একবিংশ শতাব্দীকে বলা হয় বায়োটেকনোলজী বা জীবপ্রযুক্তির শতাব্দী। অথচ এই সময়ে এসেও আজ পৃথিবীর মানুষকে এক হাত করে নিয়েছে ‘নভেল করোনা ভাইরাস’। পৃথিবীজুড়ে অসংখ্য মানুষ মারাত্মক শ্বাসকষ্ট সৃষ্টিকারী এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, মারা গেছে, যাচ্ছে।
বিজ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে এ ভাইরাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারছি। কিভাবে এটি রোগ সৃষ্টি করে, কিভাবে ছড়ায়, কিভাবে এর প্রতিরোধ করা যেতে পারে এসব সম্পর্কে প্রতিনিয়তই আমরা নতুন নতুন তথ্য পাচ্ছি। আগামীতে আরো পাবো।
আমাদের বিজ্ঞান পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীরই হয়তো ইচ্ছা অনুজীবঘটিত এসব রোগ এবং রোগের সমাধান করা যায় কিভাবে তা নিয়ে ভবিষ্যতে কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে। তাহলে কিন্তু এই ভাইরাসটি প্রথম কিভাবে শনাক্ত করা হলো এবং এটি একটি নভেল ভাইরাস অর্থাৎ আমরা অন্যান্য যেসব ভাইরাস চিনতাম সেগুলো থেকে যে এটি যে ভিন্ন বা নতুন তা কিভাবে বের করা হল এর পেছনের গল্পটা জানা দরকার।
ঘটনাটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকের, চীনের হুবেই প্রদেশের উহানে বেশকিছু রোগী পাওয়া যায় যাদের অনেকের তীব্র জ্বর, শ্বাসকষ্ট ছিল এবং তাদের বুকের রেডিওগ্রাফ নিয়ে দেখা গেল ফুসফুসে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
আমরা জানি, বিভিন্ন অনুজীব যেমন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া রয়েছে যারা নিউমোনিয়া জাতীয় শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করতে পারে। তাই ‘চাইনিজ সেন্টার ফর ডিজিস কনট্রোল এন্ড প্রিভেনশন’ এমন কয়েকজনের কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে। কিন্তু পরিচিত প্রায় ১৮ টি ব্যাক্টেরিয়া ও ভাইরাস যারা এই ধরনের রোগ সৃষ্টি করে তাদের কোনটির উপস্থিতিই পাওয়া যায়নি এসব নমুনাতে। এরপর নমুনা সংগ্রহ করে মানব শ্বাসনালীর আবরণী কোষ দিয়ে তৈরি ভাইরাস কালচার মিডিয়ামে দেওয়া হয়। এখানে কোষ দিয়ে তৈরি কালচার মাধ্যম ব্যবহার করার কারণ হচ্ছে ভাইরাস তাদের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য কোন জীব কোষের উপর নির্ভরশীল। এরপর কালচার মাধ্যম থেকে ভাইরাস সংগ্রহ করে সিকোয়েন্সিং এর জন্য পাঠানো হয়। শ্বাসনালী থেকে সংগৃহিত নমুনা থেকে আর.এন.এ (RNA) সংগ্রহ করা হয় কিন্তু এই নমুনাতে মানুষের আর.এন.এ ও থাকে তাই সেগুলোকে আগে অপসারণ করা হয় প্রোব-ক্যাপচার পদ্ধতির মাধ্যমে। এরপর বাকি আর.এন.এ গুলোকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পদ্ধতির মাধ্যমে পরিপূরক ডি.এন.এ বা cDNA। সাধারনত কোষে যে ডি.এন.এ থেকে আর.এন.এ তৈরি হয় সে পদ্ধতিকে বলে ট্রান্সক্রিপশন, আর এজন্য এই আর.এন.এ থেকে ডি.এন.এ তৈরির পদ্ধতিকে বলা হয় রিভার্স ‘ট্রান্সক্রিপশন’। এখানে যে এনজাইম বা জৈব-অনুঘটক দরকার হয় তাকে বলে রিভার্স ট্রান্সক্রিপ্টেজ। cDNA টিকে দ্বিসূত্রক ডি.এন.এ অনুতে পরিণত করা হয় ডি.এন.এ পলিমারেজ এনজাইম-I ও কিছু ছোট আর.এন.এ প্রাইমার ব্যবহার করে। এই ডি.এন.এ কে পরে সিকোয়েন্স করা হয়। সিকোয়েন্স করা ডি.এন.এ খন্ড গুলোকে বিভিন্ন সফটওয়ারের (যেমন: SPAdes, CLCBio) মাধ্যমে সাজিয়ে নভেল করোনা ভাইরাসটির সম্পূর্ন জিনোমের সিকোয়েন্স বের করা হয়। সিকোয়েন্সটাকে সাজানোর জন্য রেফারেন্স জিনোমের প্রয়োজন হয় যেটা জিনব্যাংক ডেটাবেজ থেকে নেওয়া হয়েছিল। আর সাজানো সম্পূর্ণ সিকোয়েন্সটির শুদ্ধতা যাচাই করে নেওয়া হয় সিকোয়েন্সিং এর গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড পদ্ধতি ‘স্যাংগার সিকোয়েন্সিং’ এর মাধ্যমে।
এখন কথা হচ্ছে, জিনোম সিকোয়েন্স তো বের হল, এরপরের কাজ কি? এখন সামনের কাজ হল এই সিকোয়েন্সগুলো বিশ্লেষণ করা যেমন, সিকোয়েন্সগুলোর একে অপরের সাথে কতটুকু মিল রয়েছে, সিকোয়েন্স থেকে ওপেন রিডিং ফ্রেম বা ও.আর.এফ (ORF) খুঁজে বের করা, এনোটেশন করা, ফাইলোজেনেটিক বা উৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করা ইত্যাদি। এসব সিকয়েন্সগুলোর একে অপরের সাথে মিল বা পার্থক্য বের করা হয় মাল্টিপল সিকোয়েন্স এলাইনমেন্ট এর মাধ্যমে। মজার বিষয় হচ্ছে রোগিদের নমুনা থেকে প্রাপ্ত ভাইরাসগুলোর জিনোম সিকোয়েন্সগুলোর মাঝে মিল শতকরা ৯৯.৯৮ ভাগ। অর্থাৎ আমরা ধরে নিতে পারি ওরা সবাই একই ধরনের ভাইরাস দিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল। এরপর ও.আর.এফ হচ্ছে সহজ ভাষায় বললে নিউক্লিক এসিডের একটা অংশ যেটা ট্রান্সলেটেড হবে অর্থাৎ যেটা থেকে পলিপেপটাইড বা প্রোটিন তৈরি হবে। ও.আর.এফ বের খুঁজে বের করা হয়েছিল ‘জিনিয়াস’ (Geneious) নামে একটা সফটওয়্যার ব্যবহারের মাধ্যমে এবং এনোটেশন করা হয়েছিল কনজারভড ডোমেইন ডেটাবেজ ব্যবহার করে। এনোটেশন করার অর্থ মূলত জিনোমের কোন অংশ কোন কাজের সাথে জড়িত তা উল্লেখ করা। ভাইরাসটির উৎপত্তিগত বিশ্লেষণ ও জেনেটিক রিকম্বিনেশন অনুসন্ধান করা হয় সিমপ্লট (SimPlot) এবং ফাইলোজেনেটিক বিশ্লেষণ এর মাধ্যমে। ফাইলোজেনেটিক বিশ্লেষন করা হয় সম্পূর্ন জিনোম বা নির্দিষ্ট কোনো প্রোটিনের সাপেক্ষে, যেমন সম্পূর্ন জিনোমের ক্ষেত্রে নভেল করোনা ভাইরাসের জিনোমের সাথে মিল আছে এমন কিছু ভাইরাসের জিনোম নিয়ে তূলনামূলক বিশ্লেষণ করে ফাইলোজেনেটিক ট্রি বা ক্ল্যাডোগ্রাম তৈরি করা হয়। অন্যান্য যে ভাইরাস গুলোর জিনোম ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলো বের করা হয় খুব পরিচিত একটি টুলস BLAST এর মাধ্যমে। এই টুলস ব্যবহার করে কোন একটা সিকোয়েন্সের সাথে মিল আছে ডেটাবেজের এমন সিকোয়েন্সসমূহ বের করা যায়। শুধু তাই নয়, কতটুকু মিল তাও বের দেখা যায় বিভিন্ন স্কোরিং এর মাধ্যমে। ফাইলোজেনেটিক ট্রি তৈরির জন্য বিভন্ন সফটওয়ার ব্যাবহার করা যায় যেমন Maft, MUSCLE, T-coffee।
এখানে অন্যান্য যেসব ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স ব্যবহার করা হয়েছিল সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হল সার্স করোনা ভাইরাস, মার্স করোনা ভাইরাস, ব্যাট-সার্সলাইক করোনা ভাইরাস ইত্যাদি। এখানে দেখা যায় নভেল করোনা ভাইরাসের সাথে সার্স বা মার্স করোনা ভাইরাসের চেয়ে ব্যাট সার্স-লাইক করোনা ভাইরাসের দুটি প্রজাতির জিনোম সিকোয়েন্স এর বেশি মিল রয়েছে। ফাইলোজেনেটিক ট্রি দেখলে দেখা যায় সার্স-লাইক করোনা ভাইরাসের দুটি প্রজাতি নভেল করোনা ভাইরাসের খুব কাছে অবস্থান করছে যেটি নির্দেশ করে এদের ইভলিউশন বাঁ অভিব্যক্তির মাধ্যমেই হয়তো নভেল করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি। এই ভাইরাসের সংস্পর্শে কিভাবে এলো তা বের করতে গিয়ে নয়জন রোগিকে পর্যবেক্ষন করে দেখা যায় নয় জনের আট জনই হুনান সামুদ্রিক খাবারের বাজারে গিয়েছিল এবং বাকি একজন সেই বাজারে না গেলেও সেই বাজারের পাশে একটি হোটেলে অবস্থান করেছিল। সেখান থেকে ধারনা করা হয় যে নিশ্চয় তাদের এই রোগের সাথে এই বাজারের কোন একটা সংযোগ রয়েছে। আর সেই বাজারে শুধুমাত্র জলজ প্রাণী ছাড়াও অন্যন্য প্রাণী যেমন খরগোশ, কিছু পাখিও পাওয়া যেতো যেগুলো হতে পারে এই ভাইরাসের বাহক। এখন আমরা জানি প্যাংগোলিন বা বনরুই নামক এক পশু এর বাহক।
যাইহোক, এরপরের কাজ হলো এই ভাইরাসের রোগ সৃষ্টির প্রক্রিয়া, ডায়াগনোসিস এর সহজ পদ্ধতি এবং রোগের প্রতিষেধক বের করা, সে নিয়ে নাহয় অন্য আরেকদিন আলোচনা হবে।
তথ্যসূত্র:
১। Lu R, Zhao X, Li J, et al. Genomic characterisation and epidemiology of 2019 novel coronavirus: implications for virus origins and receptor binding. Lancet. 2020;395(10224):565–574. doi:10.1016/S0140-6736(20)30251-8
Leave a Reply