ছোট্ট শহর সিটকা সম্ভবত আলাস্কার সবচেয়ে আরামদায়ক জায়গা। বারানফ দ্বীপে অবস্থিত সমুদ্র তীরবর্তী শহর সিটকা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় উষ্ণ শ্রোতের প্রভাবে সবসময়ই এখানকার আবহাওয়া মাতৃকোমল। এক মাসের গড় তাপমাত্রা সবসময়ই হিমাংকের উপরে থাকে। শহরটির ইতিহাসে বলার মত তেমন কোন ঘটনা নেই। ১৮৬৭ সালের অল্প কয়েকটি দিন ছাড়া। তখন সারা পৃথিবীর রাজনীতি সচেতন মানুষদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়েছিলো এই সিটকা।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার অনেক কূটনীতিক সেখানে জড়ো হন। প্রতি একর মাত্র দুই সেন্টের বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ানদের থেকে আলাস্কা কিনে নেয়। অর্ধমিলিয়ন বর্গমাইল বাবদ মাত্র সাত মিলিয়ন ডলারে বিনিময়ে আলাস্কার মালিকানা যুক্তরাষ্ট্র পাবে এমন চুক্তি হয় দুই দেশের মধ্যে। গৃহযুদ্ধ পরবর্তী যুক্তরাষ্টের একজন আম আমেরিকানের জন্য এই অংকটা অযৌক্তিক রকমের বেশি। যারা পক্ষের ছিলো, তাদের দাবী ছিলো – পরবর্তী পদক্ষেপে কানাডার প্রদেশ ব্রিটিশ কলাম্বিয়াকেও কিনে ফেলা হোক, আর বিপক্ষের লোকেদের যুক্তি ছিলো জনমানবশূন্য এসব এলাকা অধিগ্রহন দেশের জন্য বোঝাস্বরূপ। সে যাই হোক, কেউ কেউ আবার বলে থাকেন নাগরিকদের আত্নবিশ্বাস বাড়ানোর জন্যেই সরকার তখন এই নাটকীয় চুক্তিটি সম্পন্ন করে।
সিটকা সংক্রান্ত আরেকটি নাটকের পর্দা উন্মোচিত হয় ১৯৮০ সালের দিকে। না, এই নাটক দুই জাতির মধ্যে চুক্তির নয় বরং দুই প্রজাতির মধ্যে সংঘর্ষের!
বৃক্ষরাজি সিটকাকে ভালোবাসে। সিটকা সেই ভালোবাসার প্রতিদান দেয় লম্বা গ্রীষ্মকাল ও শান্ত আবহাওয়ায় গাছগুলোকে জড়িয়ে রেখে। ওখানকার জল, আলো, আর্দ্রতা সবই গাছের বসবাস এবং বেড়ে ওঠার চমৎকার সংমিশ্রন। সিটকা স্প্রাস, সিটকা অ্যাল্ডার, সিটকা অ্যাশ, সিটকা উইলো এরা হলো এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা। এছাড়াও এই প্রজাতির গাছগুলো সফলতার সাথে পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ওয়াশিংটন, ওরেগন এবং ক্যালিফোর্নিয়াতেও ছড়িয়ে গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে অমায়িক বলা চলে সিটকা উইলো(Salix sitchensis) কে। দেখতে তেমন মনোরম নয়, উচ্চতা সর্বোচ্চ তেইশ ফিট। একদম সাদামাটা একটা গুল্ম জাতীয় গাছ। কিন্তু অন্যান্য অনেক গাছের মতই সিটকা উইলোতেও যা কিছু দেখি বা জানি, তার চেয়ে অদেখা, অজানা ব্যপারগুলোর সংখ্যাই বেশি।
আপনি যখন ইউক্যালিপটাস বাগানের মধ্যে দিয়ে হাটাচলা করেন তখন অনেক সময় ঝাঁঝালো, তীব্র ঘ্রাণের অস্তিত্ব টের পান। আসলে আপনি নিঃশ্বাসের সাথে নিচ্ছেন বাতাসে ভেসের বেড়ানো এক ধরনের রাসায়নিক যাকে বলা হয় উদ্বায়ী জৈব যৌগ(Volatile Organic Compound) সংক্ষেপে ভিওসি। অনেক গাছই ভিওসি তৈরি করে। ভিওসি কোন পুষ্টি সর্বরাহ করেনা, তাই মৌলিক জীবন প্রক্রিয়ার জন্য এরা গৌণ। ভিওসির অনেক ব্যবহার আছে যা আমরা জানি, আর অগুনতি সংখ্যাক আছে যেসব আমরা জানিনা। ইউক্যালিপটাস ভিওসি নিঃসরন করে জীবাণুনাশক হিসেবে। গাছের পাতা কিংবা বাকল আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে যেন কোন জীবাণুর সংক্রমণের শিকার না হয় সেজন্য এই ব্যবস্থা।
বেশির ভাগ ভিওসি যৌগে কোন নাইট্রোজেন থাকেনা। তাই এটা তৈরি করা সহজ এবং সস্তা। ইউক্যালিপটাসের মত বাতাসে এত এত ভিওসি ছেড়ে দিয়ে আসপাশ গন্ধ বানিয়ে ফেললেও গাছের তেমন কিছু আসে যায়না। তবে বেশিরভাগ ভিওসি কিন্তু আমাদের নাসারন্ধ্রে কোন প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করেনা। এতে কোন সমস্যা নাই, কারণ একে তো আমাদের ঘ্রাণশক্তি অন্যান্য প্রাণীর মত এত তীব্র নয়, আর ঘ্রাণ ছড়ানোও ভিওসির উদ্দেশ্য নয়। যাই হোক, বনের মধ্যে ভিওসির উৎপাদন কখনো বাড়ে, কখনো কমে। নির্দিষ্ট ভিওসির উৎপাদন চালু কিংবা বন্ধ হয় বিশেষ কিছু সংকেতের মাধ্যমে। এরকম একটি সাংকেতিক যৌগ হলো জ্যাসমোনিক এসিড, যা কোন গাছ আঘাতপ্রাপ্ত হলে প্রচুর পরিমানে তৈরি হয়।
গাছ এবং পোকাদের যুদ্ধ হাজার হাজার বছর ধরে চলছে। এই যুদ্ধে দুই পক্ষেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই যুদ্ধেরই এক মহাকাব্যিক উপাখ্যান রচিত হয় ১৯৭৭ সালে। এক পক্ষ নিরীহদর্শন সিটকা উইলো, আরেক পক্ষ ভয়ানক তাবু শুঁয়োপোকা (Tent catterpillar)। তাবুর মত দেখতে বাসা বাঁধে বলে এরা এমন নাম পেয়েছে। ওয়াশিংটনের কিং কান্ট্রিতে স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষণা কাজে ব্যবহৃত বনটিকে এই পোকা আক্রমণ করে। এই পোকাগুলা নিষ্ঠুর এবং খুবই লোভী। পুরো বনে ছড়িয়ে যেতে যেতে এরা কয়েকটা গাছের সবগুলো পাতা নষ্ট করে ফেলে এবং আরো অনেক গাছের মারাত্নক ক্ষতি করে। আমরা জানি যে লড়াইতে হেরে গেলেও যুদ্ধে যেতা সম্ভব, গাছদের ইতিহাসে এটা খুব বেশি রকম সত্য।
শুঁয়োপোকাদের আক্রমনের পরেও বেঁচে থাকা গাছদের পাতা নিয়ে ২ বছর পরে একটা সেই ইউনিভার্সিটিতে একটা এক্সপেরিমেন্ট করা হয়। ওই গাছগুলোর পাতা শুঁয়োপোকাদের খাওয়ানোর পর দেখা যায় এদের বৃদ্ধির হার খুব কম। অথচ একই গাছের পাতা ২ বছর আগে খেয়ে তারা তুমুল গতিতে বেড়েছিলো, বংশবৃদ্ধি করেছিলো, অন্য গাছ আক্রমণ করেছিলো। এর থেকে খুব সহজেই বুঝা যায়, পাতায় এমনকিছু আছে যা পোকাগুলোকে অসুস্থ বানিয়ে ফেলছে। আমরা যারা গাছ নই তাদের ইমিউন সিস্টেমও কিন্তু এমন ব্যবস্থা থাকে, যাতে একটা জীবাণুর আক্রমন থেকে রক্ষা পেলে পরে আর সেই জীবাণু(যেমনঃ বসন্ত) সাধারণত কিছু করতে পারেনা।
তবে আশ্চর্যের ব্যপার এটাই যে, ওই বন থেকে পুরো এক মাইল দূরের সুস্থ্য সিটকা উইলো গাছ, যেগুলো কখনোই আক্রান্ত হয়নি তাদের পাতাও দেখা গেলো শুঁয়োপোকাদের জন্য বিষাক্ত। সেই পাতা খেয়ে পোকাগুলো এতটাই নিস্তেজ আর নাজুক হয়ে গেলো যে দুই বছর আগেকার তাদের ধ্বংসাত্নক রূপ কল্পনাও করা যাচ্ছিলোনা।
বিজ্ঞানীরা কাছাকাছি গাছেদের মধ্যে মূল থেকে মূলে যোগাযোগের ব্যপারে জানতেন। এই যোগাযোগ মাটির তলে মূল থেকে ক্ষরিত বিভিন্ন পদার্থের মাধ্যমে হয়। কিন্তু মাইলখানেক দূরে অবস্থিত দুই দল উইলো গাছের মধ্যে কোন মৃত্তিকাকথনের সুযোগ নেই দূরত্বের কারণে। হয়তো মাটির উপরে কোন সংকেত অদল বদল হয়েছে এক্ষেত্রে। বিজ্ঞানীরা পরে উপসংহার টেনেছেন গাছগুলো যখন শুঁয়োপোকা দিয়ে আক্রান্ত হয়, তখন তারা পাতাগুলোতে পোকাদের জন্য বিষাক্ত পদার্থ তৈরি করা শুরু করে। এই ঘটনা বিভিন্ন ভিওসির উৎপাদনকেও নাড়া দেয়। গবেষকদের অনুমান, এই ভিওসি বাতাসে ভেসে দূরের উইলো গাছগুলোর আসেপাশে পৌছালে তারা একে সতর্কতা সংকেত ধরে নিয়ে নিজেদের দেহেও সেই শুঁয়োপোকানাশক তৈরি শুরু করে। ১৯৮০ সালের মধ্যে ওই বনে এবং তার আসেপাশে শুঁয়োপোকাদের বংশের পর বংশ শোচনীয়ভাবে ধ্বংস হতে থাকে এসব বিষের কারণে। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘমেয়াদি চাল দিয়ে গাছেরা যুদ্ধের পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণেই নিয়ে নেয়।
বছরের পর বছর পর্যবেক্ষণ করে গবেষকরা প্রতীত হলেন যে বায়বীয় কোন সংকেতের উপস্থিতিই এই ঘটনার সম্ভাব্য ব্যখ্যা। গাছদের হয়তো আমাদের মত চিন্তা করার, অনুভব করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু তারা হয়তো ঠিকই একে অপরের খেয়াল রাখে। সংকটের সময় শুধু নিজেদের মধ্যে নয়, দূরবর্তী স্বজাতিকেও জানিয়ে দেয় বিপদের কথা। সিটকা উইলো এক্সপেরিমেন্টটা একটা চমৎকার, অসাধারন উদাহরন যা বদলে দিয়েছিলো অনেক কিছু। সমস্যা একটাইঃ গাছ থেকে গাছে দূর আলাপনের মত ব্যাবস্থার অস্তিত্ব কাউকে বিশ্বাস করাতে ২০ বছর লেগেছিলো।
লেখাটি প্রফেসর হোপ জাহরেন এর আত্মচরিত Lab Girl বইটির একাদশ তম অধ্যায় এর ভাবানুবাদ
Leave a Reply