রসিকেরা বলে থাকেন, আমাদের আদি-পিতা মাতাকে বেহেশত থেকে বের করে দেয়ার কারন আসলে একঘেয়েমী। অফুরন্ত সুখের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় যে অতল একঘেয়েমীর সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্ররোচনাতেই তারা নিষিদ্ধ ফলের দিকে মনোযোগ দিয়েছিলেন। ইসস!! ওনারা এটা না করলে আমরাও হয়তো… যাই হোক, আমরা যারা যারা এই মুহুর্তে একঘেয়েমীতে ভুগছি তারা তারা একটু নড়ে চড়ে বসি- কেননা এই লেখাটি আমাদের জীবন বদলে দিতে যাচ্ছে…না।
একঘেয়েমী এক ধরনের অনুভূতি বা মানসিক অবস্থা যাকে আমরা কেউই চাইনা। অনেক মানুষ পাওয়া যাবে যারা কষ্ট পেতেও ভালোবাসে, কিন্তু একঘেয়েমীর প্রশ্নে পলায়নপর। আমরা আমজনতা নিজেদের সুখ, দুঃখ নিয়ে যতটা পেরেশান হই, এদের পেতে বা রেহাই পেতে যতটা সচেষ্ট একঘেয়েমী নিয়ে কি ততটা ভাবি? প্রশ্ন করতে পারেন, এটা নিয়ে ভাবার কি আছে? ভ্যান গগ তো বলেই গেছেন- একঘেয়েমীতে ভোগার চাইতে মরে যাওয়া ভালো, তাইনা? কিন্তু বিজ্ঞানীরা ভাবছেন। তারা খুঁজে চলেছেন একঘেয়েমী আসলে কি? এটা ভালো না খারাপ? কোন ধরনের মানুষ অতি সহজে এতে আক্রান্ত হয়? আক্রান্ত হলে প্রতিকার কি? ইত্যাদি নানা কিছু। তাদের ভাবনা চিন্তা বর্তমানে কোন অবস্থায় আছে সেটা সম্পর্কেই চেষ্টা করবো একটু ধারনা নেয়ার।
ভেবে দেখবেন তো, একঘেয়ে লাগার জন্য কারন থাকে, নাকি একঘেয়ে যাতে না লাগে সেজন্য কোন একটা কারন দরকার। আমরা সাধারনত কোথায় একঘেয়েমীতে ভুগি? কারো ক্লাসে একঘেয়ে লাগে, কারো লাগে মিটিং এ, ট্রাফিক জ্যামে পড়লে তো কমবেশি সবারই লাগে। আপনার আসেপাশের সবারই নানান কিছু একঘেয়ে লাগে। সবারই বলতে কিন্ত মানুষ ছাড়াও পরিবেশের অন্যান্য সদস্যদের কথাও বলেছি। হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল, কুকুর বেড়ালেও অন্যান্য বিভিন্ন অনুভূতির সাথে একঘেয়েমীর একটা প্রজাতীর সংস্করন আছে। প্রাণিজগতে এই ব্যাপারটার বিস্তার দেখে কিউরিয়াস মাইন্ডে প্রশ্ন জাগতেই পারে “টিকে থাকার লড়াইয়ে একঘেয়েমীর কোন অবদান আছে কি ?”
শুনতে যেমনই লাগুক, বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন একঘেয়েমী এক ধরনের প্রেরণার উৎস। হ্যা বলতে পারেন ঠিক সে ধরনের প্রেরণা নয় যার টানে আমরা কিছু একটা করে থাকি, বরং উল্টো এটা আমাদের ইচ্ছাকে ঠেলাঠেলি করে কাজ করার লেভেলে নিয়ে যায়। প্রাণি মনস্তত্ববিদ ফ্রাঙ্কোয়ে ওমেলস্ফেল্ডার বলেন “আমরা অনেক প্রমাণ পেয়েছি যদি একটি বন্য জন্তু অনেকটা সময় কিছু না করে কাটিয়ে দেয়, সে এর পরে ঠিকই করার জন্য কিছু একটা খুজে নেবে এবং এর মধ্যে অবশ্যই টিকে থাকার একটা যোগসূত্র রয়েছে। হয়তো সে নিজের এলাকা প্রদক্ষিন করতে যাবে এবং দেখতে পাবে শিকারীর আক্রমনের সময় পালানোর জন্য অপরিহার্য রাস্তাটি কোন কারনে বন্ধ হয়ে রয়েছে, যা ঠিক করে ফেলার মাধ্যমে তার টিকে থাকার সম্ভাব্যতা সে বাড়িয়ে ফেললো।” এই দিকটাকে যদি উপকারী হিসেবে ধরেন তাহলে এটা ততক্ষনই কাজে আসবে যতক্ষন অন্বেষনের আগ্রহ থাকবে। ওমেলফেল্ডার আরো বলেন “সব প্রাণিরই প্রকৃতির সাথে মিথস্ক্রিয়ার চাহিদা এবং প্রয়োজন আছে। তাই বন্দি অবস্থায় তারা একঘেয়ে অনুভব করে এবং উটভট আচরন করে থাকে। তারা হয়তো ঠিক ভাবতে পারেনা ‘উফফ এত বোরিং কেন?’ তবে তাদের অশান্ত পায়চারী, নিজের লোম উপড়ানো দেখে এটা বুঝা যায়”
যদিও মানুষের একঘেয়েমী আরো জটিল তবে কিছু সামঞ্জস্যও রয়েছে। অন্যান্য প্রাণির সাথে মিল খুজতে গেলে দেখা যাবে আমরা মানুষেরা শারীরীক কিংবা মানসিক ভাবে আবদ্ধ হয়ে পড়লে একঘেয়েমী নাড়া দিয়ে ওঠে। একটি গবেষনার উদাহরন দেয়া যায়, একদল লোককে পছন্দ করার সুযোগ ছাড়াই ঠিক করে দেয়া হয়েছিলো কোন একটি নিরস কাজে অংশগ্রহন করতে হবে আরেক দল পছন্দ করে সেই একই কাজে অংশগ্রহন করে। প্রথম দলের ক্ষেত্রে সময়কে দীর্ঘ এবং কাজটিকে বেশি একঘেয়ে মনে হয়েছিলো।
আমরা সবাই জানি একঘেয়েমী কাকে বলে। সময় থমকে দাড়ায়, প্রয়োজনীয় কাজে মনযোগ দেয়া যায়না, যেসব কাজে আনন্দ পেতাম সবই একে একে ব্যার্থ হয়। তবে পরীক্ষাগারে গবেষনা করার জন্য সঠিকভাবে একঘেয়েমীকে সংজ্ঞায়িত করা বেশ কঠিন। এটা শুধু কাজে অরুচি আর বন্দিত্বের অনুভুতিই নয়, এর সাথে যুক্ত হতে পারে হতাশা, উদাসীনতা, বিষন্নতার মত অনুভুতি। একঘেয়েমী কি শুধুই নিস্তেজ আর খাপছাড়া ভাব নাকি ক্রমাগত অস্থিরতাকেও একঘেয়েমীর কাতারে ফেলা যায় তা নিয়ে কোন সমাধানে এখনো পৌছানো যায়নি। জার্মানির কন্সতানয বিশ্ববিদ্যালয়ের টমাস গোয়েটস ধারনা করেন একঘেয়েমী আসলে এগুলোর সবই। মানুষের একঘেয়েমী নিয়ে অভিজ্ঞতার ওপর সমীক্ষা চালিয়ে টমাস এবং তার দল ৫ ধরনের একঘেয়েমীর শ্রেণিবিভাগ করেছেন। দেখা গেছে একজন মানুষ কোন না কোন সময় যেকোন একঘেয়েমীর শিকার হতে পারেন, এবং উপযুক্ত পরিস্থিতিতে এক ধাঁচ থেকে অন্য ধাঁচে অনুপ্রবেশ করতে পারে কিন্তু প্রত্যেকেই যেকোন একটি ধাঁচে বিশেষজ্ঞ হয়ে থাকেন। অর্থাৎ একটি বিশেষ ধরনের একঘেয়েমী তার ব্যাক্তিত্বের অংশ হয়ে দাড়ায়।
এই পাঁচটি ধাঁচের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর হল প্রতিক্রিয়াশীলতা। বিপজ্জনক মাত্রার উত্তেজনা ও নেতিবাচক অনুভুতির সাথে অস্থিরতা যুক্ত হয়ে একটি রাগান্বিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। গোয়েটসের মতে উদাসীনতা হলো সবচেয়ে কম ক্ষতিকর। এতে কেউ খুব মনমুগ্ধকর কোন কাজে জড়িত না থাকলেও, খুব একটা বিরক্তও থাকেনা। বরং একটি নির্ভার এবং শান্তির অনুভুতিতে ডুবে থাকে। তাঁর মতে উপযুক্ত পরিস্থিতিতে এই ধরনের একঘেয়েমী হতে পরে একটি ইতিবাচক অভিজ্ঞতা। “মনের ভেতর একঘেয়েমী সহ অন্যান্য সব অনুভুতির আবাসের পেছনে উপযুক্ত কারন রয়েছে” এমনটাই মনে করেন ইউনিভার্সিটি অব ল্যাঙ্কাশায়ারের মনস্তত্ববিদ স্যান্ডি মান। তিনি বলেন আমরা সবাই একঘেয়েমী ভয় পাই তবে, ইতিবাচক একঘেয়েমী কিছু কিছু ক্ষেত্রে শুধু উপকারীই নয়, এটা আমাদের সৃষ্টিশীল কিছু করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। গত বছর এক এক্সপেরিমেন্টে দুই দল স্বেচ্ছাসেবককে বলেছিলেন প্লাস্টিকের ফেলনা কাপ দিয়ে মজার কিছু করে দেখাতে। এক দল সরাসরি কাজে নেমে গিয়েছিলো, অন্য দল ১৫ মিনিট ধরে টেলিফোন ইন্ডেক্সের নাম্বার কপি করেছিলো। আর ফলাফলে, পরের দলের বের করা আইডিয়া গুলো বেশি মজার ছিলো। অবশ্য তাদের সাথে আরেকটি দল ছিলো যারা শুধু টেলিফোন ইন্ডেক্স ১৫ মিনিট ধরে পড়ে কাজে নেমেছিলো। তাদের আইডিয়াগুলোও খারাপ ছিলোনা। স্যান্ডির এই এক্সপেরিমেন্টের উপসংহারে বলেন নিষ্ক্রিয় একঘেয়ে কাজ সৃষ্টিশীলতাকে উজ্জীবিত করতে পারে, কেননা সেই সময় মন নিজের মত চড়ে বেড়ানোর সুযোগ পায়।
তবে কানাডার ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির জন ইস্টউড, স্যান্ডির তত্বের সাথে একমত নন। তার ভাস্যমতে আপনার মন যদি মুক্তই থাকলো তাহলে সেটা একঘেয়েমী নয়। “আমার মতে একঘেয়েমী নিরাসক্ত ও অনাহূত একটা মানসিক অবস্থা, তবে এই অবস্থার সাথে আমরা মানিয়ে নিতে পারি” তিনি আরো যোগ করেন “ব্যাথার অনুভুতির সাথেও আমরা মানিয়ে নিতে পারি- শারীরিক যন্ত্রনার অনুভুতি না থাকলে এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন হতামনা। তার মানে কি আমাদের ব্যাথার জন্য খোজাখুজি করতে হবে? না” অন্য কথায় একঘেয়েমী যদি আমাদের টিকে থাকায় সাহায্য করেও থাকে, একে পুষে রাখাটা যুক্তিযুক্ত নয়। অনুভুতিগুলো আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, কোন একটি পরিবেশে আমরা কি অবস্থায় আছি। একঘেয়েমী এটাই বলে যে আমরা আমাদের কাজের ক্ষমতা এবং পৃথিবীর সাথে যুক্ত হবার আকাংক্ষাকে আটকে দিয়েছি। প্রশ্ন হল এই অবস্থায় আমরা কি করতে পারি? ইস্টউডের বিশেষ আগ্রহ হচ্ছে একঘেয়েমীকে সঠিকভাবে বুঝা এবং তার মডেল থেকে দেখা যায় একঘেয়েমী সহ্য করা কেন এমন কঠিন। তার মডেল অনুসারে একঘেয়েমীর মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমাদের মনযোগকে যায়গামত রাখার ব্যার্থতা। সমস্যাটা অনুপ্রেরনার অভাব নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছুতে মনোনিবেশ করতে না পারা। সময় শ্রোতের থেকে মনযোগ সরানোর মত কিছু খুজে না পাওয়ার কারনে তখন মনে হতে থাকে যেন খুব ধীরে চলছে, আবার জোড় করে উত্তোরনের চেষ্টা আরো খারাপ লাগার সৃষ্টি করে। মানুষ পৃথিবীর সাথে যুক্ত হতে চেষ্টা করে, সেটা করতে না পারলে আসে হতাশা এবং বিরক্তি। এরপর তারা চেষ্টা করা ছেড়ে দেয়, কিন্তু তাতেও ভালো না লাগায় তারা আবার সক্রিয় হতে চেষ্টা করেন। তার মানে নিষ্পৃহ আর অতিষ্পৃহ অবস্থার একটা দোলাচাল চলতে থাকে সমস্যাটি সমাধানের জন্য। ইস্টউড বলেন, চিন্তার বিষয় হচ্ছে বারবার মনযোগ প্রদানে ব্যার্থতা এমন অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে যেখানে আমাদের আর কিছুই করতে ইচ্ছে করেনা, সবই অর্থহীন মনে হয়।
জন ইস্টউড এখন খুজার চেষ্ট করছেন কেন এই মনযোগ প্রকৃয়া ব্যহত হয়। যদিও ধারনাটি এখনো শৈশবে, তবে তাদের মতে একঘেয়েমীতে আক্রান্ত হবার প্রবনতা ব্যাক্তিত্বের সাথে জড়িত। যেসব মানুষ আনন্দ-উত্তেজনা দ্বারা পরিচালিত তারা খুব বাজেভাবে একঘেয়েমীতে ভোগেন। আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্তরাও এতে আক্রাত হন।
মনযোগ দিতে অপারগতার কারন বের করা গেলে সেটা হয়তো বুঝতে সাহায্য করবে, কেন একঘেয়েমী এত খারাপ লাগে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা একটি স্মার্টফোন অ্যাপ বানিয়েছিলেন, যেটার কাজ ছিলো দিনের যেকোন র্যান্ডম সময়ে ব্যাবহারকারীকে জিজ্ঞেস করা তিনি কাজ করছেন কিনা, এবং তিনি কতটা সুখী। এর থেকে পাওয়া তথ্য থেকে দেখা গেল যারা তাদের কাজে মনযোগ দিতে পারছেন না, তারাই বেশি অসুখী।
কিছু কিছু সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে যারা সহজেই একঘেয়েমীতে আক্রান্ত হয় তারা লেখাপড়া, ক্যারিয়ার তথা সামগ্রিক জীবনে খুব একটা উন্নতি করতে পারেন না। তাদের রাগ অন্যান্য আচরনগত সমস্যা থাকে। তারা মাদক, জুয়া – এধরনের ঝুকিপূর্ন কাজে জড়িয়ে পড়ে। আরেকটি সমীক্ষায় এমনও দেখা গেছে যে একঘেয়েমী মৃত্যুর কারনও হতে পারে। ১৯৮৫ সালে লন্ডনে সরকারী কর্মজীবদের বলা হয়েছিলো তাদের একঘেয়েমীর মাত্রাকে নিজেরা রেটিং করতে। ২০০০ সালে তাদের খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো যারা বলেছিলেন তারা বেশি একঘেয়েমীতে ভোগেন তারা অনেকেই ইতোমধ্যে মারা গেছেন।
তবে একঘেয়েমী নিজে কাউকে মারেনা, একঘেয়েমী কাটাতে আমরা যেসব করতে যাই সেগুলোই আমাদের বিপদে ফেলে দেয়। তো বিপদে পড়ার আগেই একে প্রতিরোধ করতে আমরা কি করতে পারি? টমাস গোয়েটস এবং তার দলের থেকে একটি পরামর্শ পাই। কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তারা দেখেছেন যারা কোন প্রয়োজনীয় কাজকে একঘেয়ে হিসেবে মেনে নিয়েও তাতে লেগে থাকে, তাদের তুলনায় যারা এই পরিস্থিতিকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে তাদেরই ভোগান্তি বেশি। তাই, যখন একঘেয়েমী ঘিরে ধরে তখন নিজেকে টিভি, ফাস্টফুড, কিংবা ফেসবুকে ব্যাস্ত রাখার চেষ্টা খুব একটা ভালো বুদ্ধি না। আপনার যদি একঘেয়েমী থেকে গঠনমূলকভাবে উত্তোরনের ইচ্ছা বা উপায় ভেতর থেকে না আসে, তখনই শূন্যতা নিরসনের জন্য ক্ষতিকর কিছুতে লিপ্ত হন। যাদের সেই পরিস্থিতিকে মেনে নেয়ার মত ধৈর্য রয়েছে, রয়েছে আত্নবিশ্বাস ও সৃষ্টিশীলতা নতুনত্বের মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করার, তারাই পারেন এর থেকে ভালো কিছু বের করে আনতে।
তথ্যসূত্রঃ
১। ‘Never dull a moment’ by Kristen Weir, Monitor on psychology.
২। ‘Why being bored is stimulating – and useful, too’ by Caroline Williams, New Scientist.
Leave a Reply