সাধারণত যখন কোনো নতুন কণা আবিষ্কৃত হয় বা কণার অস্তিত্ব অনুমান করা হয়, সে কণাটি এত ক্ষুদ্র বিবেচনা করা হয় যে আকার কল্পনা করাই দুষ্কর হয়ে থাকে। সর্বশেষ গবেষণা ডার্ক ম্যাটারের সাথে কণার আকারের ধারণা বদলে দিয়েছে। গবেষকরা প্রস্তাব(hypothesis) করেছেন যে, ডার্ক ম্যাটার যে কণা দিয়ে তৈরি তা মানবকোষের এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ ভরের হতে পারে। আর একই সাথে যথেষ্ট ঘন যেন ছোট ব্ল্যাক হোল তৈরী হয়ে যায়। উল্লেখ্য, ডার্ক ম্যাটার আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু স্পষ্টত এর প্রমাণ রয়ে গেছে প্রকৃতিতে।
যদিও ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের মোট পদার্থের প্রায় পাঁচ-ষষ্ঠাংশ তবুও সত্যিকার অর্থেই আমরা জানি না ডার্ক ম্যাটার কী? কী দিয়ে তৈরি? দেখতেই বা কেমন আর কিভাবে কাজ করে? পুরো বিষয়টা অন্ধকারে বলেই নাম ডার্ক ম্যাটার। এমন রহস্যজনক বৈশিষ্ট্য সত্ত্বেও বিজ্ঞানীরা এটা নিসচিত হয়েছেন যে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব আছে। কারণ, আমরা যে ভরটুকু পর্যবেক্ষণ করতে পারি মহাবিশ্ব আসলে ঐটুকু ভর দিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করে না। দৃশ্যমান পদার্থ দিয়ে হিসেব করলে গ্যালাক্সির পরিধির দিকে থাকা নক্ষত্রের যে পরিভ্রমণ বেগ পাওয়ার কথা, আদতে পর্যবেক্ষণে উপাত্ত পাওয়া যায় আরো বড়। অর্থাৎ বাড়তি মহাকর্ষের আঁচ, আর মহাকর্ষ হল ভরের বৈশিষ্ট্য, ঐ অদৃশ্য ভরকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন ডার্ক ম্যাটার।
অনুমিত ডার্ক ম্যাটার কণার কাছে ফিরে আসি। ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ডেনমার্কের গবেষকরা ডার্ক ম্যাটার কণার আকার হিসেব করার চেষ্টা করেছেন। গবেষক দলটির মতে, ডার্ক ম্যাটার কণার ওজন হতে পারে একটা প্রোটিনের চেয়ে ১০ বিলিয়ন বিলিয়ন গুণ ভারী। মানে ১ এর পাশে ১৮টি শূন্য! হাইপোথিসিস অনুযায়ী যদি তাই সত্য হয়, ১টি একক ডার্ক ম্যাটার কণার ভর হবে ১ মাইক্রোগ্রাম, যা মানবকোষের ভরের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ( একটি মানবকোষ গড়পড়তায় ৩.৫ গ্রাম হয়)। আর এই সীমায় হাইপোথিসিস অনুযায়ী ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের ব্যাপারটি সম্ভব। মানবকোষ আর ডার্ক ম্যাটার কণার ভরের দুটো ঘটনাই স্বাধীন, সহজে প্রকাশের জন্য, যাতে পরিচিত কিছুর সাথে তুলনামূলক কল্পনা করা যায় একারণে মানবকোষের কথা বলা।
গবেষকেরা এই হিসেবটুকু নিয়ে অতি ভারী কণাদের একটি নতুন আদর্শ মডেল দাঁড় করানোর চেষ্টা করছেন। তাঁরা এটিকে বলছেন PIDM কণা- প্লাঙ্কিয়ান মিথস্ক্রিয়াকারী ডার্ক ম্যাটার (Planckian interacting Dark Matter). এই অতিভারী কণাগুলো দুর্বল মিথস্ক্রিয়াকারী ভারী কণার (Weak interacting massive particle বা WIMP) অধীনে শেণীবদ্ধ হবে।
পূর্ববর্তীতে গবেষকেরা প্রস্তাব করেছিলেন যে WIMP প্রোটনের চেয়ে ১০০ গুণ ভারী। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে WIMP কণা প্রকল্পিত হয়ে আসলেও এদের প্রমাণে ঘাটতি ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ের, যেন প্রস্তাবিত সব কিছুই ডার্ক ম্যাটারের মত, দাঁড় করানো যাচ্ছিল না। নতুন অনুমানটি ডার্ক ম্যাটার কণা যে তাৎপর্যপূর্ণভাবে কিছু দিয়ে সে সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।
ডেনমার্কে গবেষণাধীন এই দলটি যদি ডার্ক ম্যাটার কণার ভরের আকারের ব্যাপারে সঠিক হয় তাহলে দাঁড়ায়, গবেষকদের পক্ষে কণাত্বরক যন্ত্রে ডার্ক ম্যাটার তৈরির জন্য তা বেশিই বড়। এর পরিবর্তে, মহাজাগতিক ক্ষুদ্রতরঙ্গের ব্যাকগ্রাউন্ড বিকিরণ থেকে ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্বের প্রমাণ মিলতে পারে। ঐ বিকিরণ বলতে মূলত বিগ ব্যাঙের সময়ের তৈরি হওয়া আলোর কথা বলা হচ্ছে।
সংক্ষেপে, যখন ১৩.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে বিগ ব্যাঙ সংঘটিত হয়েছিল, এর পরপরই মহাবিশ্ব খুব দ্রুত প্রসারিত হচ্ছিল, যে সময়টাকে বিজ্ঞানীরা বলেন ইনফ্লেশান বা স্ফীতি (Inflation). ইনফ্লেশানের পরবর্তী ধাপ মহাবিশ্বের গঠন হওয়ার পর্যায়। যখন মহাবিশ্ব পুনরায় উত্তপ্ত হয়েছিল, তখন অনেকগুলো ঘটনার মাঝে একটি হল প্রচুর কণা তৈরি হয়েছিল। ঠিক এই পর্যায়টিই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ পুনরায় উষ্ণায়নের সময় অতিভারী ডার্ক ম্যাটার কণাগুলো প্রথম গঠিত হয়েছিল।
তবে যাই হোক, এই মডেলের উপর কাজ করতে হলে পুনরায় উষ্ণায়নের তাপমাত্রা বর্তমান সর্বজনীন মডেলের তাপমাত্রা অপেক্ষা তাৎপর্যপূর্ণভাবে বেশি হতে হবে, যে পর্যায়ের সময়ের কথা বলা হচ্ছে তখনকার জন্য। তাৎপর্যপূর্ণ এ (অর্থাৎ যে মানটুকু আমরা উপেক্ষা করতে পারব না) তাপমাত্রা মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড বিকিরণে একটা চিহ্ন অবশ্যই রেখে যাবে, যা পরবর্তী পর্যায়ের মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষণের মাধ্যমে ধরে ফেলা যায়। অবধারিতভাবে, আমরা যদি ডার্ক ম্যাটার কণার সরাসরি প্রমাণ পেয়ে যাই তবে সেটি মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে আর প্রাথমিকভাবে এর গঠন কেমন ছিল সে ব্যাপারে অনেকগুলো অনুমানকে দৃঢ় করবে। তবে তার আগে আমাদের আরো উন্নত যন্ত্রপাতি আবশ্যিক বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ডেনমার্কের মহাবিশ্বতত্ত্ববিদ ম্যাককুলেন স্যান্ডোরা। তিনি আশা করছেন পরবর্তী দশকের মধ্যেই হয়ত আমরা ঐরকম প্রযুক্তি পেয়ে যাব।
ততদিন পর্যন্ত ডার্ক ম্যাটার কেমন, কিভাবে কাজ করে ইত্যাদির জল্পনা কল্পনা করেই যেতে হবে, হয়ত আরো অনুমান ও মডেলের মাধ্যমে। উল্লেখ্য, এই হাইপোথিসিসটি পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল Physical Review Letters এ প্রকাশ করা হয়েছে।
Leave a Reply