পার্কিং জোনে গাড়ি পার্ক করতে গিয়ে আপনি বুঝতে পারলেন আপনি কোথা থেকে এসেছেন তা আপনি মনে করতে পারছেন না। বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায় এসে আপনি এতক্ষণ ধরে কী পড়ছেন তা হয়তো ভুলে গেলেন। একজন মানুষের সাথে কথা বলতে বলতে একসময় আপনি খেয়াল করলেন এতক্ষন ধরে আপনি কী বলছিলেন তা সব ভুলে গিয়েছেন। এসবই বিক্ষিপ্ত মনের লক্ষণ!
কোন কিছু পড়ার সময় আপনি হয়তো ভাবছেন পরবর্তী ছুটির কথা। কারো সাথে কথা বলার সময় হয়তো ভাবছেন গতরাতে বান্ধবীর সাথে যে ঝগড়া হয়েছিলো সে ব্যাপারে। আপনার মন হয়তো কখনও ভবিষ্যতে আবার কখনও অতীতে ঘোরাফেরা করে। আপনার সে চিন্তা সুখের হোক কিংবা যন্ত্রণার হোক তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো আপনি বর্তমান থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছেন । আপনি প্রতি মুহূর্তে জীবন যাপনে ব্যর্থ হচ্ছেন। আর আপনার মন বন্দী হচ্ছে সময়ের বেড়াজালে।
আমাদের মন আমাদের ইচ্ছে অনুযায়ী চিন্তা না করে নানা অপ্রয়োজনীয় ব্যাপারে চিন্তা করতে থাকে। এধরণের অপ্রয়োজনীয় চিন্তা থেকে নেতিবাচক মানসিক অবস্থা তৈরি হয়। এভাবে স্মৃতি রোমন্থন, দুশ্চিন্তা এবং ভয় থেকে তৈরি হয় দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যা। এধরণের মানসিক অবস্থা আমাদের কাজের মান কমিয়ে দেয়। দ্রুত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিতেও মারাত্মক সমস্যা হয় এ ধরনের মানসিক পরিস্থিতিতে।
আর মনের এই বিক্ষিপ্ত অবস্থার বিপরীত হলো মনের মনযোগী অবস্থা। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মাইন্ডফুলনেস’ (Mindfulness) । কেউ যদি অপ্রয়োজনীয় কোন কিছুতে না জড়িয়ে সেই মুহূর্তের সাথে পুরোপুরি একাত্ম হতে পারে তখনই এই মানসিক অবস্থার সৃষ্টি হয়। মাইন্ডফুলনেস যে মানসিক চাপ কমিয়ে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারে এব্যাপারে অনেক গবেষণা পত্র ইতিমধ্যে প্রকাশ হয়েছে। বর্তমানে ২৫০ এরও বেশি স্বাস্থ্যকেন্দ্র মানসিক নানা অসুস্থতার জন্য মাইন্ডফুলনেস থেরাপি দিয়ে থাকে।
মাইন্ডফুলনেস কীভাবে কাজ করে তা আমিসি পি ঝা এর ল্যাবরেটরি থেকে ও অন্যদের গবেষণা থেকে কিছুটা বোঝা যায়। মাইন্ডফুলনেস থেরাপির মাধ্যমে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী মনোযোগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা লাভ করা যায়। বর্তমান সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে আরও গভীরভাবে একাত্ম হওয়া যায়।
হাজার বছর ধরে প্রাচ্যে অনেক ধরণের মেডিটেশন চলে আসছে যা আমরা এখন মাইন্ডফুলনেস মেডিটেশন নামে জানি। প্রাচীন বইগুলোতে বর্ণীত অনুশীলনীর মাধ্যমে আমাদের ইন্দ্রিয় নির্ভর অনুভূতির প্রতি মনোযোগ বাড়ানো সম্ভব। লোকেরা এধরনের অনুশীলনীর মাধ্যমে মনের স্বচ্ছতা ও শান্তি লাভ করতে পেরেছেন। এতে আয়ুও বেড়ে যেতে পারে।
এধরনের একটা অনুশীলন হলো ‘কেন্দ্রীভূত মনোযোগ’। এই পদ্ধতিতে যেকোনো একটি বিষয়ে মনোযোগ ধরে রাখতে হয়। সেটা হতে পারে শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ রাখা। এক্ষেত্রে কখন মন মনোযোগ থেকে সরে আসে তা খেয়াল রাখতে হয় এবং আবার পুনরায় শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিতে হয়। আরেক ধরনের অনুশীলন রয়েছে যেখানে মনের ভেতর কি ঘটছে তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। মনের মধ্যে কোন চিন্তা প্রবেশ করছে তা খেয়াল করতে হয় এখানে। আপনি একটি দূরবর্তী অগ্নিনির্বাপক ট্রাকের সাইরেনের মৃদু কোন আওয়াজ কল্পনা করুন। ট্রাক যত কাছে আসে সাইরেনের আওয়াজ বাড়তে থাকে। আর যখন আপনাকে পার হয়ে ট্রাকটি চলে যায় তখন সাইরেনের আওয়াজ কমতে থাকে। আপনি হয়তো খেয়াল করবেন সাইরেনের আওয়াজটি পার্শ্ববর্তী শত শত শব্দের মধ্যে একটি এবং ধীরে ধীরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে দেখবো আমাদের চিন্তা ও আবেগও এভাবে জন্ম নেয় এবং এভাবেই আমাদের নিজেদের মধ্যেই লুপ্ত হয়ে যায়। গৌতম বুদ্ধ সহ আরও অনেক সাধক এধরনের চর্চার জন্য আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন।
১৯৭০ সালের দিকে মাইন্ডফুলনেস মনোবিজ্ঞানে জায়গা বানাতে শুরু করে। এই সময় মেসাচুয়েট মেডিক্যাল স্কুলের জীববিদ জন কাবাত জিন মাইন্ডফুলনেসের উপর একটা সেকুলার প্রোগ্রাম বানান। আট সপ্তাহব্যাপী এই প্রোগ্রামে দুই ধরনের মনোযোগ নিয়ে কাজ করা হয়। একটা হলো কেন্দ্রীভূত মনোযোগ যেখানে মনোযোগের ক্ষেত্রকে সংকীর্ণ করে নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর কেবল মনোযোগ দেয়া হয়। আরেকটি হলো আমাদের চিন্তা, আবেগ ও অনুভূতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ওগুলোকে পর্যবেক্ষণ করা। একে ‘মেটা এওয়ারনেস’ বলা হয়। এই দুই চর্চা আমাদের মনকে লক্ষ্যবিহীনভাবে ঘুরে বেড়ানো থেকে দূরে রাখে।
মাইন্ডফুলনেস থেরাপির নেয়ার পর রোগীরা দেখতে পান নেতিবাচক চিন্তা এখন তাদের উপর আগের মত প্রভাব ফেলছে না। ক্রমে তা মনের উপর প্রভাব হারাচ্ছে। এই মাইন্ডফুলনেস থেরাপি দুশ্চিন্তা, মানসিক ভীতি নানা ধরনের মানসিক অসুস্থতা থেকে উত্তরণে সাহায্য করছে। এর মাধ্যমে শারীরিক রোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যাচ্ছে। যেমন দীর্ঘদিনের ব্যথা। কারণ মাইন্ডফুলনেস প্রোগ্রামের ফলে মানসিক চাপ কমে যায়। ফলে শারীরিক ব্যথার সাথে আর মানসিক চাপ যুক্ত হয় না। ফলে রোগীর ব্যথা কমে যায়। পরীক্ষার মাধ্যমে এই ঘটনার পক্ষে যুক্তি পাওয়া গেছে। চাকরি ক্ষেত্রে বিভিন্ন চাপ সামলানোর জন্য এই পদ্ধতি কার্যকরী। এর ফলে সমস্যা উধাও হয়ে যায় না। কিন্তু সমস্যার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়। জীবনের প্রতি কৌতূহল বাড়িয়ে আমাদের জীবনমুখী করে তোলে। বয়স্করা তাদের শেষ বয়সে এসে একাকীত্বে ভুগেন। কিন্তু এই থেরাপি তাদেরকে বুঝতে শেখায় তাদের একাকীত্বই তাদের জীবন নয়। জীবন অনেক বড় একটা ব্যাপার। সামাজিক জীবনে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর মাধ্যমে তাদেরকে জীবনের প্রতি আগ্রহী করে তোলা হয়।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে পরীক্ষার আগের রাতে আমাদের নানা ধরণের শারীরিক সমস্যা দেখা দিতো। যেমন জ্বর, ডায়রিয়া। এই থেরাপির মাধ্যমে পেটের সমস্যা কমে যায়। এমনকি আমাদের রোগ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও শক্তিশালী হয়ে উঠে আগের চেয়ে। যে লোক বেশী মাইন্ডফুল তাঁর বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও বেশী। গবেষকরা দেখেছেন যারা মানসিক চাপে ভুগেন তাদের ক্রোমসোমের শেষ অংশের টেলোমার ছোট হয়। দেখা গেছে টেলোমার ছোট হলে আয়ু কম হয়। ফলে যে ব্যক্তি বর্তমানে বাঁচে তাঁর বেশিদিন বেঁচে থাকার সম্ভাবনা আছে।
শারীরিক ব্যায়ামের ফলে যেমন পেশী শক্তিশালী হয় ঠিক তেমনি দিনে কিছুক্ষণ মাইন্ডফুলনেস অনুশীলন করুন। আপনার দৈনন্দিন কার্যক্রম থেকে নেতিবাচকতা কমে যাবে। কাজে আরও বেশি মনযোগী হবেন। আর ডাক্তার বা একজন সৈনিকের জন্য মনযোগী হওয়া তো আরও জরুরি। জীবন মরণ নিয়ে তাদের কাজ। তাই সবাই বর্তমানে বাঁচুন। এর পরে যখনই মন এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে নেতিবাচকতায় পূর্ণ হয়ে যাবে। তখনই মনোযোগ আপনার শ্বাস-প্রশ্বাসে নিয়ে আসুন। দেখুন আপনার চারপাশ। এই সুন্দর পৃথিবীর আলো বাতাস উপভোগ করুন। জীবন তো একটাই কেনই বা এত ছেড়াকাঁটা একে নিয়ে। জীবনকে উপভোগ করুন। বর্তমানে বাঁচুন।
#লেখাটি আমিসি পি ঝা’র ‘Being in the now’ শিরোনামে লেখার ভাবানুবাদ। লেখাটি সায়েন্টিফিক আমেরিকান মাইন্ডে প্রকাশিত।
Leave a Reply