(অনুবাদক: সম্প্রতি সায়েন্স-এ প্রকাশিত বিজ্ঞানী ড: শালিনি আরিয়া’র লেখা “I grew up in slums of India. Now I am a scientist.” পড়েছি। লেখাটি তরুণ গবেষকদের জন্য খুবই অনুপ্রেরণাদায়ক। এমনিতেই একজন মানুষের জন্য বিজ্ঞানী হওয়া অনেক কষ্টের। অনেক সাধ-স্বপ্ন নিয়ে শুরু করেও অনেকেই বলতে বাধ্য হন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাচি। সেখানে এই মানুষ কত কষ্ট করে বিজ্ঞানী হলেন, সেই গল্প বাংলা ভাষাভাষীদের সাথে ভাগাভাগি করার জন্যে এই অনুবাদ প্রচেষ্টা)
আমি বাড়ির টিনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে প্রাণী বিবর্তনের একটি বই পড়ছিলাম। আমার বয়স তখন দশ বছর। সেদিন মাত্র বাড়ির সবার জন্য রান্না শেষ করেছিলাম। এই দায়িত্ব আমাকে প্রতিদিন পালন করতে হতো। টিনের উপরের সেই জায়গা থেকে আমি বস্তিটি দেখতে পেতাম, বস্তিটি ছিলো ভারতের ছোট একটি শহরের মধ্যে। কিন্তু বাড়ির টিনের ছাদে উঠার কারণ মূলত এটি ছিলো না। আমাদের ঘরে কোন বাতি ছিলো না, তাই দিনের বেলা সূর্যের আলোতে আমি পড়ালেখা করতাম। তখন আমার জানা ছিলো না আমার পড়ার সেই অভ্যাসই আমার বিজ্ঞানী হয়ে উঠার পেছনে মূল চাবিকাঠি হয়ে উঠবে।
আমার বাবা ছিলেন একজন শ্রমিক। প্রথমদিকে তিনি আমাকে স্কুলে যেতে দেন নি। আমার ছোট ভাই যখন প্রতিদিন স্কুলে যেতো তখন আমার খুব ইর্ষা হতো। আমার বয়স তখন পাঁচ বছর। একদিন আমি আমার ছোট ভাইয়ের পেছনে পেছনে স্কুলে গিয়ে, শিক্ষকের টেবিলের নীচে লুকিয়ে থাকলাম। শিক্ষকটি আমাকে দেখলেন এবং বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু পরের দিন তিনি আমার বাবাকে স্কুলে ডাকলেন এবং আমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে বললেন। আমি খুব খুশি হয়েছিলাম যে আমার বাবা হ্যাঁ বলেছিলেন।
প্রায় প্রতিদিনই ক্ষুধার জ্বালা থাকার পরেও আমার শেখার জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা ছিলো। আমি খুব তাড়াতাড়ি ক্লাসের প্রথম সারির ছাত্রদের মধ্যে চলে আসলাম। আমার বয়স যখন ১০ বছর, আমার বাবা আমাকে এলাকার বাইরের আরও ভালো স্কুলে ভর্তি করালেন। এই স্কুলে বেশীরভাগ ছাত্র ছিল ধনী পরিবারের সন্তান। আমি সেখানেও ক্লাসের প্রথমদিকে ছিলাম। কিন্তু আমার সহপাঠীরা আমি বস্তিতে থাকি বলে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো। জীববিজ্ঞান ক্লাসে আমাকে হেনস্থার শিকার হতে হতো কারণ আমি খুব খাটো ছিলাম, আমার মনে হয় অপুষ্টিজনিত কারণেই। ফলে আমাকে চেয়ারে দাঁড়িয়ে মাইক্রোস্কোপ দেখতে হতো।
যখন আমি হাইস্কুল পার হলাম, আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলাম। আমার বাবা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তবে তিনি আমাকে বলেছিলেন আমি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পারবো না। সেটা শুধু ছেলেদের জন্য। তিনি আমাকে খাদ্য বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে বললেন। আমার প্রাথমিক অনুভূতি ছিলো খাদ্য বিজ্ঞান আমার পছন্দ তালিকার সবচেয়ে নিচের বিষয়। ছোটবেলা থেকে পরিবারের জন্য রান্না করার পর, রান্না থেকে আমার অপ্রিয় বিষয় আর কিছু ছিলো না।
যাই হোক, অবশেষে আমি খাদ্য বিজ্ঞানেই ভর্তি হলাম এবং আবিষ্কার করলাম খাদ্য বিজ্ঞান অতটা খারাপও না। এটা ছিলো সত্যিকারের বিজ্ঞান, রসায়নের খুব কাছাকাছি এবং এতে অনুমানের সত্যতা জানার জন্য পরীক্ষা করতে হয়। খুব তাড়াতাড়িই আমি এই বিষয়ের অনুরাগী হয়ে উঠলাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আমি ক্যাম্পাসের কাছে হোস্টেলে থাকতাম। আমার পড়াশোনার ও থাকা-খাওয়ার খরচের জন্য ছিলো আমার বাবার নেয়া স্টুডেন্ট লোন এবং পাশাপাশি আমি রিসার্চ এসিস্ট্যান্টের কাজ করছিলাম। আমার রুমে একটি ল্যাম্প ছিলো। প্রতিরাতে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতাম কারণ আমার পড়ার জন্য ল্যাম্পের আলো ছিলো এবং আমি এই সু্যোগকে আমি সবসময়ই দাম দিয়েছি।
পরবর্তী বছরগুলোতে আমি ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি অর্জন করেছি এবং শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছি। বস্তি থেকে শুরু করে এই অর্জনে পৌঁছানো অকল্পনীয় ছিলো। কিন্তু কিছুদিন পরেই আমি একটা কলাবরেশন শুরু করি যা আমাকে আমার শিকড়ে নিয়ে যায়। আমি একটা কোম্পানির সাথে কাজ করেছিলাম যারা ভারতের বস্তিতে অপুষ্টি নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলো। কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা আমাকে বলছিলো ‘আপনাকে বস্তি যেতে হবে এবং সেখানকার মানুষের সাথে কথা বলতে হবে”। তারা হয়তো মনে করছিলো আমি এই কাজ আগে কখনও করি নি। আমি উত্তর দিলাম, “এটা কোন সমস্যা নয়। আমি বস্তিতেই বড় হয়েছি।”
ঐ কোম্পানির সাথে কাজের অংশ হিসেবে আমি ভারতের এক ধরণের চ্যাপ্টা রুটি যা চাপাতি নামে পরিচিত তার মূল উপাদানে কিছু পরিবর্তন এনেছিলাম। এই চাপাতি আমাকে প্রতিদিন বানাতে হতো। আমি বুঝতে পেরেছিলাম গরীব মানুষের খাবারে পুষ্টিমান বাড়ানোর জন্য চাপাতি চমৎকার এক উপায়। কারণ এটা তারা প্রতিদিন খাবারের সাথে খায়। আমি চাপাতির উপাদানগুলো নিয়ে কিছু পরীক্ষানিরীক্ষা করলাম এবং সাদা আটাকে পরিবর্তে তুলনামূলক সস্তা ও এলাকায় তৈরি শস্যদানা ব্যবহার করলাম। এই শস্যদানায় সাদা আটার তুলনায় বেশী খনিজ, আমিষ এবং আঁশ জাতীয় উপাদান রয়েছে।
আমি যখন চাপাতি নিয়ে গবেষণা করছিলাম অন্যান্য গবেষকরা এটি নিয়ে হাসাহাসি করছিলো। তারা মনে করেছিল এখানে বিজ্ঞান কিংবা নতুন কিছু আবিষ্কারের কিছু নেই। কিন্তু আমি তাদেরকে ভুল প্রমাণিত করেছি। আমার কাজ অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার জিতেছে। কোম্পানি, অলাভজনক প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের এজেন্সিরা আমার পরামর্শ চেয়েছে।
আমার জীবনে আমি দারিদ্র, ক্ষুধা এবং বৈষম্যের শিকার হয়েছি। কিন্তু আমি কোন কিছুতে দমে যায় নি। আমি বাধা ঠেলে সামনে এগিয়েছি, সেই বাঁধা থেকে শেখার চেষ্টা করেছি যা আমাকে আরও সামনে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। আমি আশা করি অন্যরা আমার জীবনের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারবে এবং তারা অনুধাবন করবে ওনারা যে ধরণের বাঁধার সম্মুখীন হোন না কেন, তারাও তাদের কাজ অদম্যভাবে চালিয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখেন।
বিঃদ্রঃ ড: শালিনি’র গুগল স্কলার প্রোফাইল, রিসার্চগেইট প্রোফাইল
Leave a Reply