(লেখাটি Nature এ প্রকাশিত আর্টিকেল “How stress can cause a fever” এর ভাবানুবাদ)
স্টেজে দর্শকের সামনে কথা বলতে গেলে আমাদের সকলেরই হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়, রক্তচাপ বাড়ে, আমরা ঘামতে থাকি। পাশাপাশি আমাদের দেহের তাপমাত্রা বেড়ে যায়। এই উদ্দীপনার মূলে রয়েছে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া যা আমাদের দেহকে আসন্ন বিপদের মুখোমুখি হতে তৈরি করে। এই মনস্তাত্ত্বিক চাপ হতে মানুষসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের জ্বর হতে পারে। কিন্তু আমরা কি জানি এই ঘটনার পেছনে কোন স্নায়বিক প্রক্রিয়া কাজ করছে?
আমাদের দেহের সকল অনুভূতি কোনো না কোনো স্নায়বিক প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত। কিন্তু মানসিক চাপে পড়লে বা ভয় পেলে কেন আমাদের দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায় তা আমরা অনেকেই জানিনা । কোন স্নায়ুবিক প্রক্রিয়া দেহে এই তাপ উৎপাদনের সূত্রপাত করে তা সম্পর্কে জাপানের নাগোয়া (Nagoya) বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর নাকামুরা (Kazuhiro Nakamura)ও তার গবেষক দল Science জার্নালে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। তারা 2004 সালে যে নিউরোনাল সার্কিট এই তাপ উৎপাদনকে ট্রিগার করে সেটার অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। তাদের গবেষণায় তারা আমাদের দেহে বিদ্যমান ব্রাউন ফ্যাটকে এন্ট্রি পয়েন্ট হিসেবে চিন্তা করেছিলেন যা দেহের প্রয়োজন সাপেক্ষে তাপ উৎপাদন করে। ব্রাউন ফ্যাটে প্রচুর পরিমাণে β3-adrenergic receptor প্রোটিন বিদ্যমান। কোনো কারনে এই প্রোটিনের কাজে বাধা পেলে ব্রাউন ফ্যাট নিউরনের উদ্দীপনায় সাড়া দেয় যা মানসিক চাপ জনিত হাইপোথারমিয়া( তাপমাত্রা বৃদ্ধি) সৃষ্টি করে।
2004 সালে বৈজ্ঞানিক দল ব্রাউন ফ্যাট মস্তিষ্কের কোন অংশ হতে স্নায়বিক উদ্দীপনা পায় তা চিহ্নিত করতে ইঁদুরের দেহে ভাইরাল ট্রেসার প্রবেশ করায়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের যে স্নায়ুগুলোকে চিহ্নিত করেন তা rostral medullary raphe (rMR) নামে পরিচিত যা ব্রাউন ফ্যাটকে সংযুক্ত করে । পরবর্তীতে বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কে dorsomedial hypothalamus (DMH) আবিষ্কার করেন। তারা DMH-to-rMR পর্যন্ত নিউরাল পথকে কৃত্রিমভাবে উদ্দীপ্ত করে যার দরুন স্নায়বিক তৎপরতা এবং ব্রাউন ফ্যাটের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। পাশাপাশি হৃদস্পন্দন ও রক্তচাপ বাড়লো। এ থেকে বুঝা যায় যে,DMH–rMR মানসিক চাপের সময় বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া-কে সমন্বয় করতে পারে।
তবে মানষের ক্ষেত্রে মানসিক চাপে সৃষ্ট পরিস্থিতি মোকাবেলায় অবশ্যই ব্রেনের কর্টেক্স থেকে নির্দেশনার প্রয়োজন হয়। কিন্তু মানসিক চাপের সময় DMH মস্তিষ্কের কোন কর্টিক্যাল অঞ্চল থেকে নির্দেশনা পায় তা বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না। তাই তারা এবার DMH এ এক ধরনের ট্রেসার প্রবেশ করালেন। এর মাধ্যমে তারা মস্তিস্কের কর্টেক্সের এক ক্ষুদ্র অঞ্চল চিহ্নিত করলেন যা dorsal peduncular cortex and dorsal taenia tecta (DP/DTT) নামে পরিচিত। ইঁদুরের ক্ষেত্রেও এই অঞ্চলটি অনেক সক্রিয় থাকে ( বিশেষ করে যখন একটি ইঁদুর অন্য একটি ইঁদুরের সাথে লড়াইয়ে হেরে যায় ! )
মস্তিষ্কের এই অংশটি মানসিক চাপের সময় আমাদের দেহে কী ধরনের প্রভাব রাখে তা আবিষ্কার করতে বিজ্ঞানীরা DMH এর সংযোগ কে তিন ধাপে বাধা দিয়ে দেখলেন। তারা কেমিক্যাল ইনহিবিটার ব্যবহার করে পুরো DP/DTT জুড়ে কার্যকলাপ অবরুদ্ধ করলেন; DP/DTT থেকে DMH-এ অভিক্ষিপ্ত কোষগুলিকে হত্যা করার জন্য একটি ভাইরাস ব্যবহার করেছিলেন; একটি বিশেষ জেনেটিক পদ্ধতি অবলম্বন করে DP/DTT ও DMH এর মধ্যকার ক্রিয়া-কলাপ পর্যবেক্ষণ করলেন। তারা লক্ষ্য করলেন স্নায়বিক মিথস্ক্রিয়া বাধা পাওয়ায় প্রতি ক্ষেত্রেই মানসিক চাপ জনিত তাপমাত্রা বৃদ্ধি (হাইপারথার্মিয়া) কমতে লাগলো। এর মাধ্যমে গবেষক দলটি প্রমাণ করলো যে, DP/DTT থেকে উত্তেজক স্নায়ুবিক সংকেত DMH এ প্রেরিত হয় এবং DP/DTT DMH কোষগুলোর কাছাকাছি সমাপ্ত হয় যা কিনা পরবর্তীতে rMR এ পৌঁছায়। তাদের এ পরীক্ষা DP/DTT–DMH–rMR–brown fat সার্কিট কে তীব্রভাবে সমর্থন করে যার দরুন মানসিক চাপের সময় আমাদের দেহের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পায় । এ থেকে বোঝা যায় মানসিক চাপে আমাদের মস্তিষ্ক হতে স্নায়বিক সংকেত DP/DTT–DMH–rMR–brown fat circuit এ বাহিত হয় এবং আমরা জ্বর জ্বর অনুভব করি।
কিন্তু মানসিক চাপজনিত এই সংকেতগুলো DP/DTT-তে পৌঁছায় কিভাবে? তাই পরবর্তীতে আরো ট্রেসিং ব্যবহার করে গবেষণা চালানো হয় যার মাধ্যমে জানা যায় যে, DP/DTT-তে সংকেত আসে মস্তিষ্কের মিডলাইন থ্যালামিক অঞ্চলগুলো (Midline Thalamic regions), প্যারাভেন্ট্রিকুলার (PVT) এবং মেডিওডোরসাল (MD) থ্যালামিক নিউক্লিয়াস থেকে। PVT বিভিন্ন শারীরিক এবং মনস্তাত্ত্বিক চাপ, যেমন (শিকারের সংকেত এবং ব্যথার প্রতি) অত্যন্ত সংবেদনশীল। অপরদিকে, MD বিভিন্ন জটিল জ্ঞান সম্পর্কিত কার্যাবলীর (যেমন: নিয়ম শিক্ষা, মানুষের মূল্যায়ন, কল্পনা) জন্য প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্সের (Prefrontal cortex) সাথে যোগাযোগ করে। সুতরাং, শারীরিক ব্যথা থেকে প্রত্যাশিত সমস্যা মোকাবেলায় চাপজনিত সংকেত DP/DTT-তে যেতে পারে। কিন্তু এটি এখনও অস্পষ্ট যে, কীভাবে DP/DTT এই সংকেতগুলো বিশ্লেষণ (encode) করে। DP/DTT কোষগুলির ইলেক্ট্রোফিজিওলজিকাল (electrophysiological) বা অপটিক্যাল রেকর্ডিং (optical recordings) ব্যবহার করে ভবিষ্যতে গবেষণার মাধ্যমে হয়তো এই প্রশ্নগুলোর সমাধান পাওয়া যাবে।
দার্শনিক এবং মনোবিজ্ঞানী উইলিয়াম জেমস মনে করেন, ভয় হচ্ছে আসন্ন হুমকির প্রতি আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া। জেমস যদি ঠিক হয়ে থাকেন, তাহলে আসন্ন কোনো হুমকির প্রতি ইঁদুরদের শারীরিক প্রতিক্রিয়া অবরুদ্ধ রাখলে ইঁদুরের ভয় পাওয়া আর উচিত নয়। সুতরাং, নাকামুরা ও তার গবেষক দলের মনে প্রশ্ন জাগে, যদি DP/DTT–DMH পথকে নিষ্ক্রিয় রাখা যায়, তাহলে কী একটি ইঁদুর কোনো এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি বা আক্রমণাত্মক পরিবেশে উদ্ভূত মানসিক চাপে আর ভয় পাবে না ?
সাধারণত, আক্রমনাত্মক পরিবেশে কোনও পরাজিত প্রাণী হিংস্র প্রতিপক্ষ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে যাতে আরও বেশি ক্ষতি না ঘটে। অপরদিকে, নিরীহ-সাদাসিধে প্রাণী যারা আগে এ ধরনের কোন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়নি তারা ভয়ের কোনও চিহ্ন দেখায় না বরং, আক্রমনাত্মক প্রাণীটিকে খুব আগ্রহের সাথে পর্যবেক্ষণ করে। লক্ষণীয়ভাবে, যখন গবেষকেরা পরাস্ত ইঁদুরগুলোতে DP/DTT–DMH পথ অবরুদ্ধ করে দিয়েছিলেন, প্রাণীগুলো তখন সাদাসিধে ইঁদুরের মতো আচরণ করছিলো।
সুতরাং, এই গবেষণা হতে এটা অনুমান করা যায়, ভয় পেলে আচরণগত পরিবর্তন ভয়ের এই উপলব্ধি এবং হুমকির প্রতি শারীরিক প্রতিক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। এই তথ্যগুলো বুঝায় করে যে, মানসিক চাপের সময় আমাদের শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া দমন করার মাধ্যমে এই চাপজনিত অনুভূতিগুলো (দেহের তাপমাত্রা, রক্তচাপ, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাওয়া) দমন করা যায়। তবে,মানসিক চাপের বাইরে অন্যান্য তাপ বৃদ্ধি (thermoregulation)- (যেমন: ইনফেকশনের কারণে দেহের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক তাপমাত্রার পরিবর্তন) DP/DTT দ্বারা নয়, বরং DMH-এর অন্য একটি অঞ্চল (Preoptic Area) দ্বারা প্রবাহিত হয়। এই ক্ষেত্র, DP/DTT–DMH পথকে অবরুদ্ধ করে তাপমাত্রার এই পরিবর্তনকে রোধ করা যায় না। তারপরেও, আরো গবেষণার মাধ্যমে একসময় হয়তো DP/DTT–DMH পথকে অবরুদ্ধ করে দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপ কমানোর সম্ভাব্য উপায় হতে পারে।
দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হই ,মানসিক চাপ অনুভব করি, ভয় পেলে আমাদের দেহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। এই লেখাটি পড়ে আপনারা এতক্ষণে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে স্নায়বিক প্রক্রিয়া । তবে কি এই ভীতি বা জড়তা কোনভাবেই কাটানো সম্ভব নয়?_অবশ্যই সম্ভব। মানসিক চাপকে কোন তোয়াক্কা না করে মস্তিষ্কের এই স্নায়বিক প্রক্রিয়াটি কমিয়ে আনা যায়। আর এভাবেই অডিটোরিয়ামে অনেক দর্শকের সামনে কথা বলতে গিয়ে আমরা যখন ভয় পাই, তখন একটা বড় শ্বাস নিয়ে আমরা নিজেদের শান্ত রাখতে পারি।
Leave a Reply