জন্মগত ত্রুটি সৃষ্টি করতে পারে এটা অবিশ্বাস্য কারন ফ্লাভিভাইরাসের ইতিহাসে এটাই প্রথম। আসলে সবই মিউটেশন এবং বিবর্তনের খেলা যা সবকিছু বদলে দিতে পারে মুহুর্তেই।

যদিও বাংলাদেশ জিকা থেকে এখনো মুক্ত তবু কিছু সতর্কতা না দিলেই নয়। জিকা ভাইরাস থেকে বাচার উপায়, জিকা ভাইরাস আক্রান্ত এলাকা থেকে দূরে থাকা, বাড়ির আশেপাশে মশা জন্মাতে পারে এমন অবস্থা দূর করা। আর কোনোক্রমে ভাইরাস যদি গায়ে চড়েই বসে তাহলে চিন্তা না করে চুপচাপ বিশ্রাম নিন-আরাম করুন, প্রচুর পানি পান করুন-জুস খান। রক্ত নেওয়ার আগে পরিক্ষা করে নিন এবং মিলনের ক্ষেত্রে অবশ্যই নিরাপদ কোন পন্থা খুজে নিন। কারণ এখনো পর্যন্ত এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোন প্রতিষেধক বা ভ্যাক্সিন দাড় করানো যায়নি তবে গবেষনা চলছে। বিশেষ করে আমেরিকার ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ এলার্জি এন্ড ইনফেকশাস ডিজিজ (NIAID) এবং ভারতের কোম্পানি, ভারত বায়োটেক ইন্টারন্যাশনাল জিকা ভাইরাসের ভ্যাক্সিন তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তাদের মতে এ মাসেই হয়তো কোন প্রাণীর উপর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে পারবে। তবে সেন্টার ফর বায়োডিফেন্স এন্ড ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজ (CBEID) এর পক্ষ থেকে নিকস ভ্যাসিলাকিস বলেন ভ্যাক্সিন তৈরি হয়তো আগামী ২ বছরে সম্ভব হবে কিন্তু জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য প্রতিষেধক পেতে এখনো ১০-১২ বছর লেগে যেতে পারে।


তথ্যসুত্রঃ

http://www.cdc.gov/zika/disease-qa.html

http://global.european-virus-archive.com/evag-news/zika-virus

http://viralzone.expasy.org/all_by_species/6756.html

http://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4047448/pdf/e00500-14.pdf

Zika Virus Genome Sequence Published by the Institut Pasteur

http://www.who.int/mediacentre/factsheets/zika/en/

https://en.wikipedia.org/wiki/Zika_virus

লেখাটি 138-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. সময়োপযোগী লেখা। জিকা ভাইরাস সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য এসেছে।

    1. ধন্যবাদ ভাই 🙂 তবে জিনোমিক লেভেলে তথ্য এখনো বেশ অপ্রতুল।

  2. ভাই অনেক সুন্দর লেখা আসলেই অনেক কিছু জানলাম এই লেখা দিয়ে। আপনার একটা বানান এ একটু ঠিক করে নিবেন। ৫ নম্বর অনুচ্ছেদে ব্রাজি-টা ঠিক আছে কি না। দেখবেন। ওটা আমারো ভুল হতে পারে। ধন্যবাদ।

    vai onek sundor lekha asolei onek kisu janlam apnr ei lekha deye.

    apnar ekta banan e ektu thik kore niben 5no onucched e brazi. ta ki thik ase ki na ? dekhben . oita amar vul o hoite pare
    dhonnobad

    1. ধন্যবাদ আপনাকেও 🙂 আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না আপনি কোন ভুলটার কথা বলছেন, দয়া করে যদি লাইনটা কোট করে দিতেন তাহলে বুঝতে সুবিধে হতো। আবারো ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

  3. সময় উপযোগী ও বিস্তারিত লেখা উপহার দেবার জন্য ধন্যবাদ। একটু একটু তো ভয় পাচ্ছিলাম, জিকায় নাকি আবার জেকে বসে! এই লেখাটা পরে সংসয় দূর হলো। [ভাইয়া আপনার আসল পরিচয়টা জানতে পারি? 🙂 ]

    1. আপনাকেও ধন্যবাদ 🙂 আসলে জিকা খুব ভয়ংকর নয় কিন্তু মাইক্রোসেফালি রোগটা সত্যি ভয় পাওয়ার মত রোগ। পরিচয় ফেইসবুকে পেয়ে যাবেন। 🙂

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 910 other subscribers