অণুজীব পরিচিতিঃ Mycobacterium tuberculosis

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত
আমি যে সে শহরে থাকি ওখানে একটা বক্ষ ব্যাধি হাসপাতাল আছে। ছোটবেলায় আব্বু আম্মুর মুখে শুনতাম এখানে টিবি এর চিকিৎসা হয়। আমার কাছে টিবি নামটা কেমন জানি ইন্টারেস্টিং লাগতো কারণ এর সাথে ‘টিভি’ শব্দটার মিল আছে। পরে বুঝতে পারি টিবি আসলে যক্ষ্মা। আর এই যক্ষ্মা রোগের কারণ Mycobacterium tuberculosis নামের অণুজীব। ১৮৮২ সালে রবার্ট কখ (Robert Koch) এই অণুজীবটি আবিষ্কার করেন। তাঁর এই আবিষ্কারের জন্যে তিনি ১৯০৫ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পান। ওনার নাম অনুসারে একে কখ’স বেসিলাস (Koch’s Bacillus) ও বলা হয়! যক্ষ্মা নিয়ে একসময়কার বিখ্যাত ডায়ালগ ছিল ‘যার হয় যক্ষ্মা তার নাই রক্ষা’। আর সে সময়টা হলো আঠারো শতকের দিকে! তখন যক্ষ্মা আমেরিকা,ইউরোপ এবং ইংল্যান্ডে মহামারী রূপ ধারণ করেছে। এসব জায়গায় মোট জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ লোক মারা যেত প্রতি বছর! তখন যক্ষ্মা হলে চিকিৎসা নেয়া আইঙ্গতভাবে বাধ্যতামুলক ছিল। কেউ চিকিৎসা না নিলে তাকে একঘরে করে দেয়া হতো! তারপর অনেক সময় পার হলো এবং কালের বিবর্তনে সেই ডায়ালগ পরিবর্তন হয়ে নতুন ডায়ালগের আবির্ভাব হলো! ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এই কথার ভিত্তি নাই’। আজকে আমরা দুই ডায়ালগের মাঝখানের পথটুকু কেমন ছিল তা দেখার চেষ্টা করবো এবং তার সাথে এই অণুজীবটি সম্বন্ধে কিছু জানার চেষ্টা করবো!
 
 
 
রবার্ট কখ
রবার্ট কখ
 
 
M tuberculosis একটি গ্রাম পজেটিভ ও স্ববাত শ্বসনকারী ব্যাকটেরিয়া। তার মানে এটার বেঁচে থাকার জন্যে অক্সিজেন প্রয়োজন।এটি দেখতে রড আকারের। আরও যদি বলতে হয় তাহলে বলতে হবে এটি একটি এসিড ফাস্ট ব্যাকটেরিয়া! Mycobacterium tuberculosis এর আরেকটা অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো তার কোষ প্রাচীর। অন্যান্য গ্রাম পজেটিভ ব্যাকটেরিয়ার মত পেপটিডোগ্লাইকেন থাকার পাশাপাশি এর লিপিড লেয়ার থাকে। এই মাইকো লিপিড একে ফেগোসাইটোসিস প্রক্রিয়া থেকে রক্ষা করে। কারণ লিপিড পিচ্ছিল হওয়ার কারণে ম্যাক্রোফাজ একে আবদ্ধ করতে পারে না। ফেগোসাইটোসিস রোধ করায় এই লেয়ার রোগ সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এই লিপিড লেয়ারের কারণে গ্রাম স্টেইনিং এতে কাজ করে না। M tuberculosis প্রতি ১৫-২০ ঘণ্টা পর পর বিভাজিত হয় যা কি না অন্যান্য অণুজীবের চেয়ে অনেক বেশি। যেখানে ই-কোলাইয়ের বিভাজিত হতে লাগে মাত্র ২০ মিনিট! ল্যাবরেটরিতে Mycobacterium tuberculosis নিয়ে কাজ করার জন্যে PNB agar, Lowenstein-Jensen Medium agar এবং Middlebrook agar মিডিয়াম ব্যবহার করা হয়! ১৯৯৮ সালে Mycobacterium tuberculosis এর জিনোম সিকুয়েন্সিং করা হয়।
 
 
যক্ষ্মার জীবাণুর কালচার
যক্ষ্মার জীবাণুর কালচার

 

 এইবার আসি কিভাবে যক্ষ্মা কিভাবে ছড়ায়! রবার্ট কখ এর আবিষ্কারের করার আগে আমেরিকার কিছু অংশে বিশ্বাস করা হতো যক্ষ্মা রোগের কারণ হলো ভেম্পায়ার! তারা মনে করতো পরিবারের কেউ যদি বক্ষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তাহলে সে ভেম্পায়ার হয়ে যেতে পারে! তখন সে ভেম্পায়ার পরিবারের জীবিত সদস্যের আত্মার শক্তি হরণ করতে থাকে! এবং সেই জীবিত মানুষটি ধীরে ধীরে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়! তাই তারা পরিবারের কেউ মারা গেলে কিছুদিন পর কবর খুঁড়ে তার দেহ বের করে দেখতো! যদি দেহ কম পচে থাকে কিংবা হৃদপিণ্ডে রক্ত থাকে তাহলে তারা ধরে নিত লোকটা মরার পর ভেম্পায়ার হয়ে গেছে! তখন তারা সেই হৃদপিণ্ড আগুনে পুড়ে ফেলতো! আর মাথার খুলি স্পাইনাল কর্ড থেকে আলাদা করে বুকের উপর রাখতো! হাত পা গুলো মুচড়িয়ে রাখতো! আজ থেকে মাত্র দু’শো বছর আগে আমেরিকাতে এই ধরণের কুসঙ্কার ছিলো ভাবতেই অবাক লাগে! যদিও অবাক হওয়ার কিছু নেই! যেখানে সত্য জ্ঞান এখনও আড়ালে সেখানে মানুষ দুর্বল, নিরুপায় এবং নিজের অজান্তেই সে বর্বর!
কিন্তু আমরা বর্তমানে জানি হাঁচি কাশির মাধ্যমে যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে যায় যা থেকে অন্য মানুষের শরীরে তা প্রবেশ করে। যদিও এ কথাটি বেঞ্জামিন মার্টিন তার এ থিওরি অব কন্সাম্পশন (A theory of consumption) এ বলেছিলেন ১৭২০ সালে, যা কি না কখ এর আবিষ্কারের ও ১০০ বছর আগের ঘটনা! তিনি বলেছিলেন, যক্ষ্মা হয়তো কোন ক্ষুদ্র জীবের দ্বারা হয়। আর জীবগুলো বাতাসের মাধ্যমে একজন রোগী থেকে আরেকজন রোগীতে পৌছায়।
আমাদের প্রথমে বুঝতে হবে যক্ষ্মা শুধু মাত্র বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়। অন্য কোন মাধ্যম যেমন শারীরিক স্পর্শ বা খাওয়া দাওয়ার মাধ্যমে যক্ষ্মা ছড়ায় না। যক্ষ্মার জীবাণু M tuberculosis যখন কোন ব্যক্তি শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করে তখন তা ফুসফুসের এলভিওলাই এ আক্রমণ করে! তারপর শরীরের প্রহরী ম্যাক্রোফাজ গিয়ে সেই সব জীবাণুকে আবদ্ধ করে। কিন্তু জীবাণুগুলো ম্যাক্রোফাজের ভিতরেই বংশবৃদ্ধি করে যা কি না ক্যামোটেকটিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যার ফলে আরও ম্যাক্রোফাজ আসে আগের ম্যাক্রোফাজগুলোকে সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু তারপরও তারা জীবাণুগুলো ধ্বংস করতে পারে না এবং এরা এনজাইম ও সাইটোকাইন নিঃসরণ করে। যা কি না ফুসফুসে ইনফ্লামেশন তৈরি করে। সাথে আসে আরও ম্যাক্রোফাজ ও লিম্ফোসাইট এসে চারদিকে একটা দেয়াল তৈরি করে যাকে বলে গ্রেনুলোমা। এই অবস্থা হলো যক্ষ্মার সুপ্ত অবস্থা! এই অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিতে রোগের কোন উপসর্গ দেখা দেয় না এবং তার থেকে অন্য কোন ব্যক্তিতে রোগ ছড়ায় না। কিন্তু শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা যদি এই গ্রেনুলোমা নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয় তখন গ্রেনুলোমা ভেঙ্গে জীবাণুগুলো ফুসফুস ও রক্তের মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়।
 
 
যক্ষ্মা সৃষ্টির প্রক্রিয়া
যক্ষ্মা সৃষ্টির প্রক্রিয়া
 
 
 
 
যক্ষ্মা রোগের লক্ষণগুলো হলো দীর্ঘদিন ধরে কাশি, কাশির সাথে রক্ত যাওয়া, জ্বর, ওজন কমে যাওয়া, বুকে ব্যথা, অবসাদ, ক্ষুধামন্দা ইত্যাদি।
 
 
 
 
 
যক্ষ্মার উপসর্গ
যক্ষ্মার উপসর্গ
 
 
 
 
 
পূর্বে যক্ষ্মার চিকিৎসায় স্ট্রেপটোমাইসিন ব্যবহার করা হতো। কিন্তু বর্তমানে আইসোনিয়াজাইড ও রিফাম্পিসিন ব্যবহার করা হচ্ছে। এখনকার চিকিৎসাগুলো দীর্ঘমেয়াদী! কারণ যক্ষ্মা রোগের জীবাণুর বংশবৃদ্ধির হার কম এবং তারা সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। আরেকটি ঔষধ যেটা পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে তা হলো ডেইরিকুইনোলাইন। আর যক্ষ্মার বিরুদ্ধে ব্যবহৃত একমাত্র ভেক্সিন হলো বিসিজি ভেক্সিন।
একসময় পর্যন্ত যক্ষ্মা ছিল এক মরনব্যাধির নাম! আর এখন যক্ষ্মার নাম শুনে মানুষ খুব একটা বিচলিত হয় না। কিন্তু যক্ষ্মার উপর গবেষণা দিন দিন কমে যাচ্ছে! যক্ষ্মার জন্য যে ড্রাগ ব্যবহার করা হয় তার প্রতি রেজিস্ট্যান্স বাড়ছে কিন্তু নতুন ড্রাগ তৈরি নিয়ে খুব একটা গবেষণা হচ্ছে না। তাই যক্ষ্মা যদি আবারও মরণব্যাধি রূপে আমাদের সামনে হাজির হয় তাহলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
 
(আগামী লেখায় থাকবে ই-কোলাই নিয়ে)
 
 
* লেখাটি মাসিক বিজ্ঞান প্রত্রিকা জিরো টু ইনফিনিটির ‘মে  ২০১৬’ সংখ্যায় প্রকাশিত।

লেখাটি 631-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. ভালো লাগলো লেখাটা, শেষ প্যারাটাতে তো ভাই ভয় ধরিয়ে দিলেন… আসলেই চিন্তার বিষয়।
    ভাইয়া , সায়েন্টিফিক নামগুলো ইটালিক করে দিয়েন… কেমন চোখে লাগে 🙂

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      ধন্যবাদ 🙂 করে দিলাম।

  2. আমার সবচেয়ে ভালো লাগছে গল্পগুলো। লেখাটার ফরম্যাট সুন্দর। একেবারে কম কথায় একটা রোগসংক্রমণকারী জীবাণু সম্পর্কে জেনে যাওয়া যায়। চলতে থাকুক।

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      ধন্যবাদ 🙂 এই সিরিজি চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।

      1. বানানে আরো সতর্কতা চাই। স্ববাত সম্ভবত সবাত, মরন> মরণ ইত্যাদি।

        1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
          সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

          খেয়াল রাখবো।

  3. ভালো লাগলো, ভ্যাম্পায়ারের অংশটুকু পড়ে খুব মজা পেয়েছি। আপনিও লিখতে থাকুন, আমরাও পড়তে থাকি। 🙂

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      হা হা হা। ধন্যবাদ 😀

  4. মেহজাবিন হোসেন Avatar
    মেহজাবিন হোসেন

    চমৎকার লেখা! ছাত্রাবস্থায় এমন গল্পে গল্পে অণুজীব নিয়ে জানতে পারলে অনেক কিছুই সহজ হয়ে যেতো।
    আগের দিনে যেমন যক্ষার চিকিৎসা করা বাধ্যতামুলক ছিলো এখনো বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইলে সই দিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হয়- ” আমার যক্ষা রোগ ধরা পড়িলে চিকিৎসকের শরনাপন্ন হইবো, অন্যথায় যে ব্যবস্থা নেওয়া হইবে তাহা মাথা পাতিয়া মানিয়া লইবো”।
    লিখতে থাকুন

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      অনেক ধন্যবাদ 🙂

  5. অনিক রতন অর্ঘ্য Avatar
    অনিক রতন অর্ঘ্য

    অসাধারন লাগল ,ভাইয়া।

    1. সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ Avatar
      সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

      অনেক ধন্যবাদ 🙂

  6. অনেক ইনফরমেটিভ সাথে ভাষাটাও সহজ ও সাবলীল

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 910 other subscribers