১৯৮১ সালের এক লেকচারে রিচার্ড ফাইনম্যান বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন- কেমন হয় যদি সম্পূর্ণ মহাবিশ্বকে কম্পিউটারে সিমুলেট করা যায়! এ কাজের জটিলতা হল খুব ক্ষুদ্র স্কেলে আমাদের মহাবিশ্ব অদ্ভুত নিয়মের অধীনে কাজ করে। একই সময়ে কণা থাকতে পারে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়; অনেক দূরে থেকেও পরস্পরের দ্বারা তাৎক্ষণিক ভাবেই প্রভাবিত হতে পারে; পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে পরিবর্তীত হয়ে যেতে পারে বাস্তবতার স্বরূপ।
তাই সেই লেকচারে তিনি বলেছিলেন:
প্রকৃতি ক্লাসিকাল নয়, তাই যদি প্রকৃতির সিমুলেশন বানাতে চাও, সেটাকে হতে হবে কোয়ান্টাম মেকানিকাল।
কোয়ান্টাম কম্পিউটার
ফাইনম্যান কল্পনা করে গেছেন এমন এক কম্পিউটারের যার বিটগুলো কোয়ান্টাম কণাদের মত আচরণ করে। আজ প্রায় ৪০ বছর পর সেই প্রযুক্তি বাস্তব হতে চলেছে, এবং তা কণাপদার্থবিদ্যায় তৈরি করবে নতুন দিগন্ত।
“পার্টিকেল ফিজিক্সে আমরা যে সিস্টেম নিয়ে কাজ করি তা আসলে কোয়ান্টাম মেকানিকাল সিস্টেম”, বললেন ফার্মিল্যাবের সায়েন্টিফিক কম্পিউটিং বিভাগ প্রধান Panagiotis Spentzouris। আরো বললেন- “ক্লাসিকাল কম্পিউটার দিয়ে বৃহৎ এনট্যাঙ্গেলড কোয়ান্টাম সিস্টেমকে সিমুলেট করা যায় না। অনেক সমস্যা আছে যেগুলো আমরা কোন রকম আন্দাজ বা অনুমান না করে নিখুত ভাবে সমাধান করতে চাই। এবং আমরা আশা করি কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে সেটা করা যাবে।”
ক্লাসিকাল কম্পিউটারে যেমন বিট থাকে যা হয় অন অথবা অফ, কোয়ান্টাম কম্পিটারে সেটা অন্যরকম, এক্ষেত্রে এটা কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিট। এটা হতে পারে অন বা অফ এমনকি হতে পারে অন-অফের সুপারপজিশন। ফলে এটা হিসাবকার্য ক্রমানুসারে না করে সব একই সাথে করতে পারবে।
এটা শুধু হিসাবের গতি বাড়ায় না, অসম্ভবকে করে তুলে সম্ভব। একটা সমস্যা যা সাধারণ কম্পিউটারকে ইনফিনিট লুপে আটকে দিতে পারে- তা অনায়াসে মুহূর্তের মধ্যে স্মাধান করতে পারে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। এই দ্রুতগতির বিশ্লেষণ ক্ষমতা কণাপদার্থবিদদের জন্য বিশাল হাতিয়ার- কারণ তাদের প্রতিনিয়ত ডিটেক্টর থেকে পাওয়া প্রচুর ডাটা নিয়ে কাজ করতে হয়।
এটা যে কতটা সম্ভাবনাময় ও ক্ষমতাশালী সেটা ক্যাল্টেকের এক গবেষক দল দেখিয়েছেন। সম্প্রতি তারা কোয়ান্টাম আনেলার (quantum annelar) নামের বিশেষ কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে পুনরায় হিগস বোসন আবিষ্কার করেছেন। হিগস বোসন এটা সেই কণা যা স্ট্যান্ডার্ড পার্টিকেল মডেলের সকল কণাকে ভর দান করে।
এই হিগস বোসন প্রথম আবিষ্কার হয় ২০১২ সালে, ইউরোপের গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্নের লার্জ হ্যড্রন কলাইডার দিয়ে। তারা তা করেছিলেন কণা সংঘর্ষে উৎপন্ন শক্তি কে সাময়িক ভাবে কণায় রূপান্তর করে। এই সাময়িক হিগস বোসন খুব দ্রুত শক্তি বিকিরিত কতে চিরচেনা কণায় পরিণত হয়, যে ডিটেক্টরে ধরা পড়ে।
রূপান্তরিত হওয়া এসব কণার ভর যোগ করে বিজ্ঞানীরা হিগস বোসন ভর বের করলেন। কিন্তু এই হিসাব করতে গিয়ে তাদের জানে হয়েছে কোন কণারা এসেছে হিগস ক্ষয়ের ফলে আর কোন গুলো অন্য কোন উপায়ে। তবে ডিটেক্টরে এই হিগস ক্ষয়ের বিকিরণ অন্য বিকিরণের মতই। তাহলে উপায়?
LHC এর বিজ্ঞানীরা একটা মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ট্রেইন করেন এই হিগস সিগনালকে খুজে পাওয়ার জন্য। এ যেন খড়ের গাদায় সূচ খোঁজা! এই ট্রেইনিং পদ্ধতি দরকার পড়ে প্রচুর পরিমাণ সিমুলেটেড ডাটা।
পদার্থবিদ Maria Spiropulu ছিলেন হিগস আবিষ্কারক দলের একজন। তিনি এই পদ্ধতিকে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং দিয়ে উন্নত করে চেয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ক্যাল্টেকের গবেষক দল D-Wave নামের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার ব্যবহার করেন। তারা দেখলেন কোয়ান্টাম কম্পিউটার এ কাজে যে পরিমাণ ডাটা ব্যবহার করছে তা প্রচলিত পদ্ধতির চেয়ে অনেক কম। ফলে অ্যালগরিদমে বেশ গতি এসে গেল। বিষয়টা এমন যে খড়ের গাদায় সূচ অনুসন্ধানিকে এমন ট্রেইনিং দেওয়া যেন খড়ে তার দৃষ্টি হারিয়ে যাওয়ার আগেই সূচের চাকচিক্য নজরে পড়ে।
“মেশিন তো সহজে শিখতে পারে না, দরকার হয় অনেক অনেক ডাটা”, বললেন Spiropulu, “তবে কোয়ান্টাম আনেলারে আমরা আভাস পেলাম এটা শিখতে পারে অল্প ডাটা দিয়েই এবং অল্প ডাটা দিয়ে শিখে সেটাকেই পরবর্তীতে প্রাথমিক শর্ত রূপে ব্যবহার করা যাবে।”
কিছু বিজ্ঞানীর মতে পার্টিকেল ফিজিক্সে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের উপযোগী ব্যবহার আসতে লাগবে আরো বছর দশকের বেশি। ততদিন তারা গবেষণার উন্নয়নে অভিনব পদ্ধতি আবিষ্কারে অব্যাহত থাকবেন।
কোয়ান্টাম সেন্সর
কোয়ান্টাম মেকানিক্স পার্টিকেল ফিজিক্সের আরো একটা প্রযুক্তিকে ব্যাহত করে, সেটা হল সেন্সর। কারণ ডিটেক্টরের এই অংশ কণাদের মিথস্ক্রিয়ার শক্তি গ্রহণ করে।
কোয়ান্টাম জগতে শক্তি বিচ্ছিন্ন (discrete)। কোয়ান্টাম শব্দের অর্থ হল “নির্দিষ্ট পরিমাণ” আর পদার্থবিজ্ঞানে এটার মানে “শক্তির ক্ষুদ্রতম পরিমাণ”। সাধারণত ক্লাসিকাল সেন্সরের ক্ষমতা নেই শক্তির এই কোয়ান্টা হিসাব করার। কিন্তু নতুন ধরনের কোয়ান্টাম সেন্সরের তা আছে।
ফার্মিল্যাবের বিজ্ঞানী Aaron Chou এ সম্পর্কে বলেন, “কোয়ান্টাম সেন্সর শক্তির প্রতিটি প্যাকেটকে স্বতন্ত্রভাবে হিসাব করতে পারে। নন-কোয়ান্টাম সেন্সর এভাবে পারত না, বরঙ আগত শক্তির প্রবাহকে একসাথে হিসাব করত।”
বিজ্ঞানী Chou কোয়ান্টাম সেন্সরের এই সম্ভাবনা ব্যবহার করে ডার্ক ম্যাটারের প্রকৃতি বুঝতে চাচ্ছেন। তার ব্যবহৃত প্রযুক্তি গড়ে উঠেছে মূলত কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মুলনীতির উপর। Chou আর তার গবেষক দল নির্মাণ করছেন অতিসংবেদনশীল ডিটেক্টর। লক্ষ্য axion নামের বিশেষ ধরনের ডার্ক ম্যাটারের অস্তিত্ব শনাক্ত করা।
তিনি এ বিষয়ে জানালেনঃ “কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এর জন্য যেসব কিউবিট ডিজাইন করা হয়েছিল আমরা সেগুলোর একটা কাজে লাগিয়েছি । আমরা বর্তমানে ডার্ক ম্যাটার থেকে আসা ফোটন পরিমাপ করার চেষ্টা করছি।”
বিজ্ঞানী Spiropulu এর মতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রয়োগ প্রযুক্তির ও গবেষণার অগ্রগতিতে নতুন দিগন্ত আনতে চলেছে। পূর্বে পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এসেছে ট্রানজিস্টর, যা ঘটিয়েছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের বিপ্লব। আর কম্পিউটার প্রযুক্তির সেই উন্নয়নই এখন পদার্থবিদ্যার গবেষণায় প্রধান অংশ।
আধুনিক বিজ্ঞানের এই যুগে পদার্থবিদ্যার নীতি ও রূপরেখা ব্যবহার করে কম্পিউটার বিজ্ঞানকে উন্নয়ন করা হচ্ছে জটিল বৈজ্ঞানিক সমস্যা সমাধানের জন্য। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় প্রযুক্তিকেও রপ্ত করতে হবে কোয়ান্টাম জগতের ভাষা।
সূত্রঃ সিমেট্রি ম্যাগাজিন
[ লেখাটি বিজ্ঞান ম্যাগাজিন ধ্রুবক (সংখ্যা #৩, ২০১৯)-এ প্রকাশিত ]
Leave a Reply