অতিকায় ভাইরাসের গল্প

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হলেও তামাক একটি অর্থকরী ফসল। এই ফসল যদি এমন কোন রোগে আক্রান্ত হয় যার ফলে কৃষকেরা চাষ করাই ছেড়ে দিচ্ছেন, তাহলে তামাক উৎপাদনকারী একটি দেশের জন্য চিন্তার উদ্রেক হওয়া দোষের কিছু না। ১৮৭৯ সালে নেদার্ল্যান্ডের এগ্রিকালচারাল এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশনের ডিরেক্টর এডলফ মেয়ারের নজরে আনা হয় এমন এক অদ্ভুত রোগ “টোবাকো মোজাইক ডিজিজ”। তিনি বহুদিন এটা নিয়ে কাজ করলেন, কিন্তু কিসের জন্য যে এই রোগটা হচ্ছে সেটা ঠিক বের করতে পারলেননা। তিনি বললেন যে, আক্রান্ত গাছের রস ফিল্টার পেপারের মাধ্যমে পরিশোধিত করা হলে প্রাথমিক ভাবে সংক্রামক থাকলেও বেশ কয়েকবার ফিল্টার করার পর করার রসটা আর সংক্রমক থাকছেনা সুতরাং কোন অজানা ব্যাক্টেরিয়ার কারনে এই রোগ হচ্ছে।

১৮৯২ সালের দিকে রাশিয়ান উদ্ভিদ বিজ্ঞানী দিমিত্রি আইভানভস্কি ওই একই রোগে আক্রন্ত গাছের রস ওই একই তরিকায় পরিশোধিত করেন, শুধু মাধ্যমটা ভিন্ন। তিনি ব্যাবহার করেন প্রলেপবিহীন পোরসেলিন ফিল্টার যার পোর সাইজ ০।১ থেকে ১ মাইক্রন। কিন্তু তাতেও লাভ হলোনা, ঠিকই সেই রস সংক্রামক রয়ে গেলো। তিনি বললেন যে, এটা ব্যাক্টেরিয়া নয়। বরং তার চেয়েও অনেক ছোট কিছু এই রোগের জন্য দায়ী। পরবর্তীতে যা ভাইরাস হিসেবে শনাক্ত হয়। হ্যা, এবং সেই ভাইরাসের নাম “টোবাকো মোজাইক ভাইরাস”। ভাইরাস তো আবিষ্কার হলো, সেই সাথে একে খুঁজে পেতে যে কাঠখড়টা পুরলো। সে কারনে সবাই ধরেই নিলো ভাইরাসের আকৃতি হবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র। এই প্রচলিত ধারনার কারনেই হয়তো অনেকদিন অন্য আরেকটি জগৎ আমাদের চোখের সামনে থেকেও অদৃশ্য ছিলো।

আইভানভস্কির এক্সপেরিমেন্টের একশ বছর পর ১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ডের একটি হাসপাতালে নিউমোনিয়া প্রাদুর্ভাব দেখা গেলো। এর উৎস খুঁজতে খুঁজতেই কাছের পানির টাওয়ার থেকে পাওয়া একটি অ্যামিবার ভেতরে দেখা গেলো নতুন একটি গ্রাম পজিটিভ অস্তিত্ব। তাৎক্ষনিক ভাবে একে কোন বর্গীভূত না করা হলেও পরবর্তীতে ব্র্যাডফোর্ডকক্কাস ব্যাক্টেরিয়া নাম দিয়ে ফ্রীজে ঢুকিয়ে ভুলে যাওয়া হয়। ১৯৯৮ সালে বার্নার্ড লা স্কোলা নামী এক ফ্রেঞ্চ বিজ্ঞানী ব্র্যাডফোর্ডকক্কাসের মধ্যে দেখতে পেলেন এক অদ্ভুত বিষয়। এর মধ্যে কোন রাইবোজোম নেই! রাইবোজোম হচ্ছে যেকোন কোষের প্রোটিন তৈরির কারখানা। এই ঘটনা ব্র্যাডফোর্ডকক্কাসের চরিত্র সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক ঘটালে আরেকদল বিজ্ঞানীর পর্যবেক্ষনে ধরা পড়ে এরা অন্য সকল ব্যাক্টেরিয়ার মত বিভাজনের মাধ্যমে সংখ্যাবৃদ্ধিও করেনা। এর মাধ্যমেই এই নকুলে ভাইরাস সম্পর্কে সব রহস্যের অবসান নয়, বরং সূচনা হলো। যাকে এখন আমরা ‘মিমিভাইরাস’ বলে চিনি। যেহেতু এরা গ্রাম স্টেইনিং পরীক্ষায় গ্রাম পজিটিভ ব্যাক্টেরিয়াকে অনুকরন(Mimic)করে সেজন্যই এই নাম। অনুজীব নিয়ে যদি আপনার পড়াশোনা এবং আগ্রহ দুটোই থেকে থাকে আর এমন যদি হয় যে মিমিভাইরাস সম্পর্কে আজই প্রথম শুনছেন তাহলে “গ্রাম পজিটিভ ভাইরাস” শুনেই আপনার মুখ হা হয়ে যাওয়ার কথা। যদি তা-ই হয়ে, তাহলে আপনাকে চেয়ার থেকে ফেলে দেয়ার মত দুটো তথ্য দিয়ে আমোদিত করতে চাই। মিমিভাইরাসের দৈর্ঘ্যে প্রায় ৪০০ ন্যানোমিটার, এবং জিনের সংখ্যা ১০১৮ টি! যেখানে তারই বন্ধু এইচআইভি এর জিন মাত্র ৯ টি।

Giant viruses may just be small viruses that stole hosts' genes | New  Scientist
চিত্রঃ বিভিন্ন অতিকায় ভাইরাসের সাথে এইচআইভি এবং ব্যাক্টেরিয়ার তুলনা

ফ্রান্সের এক্সিস-মার্সিয়েলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা মিমিভাইরাস শনাক্ত করার পর এরকম বড় বড় ভাইরাস খুঁজতে শুরু করেন। দিদিয়ার রাউল্ট নামের একজন গবেষক খুঁজতে থাকেন সবচাইতে সম্ভাব্য জায়গাগুলো অর্থাৎ অন্যন্য পানির টাওয়ার। এবং তিনি প্যারিসে যেন স্বর্নের খনি পেলেন। তিনি যে ভাইরাসটি পেয়েছিলেন তার নাম দেয়া হয় ‘মামাভাইরাস’। তবে চিত্তাকর্ষক ব্যাপার, তার ভেতরে যেটা পাওয়া গেলো, একটি ‘স্পুটনিক ভাইরোফাজ’। প্রথম বারের মত দেখা গেলো একটি ভাইরাস অন্য আরেকটি ভাইরাসকে আক্রান্ত করছে। এই ঘটনা ভাইরাস জ্যান্ত না মৃত সেই পুরনো বিতর্ক আবারো উষ্কে দিলো, যেহেতু মামাভাইরাস অন্য ভাইরাসের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হচ্ছে। ২০১০ সালে রাউল্ট নদী, হ্রদ, ট্যাপ সহ বিভিন্ন জায়গার পানির মধ্যে পাওয়া নতুন ১৯ টি নমুনা সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করেন। এর পরের বছর রাউল্টের আরেক সহকর্মী জ্যাঁ-মাইকেল ক্ল্যাভেরি পেলেন আরো বড় আকৃতির ভাইরাস। চিলির সমুদ্রের তলদেশ থেকে পাওয়া এই ভাইরাসের নাম দেন মেগাভাইরাস। এরপর চিলির নদী এবং অস্ট্রেলিয়ার একটি পুকুরের কাদা থেকে তিনি শনাক্ত করেন প্যান্ডোরাভাইরাসের দুটো প্রকরন। যার একটিতে রয়েছে ১৫০০ জিন এবং অন্যটিতে প্রায় ২৫৫০। এরপরই ক্ল্যাভেরি সম্ভবত সবচেয়ে চমকপ্রদ আবিষ্কারটি করেন। ৩০,০০০ বছর পুরনো বরফের টুকরার মর্মস্থল থেকে শনাক্ত করেন দর্শনীয় পিথোভাইরাস। এটি লম্বায় প্রায় দেঢ় মাইক্রোমিটার, যা সবার পরিচিত একটি ব্যাক্টেরিয়া E. coli এর কাছাকাছি। এর অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে মেমব্রেনের গায়ের একটি ফুটো, যা কর্ক এর মত একটি জিনিস দ্বারা আটকানো থাকে। ক্ল্যাভেরির ভাষ্যমতে “এখন আমরা বলতেই পারি যে অতিকায় ভাইরাসেরা সর্বত্রই ছড়ানো। আমরা যদি সঠিক পদ্ধতিতে দেখি তবে আমি নিশ্চিত আপনার বাগানেও এদের পাওয়া যেতে পারে।”

যে প্রশ্নটি বিজ্ঞানীদের বিব্রত করে আসছে তা হলোঃ অতিকায় ভাইরাসগুলো কোথা থেকে এসেছে এবং জীবনের প্রতিষ্টিত শ্রেণিবিন্যাসের কোন স্তরে এদের ফেলা যায়? গোড়ার দিকে এই শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতির দুই শাখা(ডোমেইন), আদিকোষী এবং প্রকৃতকোষী। প্রকৃতকোষীর মধ্য রয়েছে সব প্রাণী ও গাছপালা। আদিকোষীর দুইভাগের একটি হচ্ছে ব্যাক্টেরিয়া, অন্যটি আর্কিয়া। ব্যাক্টেরিয়ার কোষগুলো প্রাণী কিংবা উদ্ভিদের চেয়ে সরল এবং নিউক্লিয়াস থাকেনা। আর্কিয়া ব্যাক্টেরিয়ার মত হলেও এদের রসায়নটা ভিন্ন। এই তিন মৌলিক শ্রেণীবিন্যাসের মাধ্যমে সব ধরনের জীবসত্বাকে জায়গা দিতে পারার কথা। কিন্তু আপনি যদি এই অতিকায় ভাইরাসগুলোর জিনের দিকে তাকান, তাদের ৫০ থেকে ৯০ শতাংশ জিনই আর কোথাও দেখা যায়নি। এমনকি অতিকায় ভাইরাসের একেকটি গোত্রের মধ্যেও খুব বেশি সাধারন জিন নেই। কেউ কেউ বলে থাকেন এই অতিকায় ভাইরাসগুলো কিছু বিলুপ্ত ডোমেইনের অবশেষ। তাই এদেরকে শ্রেণিবিন্যাসের যদি জায়গা দিতেই হয়, তাহলে একাধিক ডোমেইনকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ক্ল্যাভেরির ভাষায় “মিমিভাইরাসের সন্ধান পাওয়ার পরই আমরা বলেছিলাম যে চতুর্থ একটি ডোমেইন সৃষ্টি করতে হবে। কিন্তু এখন বিশ্বাস করি এটা শুধু চতুর্থ নয় বরং পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম।” ২০১২ সালে ইউনিভার্সিটি অব ইলিনিয়ের একদল বিজ্ঞানী বিভিন্ন ভাইরাস এবং অন্যান্য যেসব কোষের একই ধরনের প্রোটিন রয়েছে তাদের নিয়ে একটি বিবর্তনিক বৃক্ষ(Evolutionary Tree) তৈরি করেন যেটা থেকে অনুমান করা যায় অতিকায় ভাইরাসগুলো অন্য সব কিছু থেকেও প্রাচীন যা, একদিক দিয়ে ক্ল্যাভেরির ধারনাকেই শক্তিশালী করে। ক্ল্যাভেরির সমালোচকরা বলেন, সব ভাইরাসই হচ্ছে মিউটেশনের রাজা। তাই একটি জিনকে যদি চিনতে না পারেন, তাহলে সেটা এমনও হতে পারে যে একটি পরিচিত জিনই উপর্যুপরি মিউটেশনের জন্য এমন অবস্থায় এসেছে যে তাকে আর আলাদা করা যাচ্ছেনা। তবে এটাও যৌক্তিক যে একটা অনুজীব পরজীবি জীবনধারায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে তার জিনোম ক্রমাগত ছোট হবার কথা, যেহেতু সে পোষকের যন্ত্রপাতিই ব্যবহার করছে তার মৌলিক কার্যকলাপের জন্য। তাই এর থেকেও বলা যায় যে অতিকায় ভাইরাসগুলো আমাদের অন্যান্য পরিচিত ভাইরাসের তুলনায় প্রাচীন।

Frontiers | A Place for Viruses on the Tree of Life | Microbiology
চিত্রঃ অনুজীবের বিবর্তনিক বৃক্ষ

অতিকায় ভাইরাসদের আবিষ্কার বিজ্ঞানীদের জীবনের সংগা সম্পর্কে ভাবাচ্ছে। তারা বলছেন, ভাইরাসকে বিচার করতে চাইলে তার নিষ্ক্রিয় অবস্থায় নয় বরং সে পোষকের জিনোমের সাথে একীভুত হওয়া অবস্থায় কিভাবে আছে সেটার ভিত্তিতে করা উচিত। এই অবস্থায় সে একটি পরজীবি ব্যাক্টেরিয়ার মত আচরন করে প্রায়। অবশ্য একে জীবিত বলার জন্য জন্য আমাদের চিন্তাধারাকে আরো প্রশস্ত করতে হবে। শুধু চলৎক্ষম রাইবোজোম বাহক কোষকেই জীবিত বলতে হবে, এটা খুবই কায়েমী মনোভাব। আমরা বরং জীবনকে দুটো ভাগে ভাগ করতে পারি, রাইবোজোম থাকলে রাইবোসেল এবং ভাইরাস চালিত ভাইরোসেল। তবে এটা পরিষ্কার যে জীবন এবং ভাইরাসের মধ্যেকার দেয়ালটা বেশ ঝাপসা। ভাইরাস নাকি কোষ? কে জীবন্ত কে মৃত এই প্রশ্নে মাথা খারাপ করে দিলেও কিছু করার নেই। এখন পর্যন্ত অতিকায় ভাইরাসের অনুসন্ধান শুধু অ্যামিবার মধ্যেই চলত, কারন মূলত এরা একটি জানা পোষক এবং ল্যাবে এদের নিয়ে কাজ করাও সহজ। তার মানে এখনো বহু বহু পোষক প্রকটিত করা বাকী। যা ক্ল্যাভেরির মত বিজ্ঞানীর জন্য একইসাথে ভীতিকর এবং রোমাঞ্চকর। তার নিজের ভাষায়”We don’t know what a virus is any more – or what to expect next.”

তথ্যসূত্রঃ

  1. Infect and Direct, Gary Hamilton, New Scientist Magazine, Januyary 15, 2016.

  2. A phylogenomic data-driven exploration of viral origins and evolution, Arshan Nasir, Gustavo Caetano-Anollés, Science Advances, September 25, 2015.

লেখাটি 256-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Responses

  1. লেখাটা আগেই পড়েছিলাম। চমৎকার ছিল। জীববিজ্ঞানের এরকম লেখাগুলো পড়তে খুব ভালো লাগে। 🙂

  2. খুবই মজার লেখা। বিষয়টাও চিত্তাকর্ষক। নামগুলো মজার, মিমি, মামা, মেগা! যে জীবনবৃক্ষের ছবিটা দেখা যাচ্ছে, সেটা কিসের ভিত্তিতে করা হলো? সব ভাইরাস তো একই ধরনের জিন বহন করে না।

    1. ধন্যবাদ ভাইয়া। আর জীবনবৃক্ষটা দৈবচয়নে নেয়া ৩৬৮ টা শ্রেণীর মধ্যে ৪৪২ টা প্রোটিন সুপারফ্যামিলির উপস্থিতি ও প্রাচুর্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে।

  3. গ্রাম স্টেইনিং পদ্ধতির বর্ণনা জানাতে পারলে খুশি হব।

    1. এটা খুব সহজ একটা প্রক্রিয়া, স্লাইডে স্যাম্পল নিয়ে তাতে প্রথমে ক্রিস্টাল ভায়োলেট দ্রবণ, এবং এর পরে আয়োডিনের দ্রবণ যোগ করা হয়। এরপরে অ্যালকোহল দিয়ে ধুয়ে ফেলার পর গ্রাম পজিটিভ হলে রং থেকে যায়, গ্রাম নেগেটিভ হলে রং চলে যায়।

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading