ধরুন,আপনি প্রথমবার জাফলং বেড়াতে গেছেন। জাফলংয়ের চোখজুড়ানো অপরূপ সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য অবলোকনে আপনি মগ্ন হয়ে আছেন,হঠাৎই ব্রেইনে ধরা পড়া একটা সিগন্যালে চমকে উঠলেন। আপনার মনে হতে লাগল, দৃশ্যগুলো আপনার অতি পরিচিত যেন আগেও কোথাও দেখেছেন। কিন্তু কোথায় দেখেছেন…কোথায়…নাহ, কিছুতেই মনে পড়ল না আপনার। অথবা এরকম মনে হতে পারে যে আপনি যেন আগেও জাফলং এসেছিলেন, এই দৃশ্যগুলো দেখেছিলেন। কিন্তু কবে এসেছিলেন মনে করতে পারলেনই না।
জি,এই অভিজ্ঞতাকেই বলা হয় দেজাভূঁ।
দেজাভূঁ ব্যাপকভাবে ঘটা একটি ঘটনা। বেশিরভাগ লোকজন জীবনে অন্তত একবার এই অভিজ্ঞতা লাভ করে। যাদের দেজাভূঁর অভিজ্ঞতা রয়েছে তাদের কাছে ব্যাপারটা খুব অদ্ভুত মনে হয় এবং এই ঘটনার খুব তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী একটি প্রভাব থেকে যায়। আর যাদের জীবনে দেজাভূঁ ঘটেনি তাদের কাছে ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব ও অকল্পনীয় মনে হয়। দেজাভূঁ মনোবিজ্ঞানে খুবই জনপ্রিয় এবং রহস্যময় একটি ঘটনা। দেজাভূঁ নিয়ে নানারকম তত্ত্ব না গুজব প্রচলিত থাকলেও এ নিয়ে সত্যিকার গবেষণা হয়েছে খুবই কম।
তার কারণও বিচিত্র। দেজাভূঁর নির্দিষ্টভাবে শণাক্তযোগ্য কোন উদ্দীপনা নেই। এজন্য এ নিয়ে গবেষণা বেশ কঠিন। তাছাড়া দেজাভূঁ নিয়ে নানারকম ধারণা প্রচলিত থাকায় এর সজ্ঞা স্থির করাও কঠিন। তাই সঠিক কি গবেষণা করতে হবে তা স্থির করাও মুশকিল। তবে সম্প্রতি দেজাভূঁর সাথে জড়িত বুদ্ধিবৃত্তিক গবেষণা হচ্ছে।
এই লেখাটিতে আমরা জানব বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেজাভূঁ কী এবং কিভাবে ঘটে। দেজাভূঁর বৈজ্ঞানিক ব্যাখার আগে চলুন জেনে আসি এর ইতিহাস সম্পর্কে। দেজাভূঁর চিকিৎসাক্ষেত্রে এবং লোকমুখে প্রচলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। তবে দেজাভূঁর প্রকৃতরূপ অনেকটাই অজানা। এই অজ্ঞানতার কারণ দীর্ঘকাল ধরে দেজাভূঁ নিয়ে প্রচলিত বিচিত্র ধারণা অনেকাংশে দায়ী। যা আজ দেজাভূঁ বলে পরিচিত সেরকম একই ধারণা প্রচলিত ছিল এরিস্টটল, প্লেটো, পিথাগোরাসের সময়ও। তবে উনবিংশ শতাব্দির গোড়ার দিকে দেজাভূঁকে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণার আওতায় আনা হয় ফ্রান্সে। তখন স্মৃতি গবেষণা তুমুল জনপ্রিয় ছিল যা প্রথম থেকেই দেজাভূঁকে চিহ্নিত করে একটি স্মৃতিজনিত সমস্যা হিসেবে।
ডেজা ভার গৌণ বৈশিষ্টের উপরও সমান জোর দেয়া হয়। যেমন-দেজাভূঁকে ধরা হত ভবিষ্যদ্বাণী হিসেবে। ব্রাউন অবশ্য আরেকটু যৌক্তিকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন ব্যাপারটাকে। তিনি বলেন,”দেজাভূঁ হচ্ছে কোন কিছু ঘটার পূর্বেই সে সম্পর্কে বলে দেয়া যেন আগেই তা ঘটেছিল “।ব্রাউনের কথা জন্মান্তরবাদকে সামনে নিয়ে আসে। উনবিংশ শতাব্দির শেষদিকে স্মৃতিজনিত সমস্যা বা প্যারামেনশিয়া নিয়ে আগ্রহ বাড়ার সাথে সাথে আগ্রহ বাড়ে দেজাভূঁ নিয়েও। আসলে দেজাভূঁ শব্দটাই প্রচলিত হয়নি ১৮৯০ এর দশকের মাঝামাঝির আগে। তারপর নানাভাবে এর ব্যাখা দেয়ার চেষ্টা করা হয় যেমন-পূর্বজন্মের স্মৃতির অনুভূতি,কল্পনা,স্মৃতিচারণ,স্মৃতিভ্রংশ প্রভৃতি। তারপর বিংশ শতাব্দিতে ব্রিটেন,ইউএসের মূল ধারার মনোবৈজ্ঞানিক গবেষণায় চলে আসে দেজাভূঁ।
প্রথমদিকে দেজাভূঁকে প্যাথলজির সাথে সম্পর্কিত ধরা হয়। বিশেষ করে টেম্পোরাল লোব এপিলেপসি,সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ হিসেবে দেজাভূঁকে চিহ্নিত করা হয়। তবে এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ মেলেনি। এছাড়া ওষুধের ব্যবহার এবং ওষুধ ব্যবহার বন্ধের সাথে পুনঃপুন দেজাভূঁ ঘটার ইতিবাচক সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে।
এখন জানা যাক দেজাভূঁ আসলে কী।
দেজাভূঁ শব্দটি ফরাসী। এর ইংরেজি অর্থ করলে দাড়ায় “already seen” অর্থাৎ দৃশ্যগুলো আপনি আগেও দেখেছেন।
আমজনতার মধ্যে দেজাভূঁ নিয়ে ব্যাপক সচেতনতা দেখা গেলেও খুব কম মানুষই এর প্রকৃত রূপ সম্পর্কে জানেন। কিছু লোক হয়ত তার অদ্ভুত কোন সাদৃশ্য খুজে পাওয়াকে দেজাভূঁ বলে চালিয়ে দেয়। দেজাভূঁর প্রকৃত রূপ নিয়ে ধোয়াশার কারণে এটি ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করেছে। সকল দুর্বোধ্য,ব্যাখাতীত সাদৃশ্যের অনুভূতি ব্যক্তি যার কোন উৎসের সন্ধান পায়না তাকেই দেজাভূঁ বলে চালিয়ে দেয়া হয়। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও নানারকম সাদৃশ্য বোঝাতে দেজাভূঁ শব্দটি ব্যবহার করা হয় প্রকৃত ঘটনার সাথে যার কোন সম্পর্কই নেই। এইভাবে নানাক্ষেত্রে দেজাভূঁর ব্যাপক ব্যবহার শব্দটির আসল অর্থকে ঘোলাটে করেছে।
এখন চলুন জানি দেজাভূঁর প্রকৃত রূপ আসলে কেমন।
দেজাভূঁ বলতে বোঝায় একটা তীব্র অনুভূতি যেন পূর্বে ঘটে যাওয়া কোন অভিজ্ঞতার সাথে বর্তমান ঘটনার সাদৃশ্য আছেে কিন্তু দুটো ঘটনা পুরোপুরি এক নয়। অথবা ভবিষ্যৎ জেনে যাবার মতো অনুভূতি যেন আপনি জানেন যে পরবর্তীতে কী ঘটবে। এই অনুভূতি কয়েক মিনিটের মতো স্থায়ী হতে পারে, তবে সাধারণত কয়েক সেকেন্ড থাকে।
দেজাভূঁর সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত সজ্ঞাটি হচ্ছে, “অজানা কোন অতীতের সাথে বর্তমানের কোন অভিজ্ঞতার ব্যাখাতীত সাদৃশ্য খুজে পাওয়ার অনুভূতি। “
চার্লস ডিকেন্সের বিখ্যাত উপন্যাস ডেভিড কপারফিল্ডের একটি লাইনে দেজাভূঁর চিত্র ফুটে উঠেছে ঝকঝকেভাবে।
“কখনো কখনো আমাদের এরকম অভিজ্ঞতা হয়, আমরা অনুভব করি যেন আমরা যা বলছি বা করছি তা আগেওও বলেছি বা করেছি, সুদূর অতীতের কোন এক সময়ে। যেন কোন এক অস্পষ্ট অতীতে আমরা বর্তমানে দেখা একই চেহারা,একই বস্তু দেখেছি বা বর্তমানের মতো একই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে গিয়েছিলাম। আমরা যেন একদম ঠিকঠিক জানি একটু পর কী বলা হবে,যেন হঠাৎই আমাদের তা মনে পড়ে যায়। “
এখন আসি দেজাভূঁর বৈজ্ঞানিক ব্যাখায়।
দেজাভূঁকে ব্যাখা করার জন্য অসংখ্য তত্ত্ব প্রস্তাব করা হয়েছে যা জন্মান্তরবাদ,ঐশ্বরিক বার্তা থেকে শুরু করে মস্তিষ্কে কোন সংকেতের বিলম্বিত প্রবাহ পর্যন্ত বিস্তৃত। দেজাভূঁ নিয়ে অসংখ্য তত্ত্ব প্রচলিত থাকলেও মোটামুটি চারটি প্রধান তত্ত্ব দ্বারা দেজাভূঁকে ব্যাখা করা যায়। এগুলো হল- Dual Processing Theory, Neurological Theory, Memory Theory, Attentional Theory.
ডুয়েল প্রসেসিং থিওরি: এই থিওরি অনুযায়ী দুইটা নিরীহ চিন্তা একইসাথে চলতে চলতে হঠাত কিছুক্ষণের জন্য আলাদা হয়ে গেলে দেজাভূঁ ঘটে। এইরকম আলাদা হওয়ার ঘটনা ঘটে যখন দুইটা চিন্তার একটা ভুল সময়ে আবির্ভূত হয়। যেমন-সাদৃশ্য এবংস্মৃতি থেকে সেই সাদৃশ্য কোথা থেকে এল তার পুনরুদ্ধার সাধারণত একইসাথে ঘটে। কিন্তু যদি সাদৃশ্যের চিন্তা স্মৃতি পুনরুদ্ধারের অনুপস্থিতিতে চলে আসে তাহলে দেজাভূঁ ঘটবে। আবার এর বিপরীত চিন্তাপ্রবাহও দেজাভূঁ ঘটায়। মানে দুইটা চিন্তা আলাদাভাবে চলতে চলতে হঠাত একসাথে হয়ে গেলে (তরঙ্গের উপরিপাতনের মত) তখন দেজাভূঁ ঘটে।
নিউরোলজিক্যাল থিওরি: এই থিওরি বলে যে মস্তিষ্কে প্রবাহিত সংকেতের গতিতে পরিবর্তনের ফলে দেজাভূঁ ঘটে। সংকেত প্রবাহের গতির এই পরিবর্তন ঘটে দুইভাবে- একক পথে,দ্বৈত পথে। একক পথে সংকেত প্রবাহের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে সংশ্লিষ্ট সংকেত একটু ধীরে যায়। তারপর যখন পৌছায় মগজে তখন স্বাভাবিকের তুলনায় ধীরে যাওয়ায় দেজাভূঁ ঘটে। দ্বৈত সংকেত প্রবাহের ক্ষেত্রে মূখ্য সংকেতটি ধীরে যায়। তখন ধীরগতির মূখ্য ওস্বাভাবিক গৌণ সংকেত প্রবাহের তুলনার ফলে ভবিষ্যত জানার অনুভূতি অনুভুত হয়।
মেমোরি থিওরি: মেমোরি থিওরিতে বস্তুগত সাদৃশ্যকে আলোকপাত করা হয়েছে। এ থিওরি অনুযায়ী,একটা দৃশ্যের কোন বস্তু বা পুরো দৃশ্যটাই অন্য দৃশৃযের সাথে মিল আছে মনে হতে পারে। একটি বা বহু বস্তুর সাদৃশ্যের থিওরি বলে যে,একই বস্তু বিভিন্ন দৃশ্যে দেখা কখনো কখনো সাদৃশ্যের একটা অনুভূতি নিয়ে আসে। এভাবে দেজাভূঁ ঘটে।
এটেনশনাল থিওরি: এই থিওরিতে ধারণা করা হয় যে,একই উদ্দীপনা সম্পর্কে দ্রুত দুইটি অনুভূতি অনুভব করার জন্য দেজাভূঁ ঘটে। হতে পারে আপনি কোনকিছু পূর্ণ সচেতনতার সাথে চিন্তা করছেন,কিছুক্ষণের জন্য আপনার চিত্তবিক্ষেপ ঘটল, আপনার মনোযোগে খুব সামান্য বিরতি বা প্রাথমিক উপলব্ধি কোনভাবে ক্ষীণ হয়ে যাওয়া এক ধরনের সাদৃশ্যের অনুভূতি নিয়ে আসতে পারে।
দেজাভূঁ-র উল্টো পিঠঃ
জামিয়াস ভূ দেজাভূঁর ঠিক বিপরীত ঘটনা। দেজাভূঁতে অনুভুত হয় সাদৃশ্যের অনুভূতি কিন্তু জামিয়াস ভূতে অনুভূত হয় বৈসাদৃশ্যের অনুভূতি। জামিয়াস ভূ অর্থ হচ্ছে “never seen” অর্থাৎ আপনি কখনোই দৃশ্যটি দেখেননি। জামিয়াস ভূ হচ্ছে এরকম যেন আপনার বর্তমান পরিস্থিতি কোথাও দেখেছেন কিন্ত তা আপনার অপরিচিত লাগছে। ধরুন,আপনি আপনার শোবার ঘরে হাটছেন, তখন মনে হত পারে যেন আপনি কখনো সেখানে আসেনইনি। কিন্তু আপনি নিশ্চিত জানেন যে এটা আপনারই শোবার ঘর। জামিয়াস ভূ দেজাভূঁর তুলনায় খুবই অল্প ঘটে। মানসিক চাপ,ক্লান্তি প্রভৃতির কারণে জামিয়াস ভূর অভিজ্ঞতা হতে পারে।
দেজাভূঁ একটি সাধারণ ঘটনা তবে সার্বজনীন ঘটনা নয়। পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ জীবনে অন্তত একবার এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। এটি তরুণদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে দেজাভূঁর পৌনপৌনিকতা কমে আসে। ভ্রমণ,ক্লান্তি,মানসিক চাপ প্রভৃতির প্রভাবেও ডেজা ঘটে থাকে। যদিও এখন পর্যন্ত দেয়া কোন তত্ত্বই দেজাভূঁকে পুরোপুরি ব্যাখা করতে পারে না, তবে কগনিটিভ সায়েন্সের ভবিষ্যত গবেষণা এ নিয়ে আমাদের আরো নতুন তথ্য জানাতে পারে বলে আশা করা যায়।
তথ্যসূত্রঃ
Scientific theories on deja vu phenomenon by Reckard Redgard
Leave a Reply