২০১৯ সালের ডিসেম্বরে, চীনের উহান শহরে প্রথম কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাব দেখা দিলেও তা অতিদ্রুত সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে স্থবির হয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী মানুষের জীবন। সংক্রমণ ধরা পরার কিছু দিনের মধ্যেই, ২০২০ সালের ১১ই জানুয়ারি, প্রথম এই ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্সিং করা হয়। এই জিনোম ভ্যাক্সিন তৈরীতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। জিনোম সিকুয়েন্সিং এর পরপরই বিশ্বের সকল ভ্যাক্সিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান উঠেপড়ে লেগেছে। এবছর মার্চ ২০২১-এর মধ্যে ১২ টি ভ্যাক্সিন অনুমোদিত হয়েছে। এই ভ্যাক্সিন গুলোর মধ্যে ফাইজার এবং মডার্না সর্বোচ্চ কার্যক্ষমতা (efficacy) প্রদর্শন করে, যথাক্রমে ৯৫% এবং ৯৪%। কার্যক্ষমতার ভিত্তিতে এরপরেই অবস্থান করে, স্পুটনিক ভি (৯২%), নোভাভ্যাক্স (৮৯%), অক্সফোর্ড/ এস্ট্রাজেনেকা (৬৭%), এবং জনসন এন্ড জনসন (৬৬%)। সাধারন চোখে আমরা বলে দিতে পারি, যে ভ্যাক্সিনের শতকরা কার্যক্ষমতা যত বেশি সেই ভ্যাক্সিন ততবেশি কার্যকর। আসলেই কি তাই? চলুন, জেনে নেয়া যাক।
ভ্যাক্সিন | ট্রায়ালে অংশগ্রহনকারী | কার্যক্ষমতা |
ফাইজার | ৪৩,৪৪৮ জন | ৯৫% |
মডার্না | ৩০,০০০ জন | ৯৪% |
স্পুটনিক ভি | ৪০,০০০ জন | ৯২% |
নোভাভ্যাক্স | ৩০,০০০ জন | ৮৯% |
অক্সফোর্ড/ এস্ট্রাজেনেকা | ৩০,০০০ জন | ৬৭% |
জনসন এন্ড জনসন | ৪০,০০০ জন | ৬৬% |
ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতা কিভাবে নির্ণয় করা হয়?
অন্য সব ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে তার কার্যক্ষমতা প্রধান মানদন্ড হলেও করোনার ভ্যাক্সিনের ক্ষেত্রে বিষয়টি কিছুটা ভিন্ন। আমাদের আগে বুঝতে হবে ভ্যাক্সিনের শতকরা কার্যক্ষমতা কিভাবে নির্ণয় করা হয়। ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতার হার নির্ণয় করার জন্য একটি বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে ভ্যাক্সিনের ক্লিনিকাল ট্রায়াল চালানো হয়। এই জনসংখ্যার মান বিভিন্ন হতে পারে, যেমন, মডার্নার ক্লিনিকাল ট্রায়ালে জনসংখ্যা ছিল ৩০ হাজার, ফাইজারের ক্ষেত্রে তা ৪৩ হাজার চারশত আটচল্লিসশ জন আবার জনজন এন্ড জনসনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অংশগ্রহনকারী ছিল ৪০ হাজার। এই বিশাল জনগোষ্ঠিকে দুইভাগে ভাগ করা হয়। যাদের এক গ্রুপে ভ্যাক্সিন প্রদান করা হয়, অপর গ্রুপে দেয়া হয় প্লাসিবো। প্লাসিবো হচ্ছে, এমন উপাদান যার কোন ঔষুধি (থেরাপিউটিক) গুরুত্ব নেই। যদিও গ্রহনকারী সে সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। অংশগ্রহনকারী ভলান্টিয়াররা এরপরে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যান।
এরপর কয়েকমাস তাদেরকে মনিটরিং করা হয় যে তারা কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন কি না দেখার জন্য। আমরা ফাইজারের ট্রায়াল থেকে দেখতে পারি যেখানে ৪৩ হাজারেরও বেশি ভলান্টিয়ার অংশ নিয়েছিলেন, মনিটরিং শেষে দেখা গেল, ১৭০ জন কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। এখন এই আক্রান্তরা কোন গ্রুপে পড়ছেন তার উপরে ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতা নির্ভর করে। যদি তারা সমান সংখ্যায়, ৮৫ জন ভ্যাক্সিন গ্রুপ এবং বাকি ৮৫ জন প্লাসিবো গ্রুপের হয়ে থাকেন, তাহলে এই ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতা শুন্য। আবার, যদি এই আক্রান্তদের ১৭০ জনই প্লাসেবো গ্রুপের সদস্য হন এবং ভ্যাক্সিন গ্রুপে আক্রান্ত সংখ্যা শুন্য হয়, তাহলে ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতা হবে ১০০%। এবার, এই ট্রায়ালে দেখা গেছে, ১৭০ জন এর মধ্যে ১৬২ জন হচ্ছে প্লাসেবো গ্রুপে এবং বাকি ৮ জন ভ্যাক্সিন গ্রুপে।
এটা প্রতীয়মান হয় যে, যারা ভ্যাক্সিন গ্রহন করেছেন, তাদের শতকরা ৯৫ ভাগ সম্ভাবনা আছে যে তারা কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হবেন। অতএব, এই ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতা ৯৫%। এখানে মনে রাখতে হবে, ৯৫% দ্বারা এটা বুঝায় না যে, ১০০ জন মানুষ ভ্যাক্সিন নিলে তাদের মধ্যে ৫ জন পরবর্তীতে কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারেন, যদিও স্বাভাবিক ভাবে ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতার হারকে আমরা এভাবেই বুঝে থাকি, যেটা ভুল। আসলে, এই শতকরা হার একজন ব্যাক্তির ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্তের সম্ভাবনাকে বোঝায়। ৯৫% কার্যক্ষমতার হার বোঝায়, একজন ভ্যাক্সিন গ্রহনকারী ব্যাক্তির ৯৫% কম সম্ভাবনা আছে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হবার একজন ভ্যাক্সিন না গ্রহনকারী ব্যাক্তির চেয়ে। এখানে, ফাইজারের উদাহরণ দেয়া হলেও প্রত্যেক ভ্যাক্সিন এর কার্যক্ষমতার হার এভাবেই নির্ধারন করা হয়।
ক্লিনিকাল ট্রায়াল কোথায়, কখন হয়েছে?
ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতার হার বুঝতে পারলে এবার আমরা দেখবো ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল কিভাবে হচ্ছে। প্রত্যেকটা ভ্যাক্সিনের ট্রায়াল হতে হবে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে, স্থানে এবং সময়ে। যেখানে ভ্যাক্সিন নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মডার্না তাদের সম্পূর্ন ট্রায়াল চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে, গ্রীষ্মে ( আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) সময়ে। ফাইজারও একইভাবে এবং একইসময়ে তাদের ট্রায়াল চালিয়েছে। অন্যদিকে, জনসন এন্ড জনসন, যাদের কার্যক্ষমতার মাত্রা হচ্ছে ৬৬%, তারা তাদের ট্রায়াল চালিয়েছে শীতে, ২০২০ এর নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ২০২১ এর জানুয়ারী পর্যন্ত, যেই সময়ে অধিক পরিমান মানুষ কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে ।
এছাড়াও তাদের অধিকাংশ ট্রায়াল হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, প্রধানত দক্ষিন আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে। এই দেশগুলোতে শুধু যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি ছিল এমনটা না, বরং সেখানে করোনা ভাইরাসের নতুন প্রকরণের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। নতুন আক্রান্তদের অধিকাংশই এইসব নতুন প্রকরণ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। দক্ষিন আফ্রিকায় জনসন এন্ড জনসনের ট্রায়ালের ৬৭% আক্রান্ত হয়েছিল নতুন B.1.351 প্রকরন দ্বারা। আশাজনক বিষয় হচ্ছে, জনসন এন্ড জনসন এই নতুন প্রকরনের বিরুদ্ধেও ৬৪% কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। তাই, ভ্যাক্সিন গুলোর কার্যক্ষমতার মধ্যে সরাসরি পার্থক্য করলে হলে এদের ট্রায়াল হতে হবে একই মানদন্ডের ভিত্তিতে,একই সময়ে যেটা আদতে হয়নি । সুতরাং, এই কার্যক্ষমতার হার শুধু সেই ভ্যাক্সিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ফলাফল উল্লেখ, এর বেশি কিছুই না।
ভ্যাক্সিনের কাজ মৃত্যু ঠেকানো
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এই কার্যক্ষমতার হার দিয়ে ভ্যাক্সিন মূল্যায়ন সম্ভব। কেননা, সবসময় কোন সংক্রমন সম্পুর্নভাবে রোধ করা ভ্যাক্সিনের প্রধান লক্ষ নয় । যেমন, কোভিড-১৯ এর সংক্রমন মাত্রা শুন্যে নিয়ে আসা এর ভ্যাক্সিনের লক্ষ্য নয় বরং এই ভাইরাসকে নিস্তেজ করে দিয়ে এই ভাইরাস দ্বারা কঠিন রোগ সৃষ্টি ব্যহত করার সাথে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনাই এর প্রধান লক্ষ্য। তাহলে প্রশ্ন আসে, ভ্যাক্সিনের কাজ তাহলে কি? মনে করি, একজন ব্যক্তি অসংক্রমনিত অবস্থায় আছেন। এরপর তিনি সংক্রমনিত হলেন যদিও তার মধ্যে কোন লক্ষণ প্রকাশিত হয় নায়। পরবর্তীতে, তার মধ্যে কিছু লক্ষন দেখা যেতে পারে যা তীব্রতর হবে। এইসময় সেই ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করার প্রয়োজন হতে পারে এবং পরিস্থিতির অবনতি হলে তার মৃত্যুও হতে পারে। তাহলে ভ্যাক্সিন কি কাজ করবে?
বাস্তবিকপক্ষে, ভ্যাক্সিনের কাজ সংক্রমন দূর করা নয় বরং শরীরকে এমন সুরক্ষা দেয়া যা ওই ব্যাক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া অথবা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এবং, এই কাজটি প্রত্যেক কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিনই সঠিকভাবে করছে। সবগুলো ট্রায়ালেই দেখা গেছে, প্লাসেবো গ্রুপের আক্রান্ত অনেকেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, এমনকি মারাও গিয়েছেন কিন্তু একজনও ভ্যাক্সিন গ্রহণকারীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে নি। সুতরাং, প্রত্যেক কোভিড-১৯ ভ্যাক্সিন মৃত্যুর বিরুদ্ধে শতভাগ কার্যকারীতা প্রদর্শন করেছে।
ভ্যাক্সিনের কার্যক্ষমতার হার অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ন, তবে সেটাই একমাত্র মাপকাঠি বা মানদন্ড নয়। সারাবিশ্বের এখন প্রশ্ন কেবল, কোন ভ্যাক্সিনে মৃত্যুর হার কমে যাবে? কোন ভ্যাক্সিন পুরোপুরি সুরক্ষা দিবে ? কোন ভ্যাক্সিনের মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপি এই সংক্রমন কবে শেষ হবে? উত্তর, সবগুলো ভ্যাক্সিন। তাই, আপনার আশেপাশে যে ভ্যাক্সিন দেয়া হচ্ছে, সেই ভ্যাক্সিন গ্রহন করুন। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে প্রমাণিত ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে যাতে ভুল তথ্য না ছড়ায়। সুস্থ থাকুন, সুস্থ রাখুন।
তথ্যসূত্রঃ
- Don’t forget the most important vaccine stats: Prevented deaths and hospitalizations
- The “best” vaccine? Don’t be misled in comparing efficacy of Johnson and Johnson, Moderna, and Pfizer/BioNTech.
- Vox on Covid-19 vaccine: Efficacy results are not enough
- Thanh Le T, Andreadakis Z, Kumar A, Gómez Román R, Tollefsen S, Saville M, et al. (9 April 2020). “The COVID-19 vaccine development landscape”. Nature Reviews Drug Discovery. 19 (5): 305–06. doi:10.1038/d41573-020-00073-5. ISSN 1474-1776. PMID 32273591
- Li YD, Chi WY, Su JH, Ferrall L, Hung CF, Wu TC (December 2020). “Coronavirus vaccine development: from SARS and MERS to COVID-19”. Journal of Biomedical Science. 27 (1): 104. doi:10.1186/s12929-020-00695-2. PMC7749790. PMID33341119
Leave a Reply