আজকে দুইটা বই নিয়ে পর্যালোচনা করছি একসাথে। দুইটা বই কারন এরা একই ঘরাণার এবং একইরকম বই। দুজন সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ের এবং ভিন্ন ধরনের লেখকের যদিও। সেজন্য তুলনাটা এবং একসাথে পর্যালোচনাটা বেশ কৌতুহলি হওয়ার কথা। প্রথম বই হলো রাগিব হাসান লিখিত ‘বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানা’, আর দ্বিতীয়টি হলো অতনু চক্রবর্ত্তী রচিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’। দুটো বইই তাদের প্রথম পর্ব শেষ করেছে আগের বা আগের কয়েক বছরে। এই বইগুলি পরবর্তী পর্ব।
বইদুটি বিভিন্ন প্রতিভাবান বিজ্ঞানীকে নিয়ে। রাগিব হাসানের বইটি মূলতঃ পৃথিবীর সকল ধরনের, সকল ভাষার, সকল জায়গার বিজ্ঞানীকে তুলে ধরেছে। আর অতনু চক্রবর্ত্তীর বইটা শুধুমাত্র বাঙালী বিজ্ঞানীর জীবনকল্পের বর্ণনা। রাগিব হাসানের বিজ্ঞানীরা কেউ কেউ বেশ বিখ্যাত, অর্থাৎ প্রথিতযশা। অতনুর বিজ্ঞানীরা বেশিরভাগই সেরকম নয়। বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানাতে বিজ্ঞানীদের মজার আর কৌতুহলকর বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেছেন লেখক, অন্যদিকে মেঘে ঢাকা তারাতে বিজ্ঞানীদের অজানা জীবন আর আবিষ্কারের ছবি এঁকেছেন লেখক। রাগিব হাসান একজন শিক্ষক আর গবেষক, অতনু একজন ছাত্র আর গবেষক। দুজনই লেখালেখি পছন্দ করেন আর আমাদের বাংলাভাষায় বিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন নিত্য। তাদের সাধুবাদ জানিয়েই শুরু করছি।
বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানা – ৩ বইয়ের শুরুতেই রাগিব হাসান বলছেন এই সিরিজের আগের দুটি বইয়ের মতোই তার সন্তানদের গল্পে গল্পে বিজ্ঞানীদের কাহিনী জানানোর চেষ্টা থেকেই এই বইয়ের সৃষ্টি। এটাই তার উৎসাহ। বেশ চমৎকার একটা ব্যাপার। আর একারনে পুরো বই জুড়েই সহজভাবে আবিষ্কারের ইতিহাস আর বিজ্ঞানীদের জীবনীকে ধরার একটা প্রচেষ্টা চোখে পড়ে। বইটা লেখা হয়েছে সববয়সী পাঠকের কথা চিন্তা করে। একজন কিশোর বা কিশোরীর মতো একজন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাও কৌতুহলী হবেন বইটা পড়ে।
বইটাতে আছে ১৫ জন বিজ্ঞানীর গল্প। এখানে একে একে নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড নোবেল থেকে শুরু করে বাঙালী স্থাপত্যবিদ ফজলুর রহমান খান, আবার বংশগতিবিদ্যার জনক গ্রেগর মেন্ডেল থেকে হলিউড সুন্দরী হেডি লামারের উদ্ভাবন আর আবিষ্কার এবং জীবনের মজার গল্পগুলি উঠে এসেছে। গল্পগুলির সাজানোতে কোন সময়ক্রমের হিসেব নেই, লেখক নিজের পছন্দানুযায়ী ক্রম ঠিক করেছেন। সেজন্য ইতিহাসকে এই গল্পগুলি দিয়ে ধরতে গেলে ঝামেলা হবে; বরং এটা ইতিহাসের খন্ডগুলির কিছু চিত্র। আলফ্রেড নোবেলকে তো চেনেনই, ডিনামাইট আবিষ্কারক, নোবেল পুরষ্কারের প্রবর্তক। ডিনামাইট আবিষ্কার করতে গিয়ে তিনি এক ‘দূর্ঘটনাক্রমে আবিষ্কারের’ সম্মুখীন হয়েছিলেন। যেমন, ডিনামাইটের উপাদান নাইট্রোগ্লিসারিন মেঝেতে পড়লে যেখানে বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে ঘটনাক্রমে বালি থাকায় বিস্ফোরণ ঘটেনি। এই গুণকে পরবর্তীতে বিস্ফোরক উৎপাদনে কাজে লাগানো হয়েছে। এটা পড়ে আমার আরও কিছু এমন দৈবাক আবিষ্কারের ঘটনা মনে পড়ে গেলো। প্রোটিনের ত্রিমাত্রিক গঠন থেকে শুরু করে ডিএনএর ক্রম কিভাবে বংশগতির সূত্র ধারণ করে এসব বহু আবিষ্কারের পেছনেই দৈবক্রমের দূর্ঘটনার উদাহরণ দেয়া চলে। আসলে এই দৈব আবিষ্কারগুলি নিয়ে একটা মজার বইই লেখা চলে।
বইটিতে বেশ কিছু অজানা, কিন্তু হাস্যরসাত্মক ইতিহাসের উল্লেখ আছে। একটা উদাহরন দেয়া চলে অধ্যাপক সালামের জীবনের। তার কন্যা বিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা পড়াশোনায় শিক্ষকের কাছ থেকে বেশ সমস্যাতেই পরেছিলেন। শিক্ষককে তার বাবা, বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ সালামের কিছু উত্তর বা সমস্যার বর্ণনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কন্যাকে শুনতে হয়েছিলো – ‘তোমার বাবা পদার্থবিদ্যার কিছুই জানে না।’ চমৎকার একটা উদাহরন এটা আমাদের জন্য। প্রথমতঃ আমরা যখন কোন বিষয়ে খুবই একগুঁয়েমি করতে যাই তখন সেই বিষয়ের সবচেয়ে বিজ্ঞ মানুষটার কথাাবার্তাকেও অথর্ব মনে হয়, এই ভাবনা আমাদেরকে মাটির কাছাকাছি রাখতে সাহায্য করতে পারে। দ্বিতীয়ত, আপনি যত বড় গবেষকই কোন বিষয়ের হোন না কেন, বাইরের জগতের মানুষ আপনাকে বোকা ভাবতে পারে, এই ভাবনাও আমাদেরকে বিনয়ী করতে সাহায্য করতে পারে। দুটো থেকেই শিক্ষার বিষয় আছে।
চোরকাটার মতো কুকুরের গায়ে কোন কাঁটাওয়ালা বীজ লেগে যাওয়া থেকে কিভাবে খুবই উপকারী ব্যবহার্য্য উপাদান তৈরি সম্ভব, প্রাদ্রীত্ব করতে গিয়ে উদ্ভিদপ্রেমে কিভাবে সম্পূর্ণ একটি জীববিজ্ঞান শাখারই গুরু হয়ে উঠলেন মেন্ডেল, তুমুল অপ্রতিকুলতা থেকে প্রফেসর আবদুস সালাম কিভাবে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হয়ে উঠলেন, হলিউডের অভিনেত্রী থেকে কিভাবে যুদ্ধসহায়ক উদ্ভাবকে রূপান্তরিত হলেন – এসব বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু কিছুটা অজানা ইতিহাস জানাটা সত্যিই চমকপ্রদ। অংকের পাগলামিতে আরডিশ আর রকেট আবিষ্কারে হডার্ড, পিথাগোরাস থেকে আইনস্টাইন সবার গল্পই খুঁজে পাবেন বইটিতে। আছে দুজন বাঙালী বিজ্ঞানীর কথা – বিশ্বজোড়া খ্যাতিসম্পন্ন স্থাপত্যবিদ ফজলুর রহমান খান আর তুমুল প্রতিভাবান অংকের রাজা, রাধানাথ শিকদার।
দ্বিতীয় বইটি আসলে সম্পূর্ণ বাঙালী বিজ্ঞানীদের নিয়েই লেখা, আগেই বলেছি। মেঘে ঢাকা তারা – ২, আগের বইটার মতোই এখানের প্রচ্ছদে উল্লেখ আছে, ‘বিস্মৃতির আড়ালে ঢেকে যাওয়া বাঙালী বিজ্ঞানী’, মানে বিস্মৃত বিজ্ঞানী যারা বাঙালী ছিলেন তাদের নিয়েই এই বই। অর্থাৎ প্রথম খন্ডের মতোই। জৈবরসায়নাবিদ হরিনাথ দে থেকে শুরু করে উদ্ভিদতত্ত্ববিদ কানাইলাল দে পর্যন্ত বেশ কম জানা বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী বা গবেষকের গল্প আছে এই বই জুড়ে। শারীরতাত্ত্বিক রুদ্রেন্দ্রকুমার পাল, পক্ষিবিদ সত্যচরণ লাহা, ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ কেদারনাথ দাস, ফরেনসিক বিজ্ঞানী নির্মল কুমার সেন, জীব-পদার্থবিজ্ঞান গবেষক নীরজনাথ দাশগুপ্ত, খাদ্যবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ চুনীলাল বসু, মৃত্তিকাবিজ্ঞানী সুশীলকুমার মুখোপাধ্যায় – এই স্বস্ব ক্ষেত্রে তারকা হয়ে ওঠা গুণীজনদের গল্প উঠে এসেছে মেঘে ঢাকা তারায়। ইতিহাস মেঘে ঢেকে ফেলতে চাইলেও যে মেঘ এমন তারকারাজিকে গ্রাস করতে পারেনা কখনই সেটা অতনু প্রমাণ করছেন তার লেখায়।
গল্পগুলির মধ্যে আমার সবচেয়ে বেশি চমকপ্রদ লেগেছে ড. হরিনাথ দের কথা। পুরানো ঢাকা থেকে তাকে তুলে নিয়ে যায় হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময়। ধরে নিয়ে আশা অমুসলিম লোকগুলিকে ব্রাশফায়ার করে মেরে ফেলা হয়। বইটিতে সেই দশজন মৃত শহীদের স্মারকবেদির নামফলক তুলে দেয়া আছে। দেখে চোখের কোণে পানি জমা বেশ স্বাভাবিক। অকুতভয় এই গবেষক, হরিনাথ দে, দীপ্তকন্ঠে জানিয়েছিলেন তারা কোন ধর্মের। মেরে ফেলা মানুষগুলোর মধ্যে তিনি একজন। একজন শহীদ বুদ্ধিজীবি তিনি। মৃত্যুর আগে ঢাকায় জন্মলাভ করা এই গবেষক বাংলাদেশের মানুষের খাদ্যের পুষ্টিমান নিয়ে কাজ করেছেন। বঞ্চিত একটা দেশের মানুষের জন্য যা ছিলো অসামান্য অবদান। ২৫ মার্চের কালোরাতে যাকে সবাই অনুরোধ করেছিলো ভীনদেশে পাড়ি জমাতে সেই লোকটা নিজের দেশকে ভালোবেসে থেকে গিয়েছিলেন এবং পাকবাহিনীর নৃশংসতার বলি হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমার আগের একটা ভাবনা আমি এখানে তুলে ধরছি। একজন জ্ঞানী মানুষের বেড়ে ওঠা বহু পরিশ্রম আর ত্যাগ তিতীক্ষার ফলাফল। এর পেছনে যেই সময় আর প্রচেষ্টা দেয়া হয়েছে সেটা অসামান্য। কিন্তু যারা তেমন কোন ব্যক্তিকে মেরে ফেলতে পারেন তাদের এই মেরে ফেলার কারনের পেছনে তেমন কোন প্রচেষ্টারই প্রয়োজন পরেনা। হঠাৎ ডাকাতি করতে মনে হলো, বা পাকবাহিনীর মতো নৃশংসতা করতে মনে হলো তো একটা গুলি খরচে দুই সেকেন্ডে এমন একটা মেধা মেরে ফেললেন। মেরে ফেলতে সেকেন্ড প্রয়োজন, গড়ে উঠতে বহু বছর।
দুটি বইয়ের মধ্যে একজন গবেষক সাধারন আছেন, দুজন লেখকের অজান্তেই ধারণা করি। স্থাপত্যবিদ ফজলুর রহমান খান। দুইটি বইয়ের লেখকই প্রথিতযশা বাঙালির একটা ছবি তুলে ধরেছেন তাদের বইয়ে। ছবিটা হলো তার সমাধিফলক। শিকাগোর সমাধিস্থলের এই সমাধিফলকে লেখা – তোমার হলো শুরু, আমার হলো সারা। রবিঠাকুরের এই গানকে খোদাই করা হয়েছে সম্ভবত শুয়ে থাকা মানুষটার অনুরোধেই। এই অধ্যায়দুটি পড়লে দুজন লেখকের লেখার ধরন আর লেখায় অভিগমনকে বেশ তুলনা করা চলে। পাঠকদের কৌতুহলকে বজায় রাখতে আমি এই দুটি অধ্যায় নিয়ে আর কিছু লিখছি না।শুধু এতোটুকু যুক্ত করি, পৃথিবীজুড়ে অসামান্য কীর্তির জনক এই মানুষটা মারা গিয়েছেন আমার জন্মের আগেই। কিন্তু তার কথা পড়ে আমরা বড় হয়েছি। নতুন প্রজন্মের কাছে এই মানুষটার জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতুহলি কথা তুলে ধরা দুটি বইয়েরই গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে হয়েছে। অতনুর বইয়ে স্মৃতিসৌধের স্থাপত্যবিদ সৈয়দ মইনুল ইসলামের জীবনীও বিবৃত। মানুষ এই মানুষটার কথা খুব বেশি চর্চায় আনেন না, তার বিষয়ে গবেষক বা শিক্ষার্থী ব্যতিত। স্মৃতিসৌধের স্থাপনা নিয়ে তুলে দিচ্ছি এই বইয়ের একটু অংশ –
“১৯৭১ সালে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলােদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত নতুন সরকার মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৗধ নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। সেই লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৗেধের ভিত্তিপ্রস্ত্বর স্থাপন করা হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধ স্থাপনার বাস্তবায়নকল্পে তিন ধাপে স্থাপত্য পরিকল্পনার কাজ শুরু হয় যা শেষ হয় ১৯৮২ সালে। সাভারে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রথম ধাপে ৮৪ একর জমি অধিপ্রহণ করা হয়। পরবর্তী ধাপে ১৯৭৬ সালে এই প্রকল্পের জন্যে প্রতিযোগিতমূলক একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে স্থাপত্য সজ্জা (Architectural Design) আহ্বান করা হয়। এই প্রতিযোগিতায় নির্বাচকমন্ডলীর সভাপতি ছিলেন সেই সমেয়র আরেকজন বিখ্যাত স্থপতি মাজহারুল ইসলাম। প্রথমবার কোন প্রতিযাগীই নির্বাচিত হতে পারেন নি।কিন্তু দ্বিতীয় বার প্রতিযোগিতায় বিশটির মত ডিজাইন জমা পড়ে। যার মধ্যে কেবল মাত্র সেই সময়ের তরুণ স্থপতি মাইনুল হােসেনের নকশা রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত হয়। এর তিন মাসের মধ্যে স্থপতি মাইনুল চূড়ান্ত নকশার কাজ শেষ করেন।”
স্থপতি মাইনুলের বেশ কিছু ছবিসহ এই অধ্যায়টি পূর্ণতা পেয়েছে। স্মৃতিসৌধের নকশা আর গড়ে ওঠার সময়কার ছবিগুলিসহ এই অধ্যায়টি বেশ চমকপ্রদ! বইটিতে একে একে বর্ণিত আছে বেশ কয়েকজন কৃতী বাঙালীর কথা, যাদের নাম হয়তো আপনি কখনও শোনেননি। বাঙালীকে আমরা খুব সহজেই গালমন্দ করি আর অকর্মণ্যতার উদাহরন হিসেবে বর্ণনা করার চেষ্টা করি। কিন্তু এই বইটা পড়লে সেই ধারণায় আঘাত লাগার কথা। যদিও বইটির মাত্র তিনটি অধ্যায় ‘বাংলাদেশি’ বাঙালী নিয়ে তারপরও এটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য শেখার আর নিজেদের সম্বন্ধে নতুন ধারণা জন্মানোর একটা ভালো মাধ্যম।
অতনুর বইতে এতো কম বাংলাদেশি বাঙালির উপস্থিতির কারন আমি বুঝতে পারি। প্রথমত, আমরা ভারতীয় বাঙালী বিজ্ঞানীদের নিয়ে খুব বেশি জানিনা। দ্বিতীয়ত, যতটুকু জানি সেসব খুব বেশি বিখ্যাত মানুষগুলোকে নিয়ে, যাদেরকে বিভিন্ন উপন্যাস বা ইতিহাস লেখায় খুঁজে পাই অহরহ। এই বইয়ের গবেষকগণ সেরকম নন, তাদের কথা বেশিরভাগ বাংলা ইতিহাসে উহ্য থাকে। সেই দিক দিয়ে মেঘে ঢাকা তারা বইটা বেশ গুরুত্বই বহন করে। আমি আশা করবো আধুনিক সময়ের বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের নিয়েও অতনু পরবর্তীতে কলম ধরবেন।
অতনু চক্রবর্ত্তী আর রাগিব হাসানের বই দুইটি, তাদের সম্পূর্ণ সিরিজ চিন্তায় এনেই, বাংলা বিজ্ঞানবইয়ের জগতে বেশ গুরুত্ব বহন করে। বিশেষ করে হবু গবেষক আর নবপ্রজন্মের জন্য। এইসব বিখ্যাত মানুষজনের খুব সাধারন ঘটনাগুলি আমাদেরকে তাদের সাথে মানসিক সম্পর্ক তৈরি করতে সাহায্য করে। আমার তরুনবেলায় আমি যেমন ডিএনএর গঠন আবিষ্কার, প্রোটিনের কাজ নিয়ে গবেষণা করা মহান বিজ্ঞানী, জার্মানির কোন বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানীদের সমাবেশের গল্প ইত্যাদি পড়ে বিজ্ঞান গবেষণায় নিয়োজিত হয়ে স্বপ্ন দেখেছি। কেউ যদি এই কীর্তিমান মানুষদের নিয়ে না লিখতে তবে আমার পড়াও হতোনা। লেখকদের কাছে সেজন্য আমি চীরঋণী।
দুটি বইয়েই কিছু সমস্যা আমি তুলে ধরতে পারি, যেগুলিকে একেবারেই নগন্য সমস্যা হিসেবে ধরে নিলে আমি খুশি হবো। দুটো সমস্যা এখানে উল্লেখ করছি। প্রথমটা হলো, লেখাগুলিতে সুসঙ্গত গল্পের ছলের কিছু অপর্যাপ্ততা রয়েছে। গল্পগুলির ঘটনাগুলি মাঝেমধ্যে হঠাৎ আবির্ভূত। হয়তো বিভিন্ন বিচিত্র মানুষের জীবনের বিচিত্র ঘটনাকে ছোট করে ধরতে গিয়ে এই ব্যাপারটা ঘটেছে। লেখকেরা গুণী মানুষ, হয়তো পরবর্তীতে পরিবর্তন করে নেবেন কিছু। দ্বিতীয়টি হলো, অলংকরণের অভাব। এটাকে আমার কিছুটা বড় সমস্যা মনে হয়েছে, দুটির মধ্যে। যেমন, প্রতিটা বিজ্ঞানীকেই যদি রেখাচিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরা যেতো প্রতি অধ্যায়ে তবে বেশ হতো। প্রতিটা বিজ্ঞানী/গবেষক/কীর্তিমানের অবয়বকে এভাবে শিল্পীর তুলি বা কালিতে বেশ চমৎকার যেমন লাগতো তার সাথে এটা পুরো বইকেই আরও চমৎকার করে তুলতো। আমি বিজ্ঞানীদের কাণ্ডকারখানা বইগুলির প্রচ্ছদের ভক্ত, সেটা লেখককে আগেই জানিয়েছিলাম, মেঘে ঢাকা তারার প্রচ্ছদও বেশ। কিন্তু বইয়ের অভ্যন্তরেও যদি এই চমকপ্রদতাকে বিস্তৃত করা যেত তবে বেশ হতো।
দুটো বইকে নিয়েই আমার মন্তব্য হলো এমন বই বাংলায় যতো বেশি সম্ভব রচনা হওয়া প্রয়োজন। পৃথিবীর প্রতিভাবান মানুষেরা, যারা ইতিহাসকে তৈরি করেছেন তাদেরকে আমাদের সামনে তুলে আনেন এমন ‘নন-ফিকশান’ লেখকেরাই বেশি। বিজ্ঞান নিয়ে লেখার বাংলায় অভাব রয়েছে। বিজ্ঞানীদের কথা, গল্প, জীবন আমাদের তরুনদের উৎসাহ যোগাবে। বাঙালী, গবেষক, বিজ্ঞানী এবং মানুষ হিসেবে আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলবে, স্বপ্ন দেখতে শেখাবে। লেখকদের কাছে আমার তিনটি অনুরোধসহ শেষ করছি। প্রথম, আমি আশা করবো লেখকেরা এমন কোন মাধ্যমে তাদের বই প্রচার করবেন না যারা আগে অন্য সহলেখকের স্বাধীনতা হরণ করেছিলেন মৌলবাদিতার কাছে হার মেনে। দ্বিতীয়, নতুন নতুন বিজ্ঞানশব্দের বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি এবং ব্যবহার করে বাংলার বিজ্ঞানকে আরও ঐশ্বর্যশালী করতে সাহায্য করবেন। এবং তৃতীয়, এমন চমৎকার সব বই লিখে যাবেন।
দুটো বইই সুসফল হোক। শুভেচ্ছা।
****************************************
কেউ যদি তাদের সাধারণ বিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞানের বই পর্যালোচনা আমাকে দিয়ে করাতে চান তবে নিচে উক্ত ইমেইল ঠিকানায় নিজের বইটার একটা পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেবেন অনুগ্রহ করে। আমি পড়ে আলোচনা করবো। এতে আপনার লাভ হলেও হতে পারে, তবে আমার লাভ নিশ্চিতভাবেই হবে। আমি বিনামূল্যে বাংলা বিজ্ঞানবই পড়তে পারবো। সাথে একটা ঝুঁকি অবশ্য আপনার থাকছে। নির্মোহ আলোচনা করতে গিয়ে আপনার বইয়ের কিছু সমালোচনাও হতে পারে। সেটা খুব খারাপও কিছু নয় ভাবতে পারেন। প্রচারটাও একটা প্রাপ্তিই বটে। আমাকে নিজের বই ইমেইল করতে পারেন এই ঠিকানায় – ktosman@gmail.com ।
Leave a Reply