মহাবিস্ফোরণ থেকে নীল গ্রহ

বিগব্যাং থেকে পরমাণু  

আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব এর একটি সমাধান থেকে বেরিয়ে আসে মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত প্রসারণশীল। এই কথা আইনস্টাইন নিজেই বিশ্বাস করতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন মহাবিশ্ব নিজে নিজে কি করে প্রসারিত হতে পারে! তাই সেই সমাধান সংশোধন করার জন্যে তিনি তাঁর আপেক্ষিকতার সূত্রে একটা মহাজাগতিক ধ্রুবক বসিয়ে দিলেন। পরবর্তীতে বিজ্ঞানী হাবল বিখ্যাত ডপলার ইফেক্ট এর মাধ্যমে দেখান যে গ্যালাক্সি গুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তারপর মহাজ্ঞানী আইনস্টাইন তার ভুল বোঝতে পেরে বলেন, ‘এটি ছিল আমার জীবনের মস্ত বড় এক ভুল’। যেহেতু গ্যালাক্সি গুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তার মানে অবশ্যই মহাবিশ্বের সব কিছু এক সময় একটা বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত ছিল। বিজ্ঞানীরা বোঝতে পারলেন নিশ্চয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু একটা প্রসারণ দিয়ে শুরু হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন ( ১ বিলিয়ন = ১০০ কোটি ) বছর আগে শুরু হয়েছিল সেই মহাপ্রসারণ। এর নাম দেয়া হল বিগব্যাং।

আইনস্টাইন

মহাবিস্ফোরনের প্রথম ১০-৩০ সেকেন্ড প্রসারণের গতি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের। আলোর গতির চাইতেও বেশি। এই অবস্থাকে বলা হয় ইনফ্ল্যাশান। এই অবস্থায় বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের আকার ১০৬০ গুন বেড়েছিল। এই অচিন্তনীয় প্রসারণের পর মহাবিশ্বের আকার একটা ছোট কমলা লেবুর মতোন হলো! তারপর থেকে ১৩.৮ বিলিয়ন বছর কেটে গেছে। প্রসারিত হতে হতে বিশ্বব্রহ্মান্ড আজকের একশো বিলিয়ন আলোকবর্ষের সমান হয়েছে ( আলো এক বছরে যতদূর যায় তাকে বলে এক আলোকবর্ষ )। মহাপ্রসারণের বিভিন্ন সময়ে আমাদের চেনা চারটি মৌলিক শক্তির (মহাকর্ষ বল, তড়িৎচৌম্বক বল, দুর্বল নিউক্লিয় এবং সবল নিউক্লিয় বল) আত্মপ্রকাশ ঘটে। সময়ের সাথে সাথে ভিন্ন ভিন্ন মৌলিক বলের প্রতিক্রিয়ায় জন্ম হলো ভিন্ন ভিন্ন কণার। বিগব্যাং এর প্রথম ১ সেকেন্ডের ভেতর নিউট্রন, প্রোটন জাতীয় কণা গুলো তৈরি হয়ে গেল। কণা তৈরির সময় একই সাথে পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ তৈরি হয়।

কখন কী কী কণা সৃষ্টি হয়েছে

সুতরাং প্রোটন এবং নিউট্রন এর সমসংখ্যক এন্টি প্রোটন এবং এন্টি নিউট্রনও তৈরি হয়েছে। পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ পরস্পরের সংস্পর্শে আসলে একে অপরকে ধ্বংস করে অদৃশ্য হয়ে যায়। সুতরাং একটাও প্রোটন বা নিউট্রন অবশিষ্ট থাকার কথা নয়। কিন্তু প্রকৃতির কোনো এক বিচিত্র কারণে পদার্থের চাইতে প্রতি পদার্থ কিছু পরিমাণ বেশি তৈরি হয়েছিল। এক বিলিয়নে একটি। যার কারণে কিছু প্রোটন এবং নিউট্রন বেঁচে যায়। তা না হলে পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠনের জন্যে প্রোটন বা নিউট্রন থাকার কথা ছিল না। মহাবিস্ফোরণের এক সেকেন্ড থেকে তিন মিনিটের ভেতর ইলেকট্রন নামক কাণা তৈরি হয়ে গেল। এখানেও সেই একই বিষয়। ইলেকট্রনের প্রতিপদার্থ পজিট্রন তৈরি হল। এখানেও সেই একই বিচিত্র কারণে কিছু ইলেকট্রন বেশি তৈরি হল। তারপর প্রথম বিশ মিনিট এর ভেতর প্রোটন আর নিউট্রন মিলে পরমাণুর নিউক্লিয়াস গঠিত হওয়া শুরু হল। কিন্তু তখনও পরমাণু তৈরি হওয়া শুরু হয় নি। পরমাণু তৈরি হবার জন্যে অপেক্ষা করতে হলো আরো ৩,৮০,০০০ বছর। তখন আমাদের কমালা লেবুর মতো ছোট মহাবিশ্ব অনেকটা বড় হয়ে গেছে। এর তাপমাত্রা অনেক কমে এসেছে। তখন ইলেক্ট্রন আর নিউক্লিয়াস মিলে পরমাণু তৈরি হতে থাকল। প্রথমে হাইড্রোজেন (৭৫ ভাগ) এবং অল্প কিছু সংখ্যক হিলিয়াম (২৫ ভাগ) তৈরি হয়েছিল। তখনো মহাবিশ্ব ছিল বিদঘুটে অন্ধকার। কারণ তখনো তারারা জ্বলে উঠে নি। তার জন্যে আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে আরো ১৫০মিলিয়ন বছর।

পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ পরস্পরের সংস্পর্শে আসলে একে অপরকে ধ্বংস করে অদৃশ্য হয়ে যায়।

ডার্ক ম্যাটার এবং তারাদের জন্ম

একটা আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে বিগব্যাং এর সময় তৈরি হওয়া ইলেকট্রন, প্রোটনের সবটা আমাদের পরিচিত এবং দৃশ্যমান বস্তু তৈরিতে ব্যবহৃত হয় নি। এর বাইরেও আরো অদৃশ্য কিছু তৈরি হয়েছে। আমরা এদের সম্পর্কে কিছুই জানি না। এদের নাম করা হয়েছে ডার্ক ম্যাটার। বর্তমানে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মোট ভরের ২৩ ভাগ হচ্ছে ডার্ক ম্যাটার। সেই সাথে আমাদের জানা পদার্থের পরিমাণ হচ্ছে মাত্র ৪.৬ ভাগ! বাকিটা হচ্ছে ডার্ক এনার্জি। ডার্ক ম্যাটার আমরা দেখি না। কিন্তু এর মহাকর্ষ বল অনুভব করা যায়। ডার্ক ম্যাটারের মহাকর্ষ বলের কারণে মহাবিশ্বের জাগায় জাগায় হাইড্রোজেন গ্যাস জমা হতে থাকে। মহাকর্ষ বলের কারণে সেগুলো কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। চাপের কারণে এর ভেতর তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা যথেষ্ট বেড়ে গেলে সেখানে নিউক্লিয়ার ফিউশান বিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়৷ ফিউশান বিক্রিয়ার পরে তৈরি হয় প্রচন্ড শক্তি। আর সেই শক্তি নিয়ে সেখানে জ্বলে উঠে একটি নক্ষত্র। এভাবেই একটি একটি করে গঠিত হতে থাকে তারারা।

আর এরকম বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র নিয়ে গঠিত হতে থাকে এক একটি গ্যালাক্সি। আর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্যালাক্সি।

বিগব্যাং থেকে মহাবিশ্বের বিবর্তন।

আমাদের সৌরজগৎ

আমরা যেই গ্যালাক্সিতে বাস করি তার নাম ছায়াপথ। আমাদের সূর্য ছায়াপথের একটি তারা। ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে একটা নেবুলা থেকে সূর্যের সৃষ্টি। ছায়াপথের এক প্রান্তে বেশ খানিকটা গ্যাস, ধুলোবালি আর হাইড্রোজেন মিলে তৈরি করে এই নেবুলা। ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে এই নেবুলার কাছাকাছি একটা নক্ষত্রের বিস্ফোরণের আঘাতে নেবুলাটির গ্যাস, ধুলাবালি ঘুরপাক খেতে লাগল। ধীরে ধীরে সেগুলো কেন্দ্রে জমা হতে লাগল। যত জমা হচ্ছিল ততই এর আকর্ষণ বাড়তে থাকল এবং নেবুলার ধুলাবালি গ্যাসকে আরও আকর্ষণ করতে লাগল। অবশেষে নেবুলার প্রায় ৯৯ শতাংশ পদার্থ কেন্দ্রে জমা হল এবং প্রচণ্ড চাপে তার তাপমাত্রা বেড়ে গেল। তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে এক সময় ভেতরে নিউক্লিয়ার ফিউশান বিক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। হঠাৎ জ্বলে উঠল সূর্য-আমাদের শক্তিদাতা।

আমাদের সৌরজগৎ

নেবুলার আশ পাশের বাকি অংশ ঘুরতে ঘুরতে এক সময় জমাট বেঁধে জন্ম হতে থাকে গ্রহগুলির। ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে জন্ম নেয়া গ্রহগুলির একটা হল আমাদের এই প্রাণের নীল গ্রহ-আমাদের পৃথিবী। এর কাছাকাছি কোন এক সময়ে ‘থিয়া’ নামের একটি গ্রহাংশের সঙ্গে আমাদের পৃথিবীর সংঘর্ষে তৈরি হল আমাদের একমাত্র উপগ্রহ চাঁদের।

তথ্যসুত্রঃ

  • বিগব্যাং থেকে হোমো স্যাপিয়েনস (মুহম্মদ জাফর ইকবাল)
  • স্পেস ডট কম

লেখাটি 453-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. নেবুলা মানে কি ?

    1. Sujoy Kumar Das Avatar
      Sujoy Kumar Das

      গ্যালাক্সির জায়গায় জায়গায় ধুলাবালি, বিভিন্ন গ্যাস বিশেষ করে হাইড্রোজেম, হিলিয়াম একসাথে বেশ জমাট বেধে থাকতে দেখা যায়। এগুলোকে নেবুলা বলা হয়।

  2. মিঠুন পাল Avatar
    মিঠুন পাল

    আমি বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেছি বুঝার। মহাকাশ নিয়ে ধাঁধা লাগায় কতটুকু মনে রাখতে পারব সন্দিহান। 😅

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 908 other subscribers