সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের রোগ জীবাণুর গল্প শিরোনামে যে বইটি বেরিয়েছে সেটার পর্যালোচনা করছি আজকে। বইটি এবারের বইমেলায় বেরোল অনেকটা তার প্রথম বইয়ের দ্বিতীয় খন্ড হিসেবে। প্রথম বইটি গত বইমেলাতে প্রকাশ হয়েছিলো, গল্পে গল্পে অণুজীব আবিষ্কার। নোয়াখালি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীব বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক সঞ্জয় তার বিষয় নিয়েই চমৎকার সব চিন্তাভাবনা, আবিষ্কারের কাহিনী আর গবেষণার সম্ভাবনাগুলোকে গল্পে তুলে এনে বইটি রচনা করেছিলেন। নিজের পড়াশোনার বিষয়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা আর আবেগের রূপায়ণ হলো তার লেখালেখি, বোঝা সম্ভব। তবে ঘটনাটা বিপরীতও হতে পারে, হয়তো জীবাণুদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই তার এই বিষয়ে পড়তে আসা। এই ধাঁধার উত্তর অবশ্য আমরা কেউ জানিনা। আমরা তার লেখা পড়ে বোঝার চেষ্টা করি ভালোবাসার ধরণ। রোগ জীবাণুর গল্প বইটাও একই মানের ভালোবাসার প্রকাশ।
অনুপ্রেরণা হিসেবে ড. জাফর ইকবালকে উল্লেখ করছেন সঞ্জয়, তাকেই উৎসর্গীত এই বই। শুরুতেই বলে রাখছেন এই প্রথম বইয়ের মতো এই বইও ভাতিজা-ভাতিজি টুকটুকি আর আসিফের সাথে আলোচনার বিবরণ। সঙ্গে অল্পকিছু অন্যান্য চরিত্রেরও আগমন ঘটেছে গল্পের খাতিরে। রোগ তৈরি করা ভয়ঙ্কর জীবাণু যেমন আছে, তেমনি আছে অ-ক্ষতিকর জীবাণু – এদের ইতিহাস আর গল্পই বইটার উপজীব্য। ভূমিকাতে বইটার প্রশংসাই করেছেন লেখক চমক হাসান। সংক্ষেপে বইয়ের মূল উপজীব্য তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে অধ্যায়ের শিরোনামগুলির প্রশংসা ঝরেছে তার মন্তব্যে। আমারও বেশ ভালো লেখেছে বেশ কিছু শিরোনাম। যেমন, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, জঙ্গলে ভোর হলো, আহা আজি এ বসন্তে, অতিথিদের মারতে নেই – এই অধ্যায়গুলোকে যদি ভেতরে বর্ণিত বিষয় বা গল্পগুলির সাথে মিলিয়ে পড়া যায় তবে শিরোনামের যথার্থতা আসলেই সুস্পষ্ট। বলে রাখা ভালো, শুরুতে লেখক বলছেন যে এই বইটি ছোট বা নবীন পাঠকদের উদ্দেশ্য করে লেখা। সেই ভাবনা থেকে জীবজগৎকে সহজ করে বর্ণনা করার একটা প্রয়াস পুরো বই জুড়েই আমার কাছে দৃশ্যমান হয়েছে।
বইটার প্রথম অধ্যায়টা আসলেই চমকপ্রদ! লেখক প্রথমেই প্রাণের উদ্ভব আর বিবর্তনের ধারণা একজন নবীন পাঠকের সামনে তুলে ধরছেন এই অধ্যায়ে। একে একে জীবাণুরা কোথা থেকে এলো, প্রাণের উদ্ভব কিভাবে হলো, বিবর্তনের মাধ্যমে মানুষের উদ্ভবের প্রাথমিক ধারণা আর রাসায়নিক বিবর্তনে প্রাণের ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে সহজ ভাষায়। লেখক বলছেন, দুধ থেকে যেমন বহু ধরনের খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন সম্ভব তেমনি একটা সাধারণ আদি স্তন্যপায়ী থেকে আমাদের আধুনিক বিনর গোত্রের প্রাণীর (যেমন আমরা) উদ্ভব সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত এবং প্রমাণিত বৈজ্ঞানিক ধারণা। শুরুতেই প্রকন্প বা অনুমিত ধারণা বা ইংরেজিতে যাকে বলে হাইপোথিসিস তার সাথে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কাকে বলে তার একটা তুলনামূলক ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা হয় আসিফকে। সেজন্য বিবর্তনকে সে প্রথমেই বুঝতে পারে বিজ্ঞানীরা একে কোথায় অবস্থিত করেছেন। বইটার শুরুতেই সেজন্য পাঠক ধারণা করতে পারেন যে বিশ্বের জীববিজ্ঞান নিয়ে যেই প্রতিষ্ঠিত আধুনিক ধারণাগুলি আছে সেটাকে উপজীব্য করেই লেখক বইটাকে বুনেছেন। এদিক দিয়ে প্রথম অধ্যায়ের যথার্থতা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র কোন প্রশ্ন নেই। প্রশ্ন যেখানে আছে সেটা হলো এই অধ্যায়ের শিরোনামটি নিয়ে, জীবাণুর জন্মদিন কেন লেখক এই অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন সেটা আমি ভালোভাবে বুঝিনি। হয়তো শুরুর কথা বোঝাতে, যেটা এই অধ্যায়ের প্রধান ভাব।
এভাবে একে একে বহুকোষী জীবের উদ্ভব, উদ্ভিদের মতো জটিল কোষ কিভাবে সৃষ্টি হলো, আমাদের দেহে জীবাণুর আড্ডাখানা কেমন, কলেরার মতো বিভৎস রোগের সংক্রমণের তত্ত্ব, প্লাসিবো ইফেক্ট, এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণুর উদ্ভব, বসন্তরোগের ইতিহাস, মশাবাহিত রোগগুলির প্রকার আর কারন, প্রাণীতে প্রাণীতে রোগের সংক্রমণের কারন আর ধরন, অতিশীতল তাপমাত্রায় জীবাণুর বেঁচে হাজার বছর থাকার অদ্ভুত কাহিনী, অন্ত্রের জীবাণুর কাজকারবার, কোন ঔষধেই কাজ না করা সুপারবাগের গল্প, কোন ধরনের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাহীন এক শিশুর বেঁচে থাকার সংগ্রাম এবং জীববিজ্ঞানের গবেষণাগার কেমন হয় সেসব বেশ বড় পরিসরের অনেক বৈজ্ঞানিক তথ্য, ধারণা আর আবিষ্কার চমৎকার সব গল্পের ছলে তুলে ধরেছেন সঞ্জয়। বইটার সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো গল্পের ছলে শেখানোর প্রয়াস। নবীন পাঠকদের জন্য সেজন্য খুবই আকর্ষনীয় হবে এই কর্ম। শেখার সাথে সাথে যদি গল্পের মজাটাও পাওয়া যায় তবে তো পোয়াবারো।
রোগ জীবাণুর গল্পে অনেকগুলি ছবি সহায়ক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে আর যার উদ্দেশ্য চমৎকারভাবে সফল বলেই আমার মনে হয়েছে। মোট ৪৬ খানা ছবি, একটা ছোট বইয়ের জন্য বেশ অধিক সংখ্যাই বলা চলে। এর মধ্যে বেশকিছু ছবি প্রথমবার আঁকা এই বইয়ের জন্য, আর যেগুলি অন্য জায়গা থেকে ধার করা হয়েছে তার তালিকা বইয়ের শেষে তুলে দেয়া আছে সূত্রসহ। একটা খটকা হলো প্রথমবার তৈরি ছবিগুলোর কয়েকটায় ইংরেজির ব্যবহার। যেমন, বইয়ের যেই তাকের ছবি প্রথম অধ্যায়েই আছে সেখানে বইয়ের নামগুলি ইংরেজিতে দেয়া। এই ব্যাপারটা কোন কিশোর-কিশোরী-পাঠককে ধন্দে ফেলতে পারে, বা ভুল বার্তা দিতে পারে। তার সাথে আছে একটা ছবিতে গেইম অফ থ্রোন্সের প্রতিনির্দেশ, যা কোনভাবেই কিশোরোপযোগী নয়। লেখক এবং প্রকাশক পরবর্তী সংস্করণ বা খন্ডে এব্যাপারে আরেকটু মনযোগী হবেন বলে আশা রাখছি।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের রোগ জীবাণুর গল্প বইটার সবচেয়ে চমৎকার যেদিকটা আমার মনে হয়েছে তা হলো এখানে সচেতনভাবে বিজ্ঞানের গল্পগুলোকে সহজ করার একটা প্রয়াস আছে। আমার সবসময়ই মনে হয় আবিষ্কারের ইতিহাসের গল্প দিয়ে যদি কোন বিজ্ঞানকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয় তবে তার চেয়ে মজার এবং সহজতম উপায়ে শেখার আর কিছু হয়না। সঞ্জয় বেশ কিছু জায়গায় আবিষ্কারগুলোর ইতিহাসকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। সেটা এই বইয়ের অন্যতম শক্তি। বিজ্ঞানের ঘটনাগুলিকে গল্পে গল্পে তুলে আনার প্রয়াসের সাথে বইটার শিরোনাম একদম মিলে যায় বলে এই বইটা শিরোনামে যথার্থতা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলা সম্ভব নয়। যদিও জীবানুরা বেশিরভাগই মানুষে রোগ তৈরি করেনা, চতুর্থ অধ্যায়েই যার কিছু আঁচ দেয়া আছে, তারপরও যারা রোগ তৈরি করে তাদের নিয়েই এই বই। রোগ তৈরি করা জীবাণুদের আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেই নিজেদের স্বাস্থ্যের কারনে। এদের ছাড়াও বহু জীবাণু আছে যারা আমাদের উপকারই করে, তাদের ছাড়া আমরা বাঁচবোও না। আমার আশা সঞ্জয় পরবর্তী বই তাদের নিয়েই লিখবেন। সেই সাথে রোগজীবাণুকে ব্যবহার করে যে বিপুল ব্যবহারিক সম্ভাবনার দুয়ার প্রতিনিয়ত আধুনিক বিজ্ঞান উন্মোচিত করছে সেটার কথাও সঞ্জয় তুলে ধরবেন বলে আশাবাদ ব্যক্তি করছি।
ছোটদের জন্য জটিল বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বই লিখতে বেশিরভাগ বিজ্ঞানলেখকই চান না কেন জানি। যদিও নতুন প্রজন্মকে বিজ্ঞানের সঠিক পাঠের পরিচয় দেয়াটা একটা বিজ্ঞানমনস্ক জাতি তৈরির প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের মতো লেখকেরা এই আপাত পুরষ্কারহীন কাজটি করে চলেছেন নিষ্ঠার সাথে। কিশোর-কিশোরীকে এমন কিছু বিষয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন লেখক যা বাংলাভাষায় তাদের উপযোগী করে আগে লেখা হয়নি। আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিনের মতো মহান লেখকেরা যেই দায়িত্ব আমাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন সেই হালটা সঞ্জয়রাই ধরছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই বইটার একজন ভক্তে পরিণত হয়েছি। শিশু-উপযোগী বই লিখতে চমৎকার সৃষ্টিশীল মন প্রয়োজন। তার সাথে যদি বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ে পাঠের সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করা হয় তবে সেই বিষয়টার জটিলতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রোগ জীবাণুর গল্প এই নিরীখে চমৎকার সফল একটি কর্ম। শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, সববয়সী মানুষই গল্পগুলোকে অনুভব করবেন এবং পড়ে আহ্লাদিত হবেন বলেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আমি আশা রাখছি বইটি পাঠক হৃদয়কে ছুঁয়ে যাবে।
লেখক এবং প্রকাশক আমার অভিনন্দন গ্রহন করুন।
***********************************************
আর কেউ যদি তাদের সাধারণ বিজ্ঞান বা জীববিজ্ঞানের বই পর্যালোচনা আমাকে দিয়ে করাতে চান তবে নিচে উক্ত ইমেইল ঠিকানায় নিজের বইটার একটা পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দেবেন অনুগ্রহ করে। আমি পড়ে আলোচনা করবো। এতে আপনার লাভ হলেও হতে পারে, তবে আমার লাভ নিশ্চিতভাবেই হবে। আমি বিনামূল্যে বাংলা বিজ্ঞানবই পড়তে পারবো। সাথে একটা ঝুঁকি অবশ্য আপনার থাকছে। নির্মোহ আলোচনা করতে গিয়ে আপনার বইয়ের কিছু সমালোচনাও হতে পারে। সেটা খুব খারাপও কিছু নয় ভাবতে পারেন। প্রচারটাও একটা প্রাপ্তিই বটে। আমাকে নিজের বই ইমেইল করতে পারেন এই ঠিকানায় – ktosman@gmail.com ।
Leave a Reply