১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে ফিলাডেলফিয়া শহরে প্রতিবছরের মতোই আমেরিকার সৈন্যদের সম্মেলন হলো। ইংরেজিতে বলে লিজিওনারি কনভেনশান। সেই সম্মেলনে সাড়ে ৪ হাজার সৈন্য অংশগ্রহন করেন, সৈন্যরা যেহেতু বেশিরভাগই প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক সেহেতু তাদের গড় বয়স বেশিই ছিলো। সম্মেলনের প্রধান কার্যক্রম হয় শহরের সবচেয়ে বড় হোটেলগুলির একটিতে, বেলভেউ স্ট্র্যাটফোর্ড। আশ্চর্যজনক ঘটনা পরবর্তীতে ঘটে। এই সম্মেলনে অংশ নেয়া বহু মানুষ রোগাত্রান্ত হয়ে পড়েন।
পরবর্তী বেশ কয়েকদিনে মোট ৩৪ জন সৈন্য যারা সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা মারা যান, কোন এক দূরারোগ্য রোগে। সৈন্যদের বিশেষভাবে আক্রমণ করেছে বলে এই রোগটাকে ‘লিজিওনেয়ার্স ডিজিজ’ বা সৈন্যদের রোগ হিসেবে ডাকা শুরু করে লোকে। ফুসফুসের রোগ। আমেরিকার প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলি অনুসন্ধান শুরু করে, সিডিসি থেকে শুরু করে এফবিআই। নিউমোনিয়ার মতো উপসর্গ বিধায় প্রথমে একজন গবেষক ভেবেছিলেন নিকেল দূষণ। মৃত রোগিদের কাছ থেকে পাওয়া অনেকগুলা নমুনায় নিকেল পাওয়া গেলেও পরে ধরা পরলো আসলে সেটা আসে আসলে গবেষণাগারে ব্যবহৃত যন্ত্র থেকে, প্লাস্টিক ব্যবহার করলে নমুনায় আর নিকেল পাওয়া যায়না। সিডিসির গবেষকদল অনেক খুঁজে খুঁজে বুঝতে পারলেন আসলে রোগটির উৎস আসলে বেলভিউ স্ট্র্যাটফোর্ড হোটেল। কিন্তু কিসের কারনে এই রোগ হয়েছে এবং কিভাবে ছড়িয়েছে সেটা বুঝতে পারেন নাই। দেখা গেলো এমনকি হোটেলের বাইরে দিয়ে হেঁটে যাওয়া কেউ কেউও এই রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কবুতরের গু থেকে হোটেলের বাতাস, পানি, খাবার সবকিছুই সন্দেহের তালিকায় ছিলো।
বেশ রহস্যজনক ঘটনা! কেউ কি বিশেষভাবে এই সৈন্যদেরকে নিশানা করে কোন আক্রমণ চালিয়েছে? সন্ত্রাসী কাজ? দেখা গেলো যারা বেশি আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং যারা মারা গিয়েছিলেন তারা প্রায় সবাই পঞ্চাশোর্ধ। মানে এটা দূর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাধারিদের ধরাশায়ী করে দ্রুত, এখনকার করোনার মতোই। প্রথম ২১ জন মৃতের ১৭ জনই ধূমপান করতেন। কারও কারও অন্যান্য অসুখ ছিলো। অন্যদিকে বেলভিউ হোটেলে যারা কাজ করতেন তাদের গড় বয়স এই সৈন্যদের তুলনায় ১০ বছর কম এবং স্বাস্থ্যবান ছিলো। সন্ত্রাসী হামলা চালালেও এর পরিকল্পনায় তাই বেশ মাথা খাটাতে হতো!
এক ক্রিসমাসের ছুটির অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন সিডিসির গবেষকেরা। সেখানে ছিলেন গবেষকদলের অন্যতম অণুজীববিজ্ঞানী ড. জোসেফ ম্যাকডেইড। সবাই প্রশ্ন করছিলো, ৬ মাস হয়ে গেলো এই ঘটনার, কেন কোন উত্তর পাচ্ছিনা এখনও?! এসব শুনে হতাশ ড. ম্যাকডেইড তার ছুটি বাতিল করে দিলেন এবং গবেষণাগারে ফিরে গেলেন। তিনি একটা গিনিপিগের যকৃতকোষকে তুলে নিলেন। লিজিওনেয়ার্স রোগাক্রান্ত সৈন্যদের দেহ থেকে কলা বা টিস্যু তুলে নিয়ে গিনিপিগটার দেহে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো। এইরকম স্লাইড তিনি বহুবার দেখেছেন, কিন্তু এইবার সেখানে এমনকিছু দেখলেন যা আগে কখনও দেখেন নাই। একটা নতুন ব্যাকটেরিয়া। এমন ব্যাকটেরিয়া ড. ম্যাকডেইড কোনদিন দেখেননাই আগে।
প্রথমে তিনি ভাবলেন আসলে তিনি কোন দূষণ দেখছেন, আসলে অন্য কোন ব্যাকটেরিয়া ভুলক্রমে তার গবেষণাগারের কোষকে আক্রমণ করেছে। তো একজন বিজ্ঞানীর যা করা প্রয়োজন তিনি তাই করলেন। পুনঃপরীক্ষা। এবার তিনি আরেকটু গভীর পরীক্ষার সম্মুক্ষীণ হলেন। লিজিওনেয়ার্স রোগাক্রান্ত একজন সৈন্যের দেহ থেকে তিনি রক্ত নিলেন, রক্তে আসলে এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে অক্রক বা এন্টিবডি তৈরি হওয়ার কথা (করোনাটিকা যেভাবে কাজ করে)। মানুষের এমন এন্টিবডিকে আমরা সনাক্ত করতে পারি বিভিন্নভাবে। এই ক্ষেত্রে অক্রক যদি গিনিপিগের নমুনায় প্রাপ্ত ব্যাকটেরিয়াকে চিনতে পারে তবে সেটা সবুজ রঙ ধারণ করবে। আশ্চর্য! এটা সবুজ রঙই ধারণ করলো। মানে লিজিওনারি রোগের রোগীদের দেহেও এই ব্যাকটেরিয়াই ছিলো, কোন দূষণ নয়! যুগান্তকারী আবিষ্কার!
রোগের মহামারির ১৪৭ দিন পরে ৩৪ জনের প্রাণনাশ করা এবং ২২১ জনকে হাসপাতালে পাঠানো রোগের কারনটা উন্মুক্ত হলো মানুষের সামনে। এক ব্যাকটেরিয়া, যার আনুষ্ঠানিক নাম দেয়া হলো – লিজিওনেলা নিউমাফিলা! ফিলাডেলফিয়ার সৈন্যদের সম্মানে। আসলে গবেষকরা এর বিরুদ্ধে একটা এন্টিবায়োটিকও সনাক্ত করলেন, এখনকার খুব পরিচিত নাম – ইরাইথ্রোমাইসিন।
তবে প্রশ্ন রইলো, কিভাবে হোটেলে এই সৈন্যদেরকে বিশেষভাবে আক্রমণ করেছিলো ব্যাকটেরিয়াটা, কিন্তু হোটেলের কর্মচারিদের নয়। কয়েকটা কারন ধরা হয়। সম্ভবত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় যন্ত্র থেকে বাতাস এবং পানির কুয়াশায় ছড়িয়েছে হোটেলজুড়ে। যারা আক্রান্ত তারা বয়স্ক এবং স্বাস্থ্যগত অন্যকোন সমস্যা রয়েছে। অনেক সৈন্যকেই একই হোটেল ঘরে থাকার পরও আক্রমণ করেনাই সম্ভবত তাদের অক্র বা ইম্যুনিটি ভালো হওয়ার কারনে। হোটেলের কর্মকর্তাদেরও তাই। অথবা তাদের প্রতিরক্ষা তৈরি হয়েছিলো প্রতিদিন অল্প অল্প করে ডোজ পাওয়ার জন্য। যাই হোক, এই আবিষ্কারের পরে আমেরিকার আগের অনেকগুলি মহামারি জন্যও এই ব্যাকটেরিয়াকে সনাক্ত করা হয়েছিলো। ধারণা করা হয় এই ব্যাকটেরিয়া আসলে মানুষের জন্য প্রাণঘাতি হয়েছে হাজার বছর ধরেই! এখন আমরা কম মারা যাই আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির কারনে। এখন এই রোগে আক্রান্ত হইলেই সনাক্তকরণ সহজ হয় এবং সুলভ ঔষধ পাওয়া যায়।
অদ্ভুত, তাইনা? করোনার আগেও বিজ্ঞান গবেষণা আমাদের কতো প্রাণ বাঁচিয়েছে সেটা ভেবে দেখতে পারেন! করোনাটিকাও সেই ধারারই একটা সাফল্য।
প্রচ্ছদ ছবি: Biofilms: The Stronghold of Legionella pneumophila
Leave a Reply