নির্লবণীকরণ কী? কেন প্রয়োজন?
ছোটবেলা থেকেই আমরা আমাদের বিজ্ঞান বইয়ে পড়ে আসছি পৃথিবীর চারভাগের তিনভাগ জল আর এক ভাগ মাটি। তাই আপাত-দৃষ্টিতে আমাদের মনে হতে পারে আমাদের বুঝি কোনো কালে পানির ঘাটতি হবে-ই না।কিন্তু এ ধারণা পুরোপুরি সঠিক নয়। আনুমানিকভাবে আমাদের পৃথিবীর মোট পরিমাণের ৭০ ভাগ পানি এবং ৩০ ভাগ মাটি বা স্থলভূমি।
পৃথিবীর পানির এই মোট পরিমাণের ৯৭ ভাগই লবণাক্ত যা আমাদের ব্যবহার উপযোগী নয়। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বাকী যে ৩ ভাগ বিশুদ্ধ পানি রয়েছে তার অধিকাংশই হিমবাহরুপে (বরফ হিসেবে) থাকে। ফলে গড় হিসেবে পৃথিবীর মোট পানির পরিমাণে আমাদের ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। ব্যবহারযোগ্য এই সামান্য অংশটুকুও জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পানি দূষণ, বিশ্বব্যাপী পানির অপচয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বিভিন্ন শিল্পকারখানা বৃদ্ধির ফলে ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে আমাদের পড়তে হতে পারে জল-সংকটে।আর এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের জন্যই প্রয়োজন ডিস্যালিনেশন প্রযুক্তির প্রয়োগ ও বিকাশ।
লবণাক্ত পানি না হয় আমাদের ব্যবহার অনুপোযোগী, কিন্তু আমরা যদি লবণাক্ত পানি থেকে লবণ অপসারণ করে বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর করি তাহলে কিন্তু এই সমস্যার অবসান ঘটানো সম্ভব।আর যে পদ্ধতিতে এটি করা হবে সেটাই হচ্ছে ডিস্যালিনেশন বা ডিসল্টিং (Desalination or Desalting). বাংলায় এই পদ্ধতিকে বলা যেতে পারে নির্লবণীকরণ। অর্থাৎ সমুদ্রের লবণাক্ত পানি থেকে লবণ অন্যান্য ও অন্যান্য দূষিত পদার্থ অপসারণ করে ব্যবহার উপযোগী বিশুদ্ধ পানি উৎপাদনের পদ্ধতিকেই বলে ডিস্যালিনেশন বা নির্লবণীকরণ। তবে শুধুমাত্র সমুদ্রের পানিকে বিশুদ্ধ পানিতে পরিণত করতেই ডিস্যালিনেশন ব্যবহৃত হয় না, বরং লবণাক্ত বা আংশিক লবণাক্ত পানি বিদ্যমান যেকোনো জলাশয় থেকে বিশুদ্ধ পানি পেতে ব্যবহার করা যেতে পারে এই পদ্ধতি।
ডিসলিন্যাশনের বিভিন্ন পদ্ধতি এবং কীভাবে কাজ করে?
যেহেতু এই পৃথিবীর অতি সামান্য পরিমাণ পানি আমাদের ব্যবহারযোগ্য তাই ভবিষ্যৎ সংকটের কথা ভেবে বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের ও অন্যান্য উৎসের নোনা পানিকে কিভাবে আমাদের গ্রহণযোগ্য করা যায় সে নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন।তারা এই ডিসলিন্যাশন নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন, উদ্দেশ্য- এর ব্যয় কমিয়ে কম খরচে নোনা জলকে ব্যবহারযোগ্য জলে রূপান্তর করা।
নোনাজল থেকে লবণকে আলাদা করে গ্রহণউপযোগী পানিতে পরিণত করার অনেক পদ্ধতি থাকলেও অধিকাংশ সময়ই মাত্র দুটি পদ্ধতির একটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ দুটো হচ্ছে- মাল্টিস্টেজ ফ্ল্যাশ (Multistage flash) এবং রিভার্স অসমোসিস (Reverse Osmosis).
Multistage Flash (মাল্টিস্টেজ ফ্লাশ)
এ প্রক্রিয়ায় সমুদ্রের জলকে পাম্প করে কোনো একটি ট্যাংকে নেওয়া হয়।তারপর একে তাপ দিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়।সেই বাষ্পকে আবার ঘনীভূত করে তরলে পরিণত করা হয় এবং অতঃপর একে আরও তাপ দিয়ে বাষ্পে পরিণত করা হয়। এভাবে একাধিকবার পাতন প্রক্রিয়ায় তরল হতে বাষ্প, বাষ্প হতে তরল.. করে একে বিশুদ্ধ পানিতে রূপান্তর করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় প্রচুর তাপশক্তির প্রয়োজন হয় বিধায় খরচও অনেক বেশি।
Reverse Osmosis (রিভার্স অসমোসিস)
Reverse Osmosis প্রক্রিয়া হচ্ছে অভিস্রবণ প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত।অর্থাৎ, অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় কম ঘনত্বের স্থান হতে বেশি ঘনত্বের স্থানের দিকে দ্রবণ ধাবিত হলেও রিভার্স অসমোসিস প্রক্রিয়ায় বেশি ঘনত্বের স্থান হতে কম ঘনত্বের স্থানের দিকে দ্রবণ ধাবিত হয়। এ প্রক্রিয়ায় পানি বিশুদ্ধকরণে তাপ ও শক্তির তুলনামূলকভাবে খুব বেশি প্রয়োজন না পড়ায় Multistage Flash হতে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কম খরচ হয়।এই পদ্ধতিতে নোনাজল হতে আয়ন ও অন্যান্য অনাকাঙ্খিত খনিজ দ্রব্যকে পৃথক করতে একটি অর্ধভেদ্য পর্দা ব্যবহার করা হয়।এই প্রক্রিয়ায় অসমোটিক প্রসার প্রয়োগ করে পানিকে Reverse Osmosis Membrane(অর্ধভেদ্য পর্দা) এর দিকে ধাবিত করা হয়।এই পর্দার ছিদ্রসমূহের ব্যাস হচ্ছে ০.০০০১ মাইক্রন।অন্যদিকে বিভিন্ন অণুজীবের ব্যাস প্রায় ০.০১ মাইক্রনের কাছাকাছি, যা অর্ধভেদ্য পর্দায় থাকা ছিদ্রের চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বড়।ফলে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, ময়লা, ধূলিকণা এই পর্দা ভেদ করে যেতে পারে না।শুধু মাত্র পানিতে দ্রবীভূত হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন এবং কিছু দ্রবীভূত খনিজ পদার্থ এই পর্দা ভেদ করে অপরদিকে আরেকটি ট্যাঙ্কে জমা হয় এবং এ প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত পানি শতভাগ বিশুদ্ধ ও ব্যবহার উপযোগী।
ডিসলিন্যাশনে চ্যালেঞ্জসমূহ
ডিসলিন্যাশনের মাধ্যমে প্রধানত সমুদ্রের জল হতে লবণ ও অন্যান্য ক্ষতিকর দ্রব্য অপসারণ করে বিশুদ্ধ জল উৎপাদন করা হয়। এই ক্ষতিকর ও অপসারিত দ্রব্যগুলোকে সাধারণত ব্রাইন বলা হয়ে থাকে। এই পদার্থগুলোর ঘনত্ব অনেক বেশি এবং খুবই বিষাক্ত যা পানিতে ফেললে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও পানিদূষণ সহ জলজ প্রাণীদের জন্য হুমকিস্বরূপ হয়ে যায়। অন্যদিক মাটিতে পুঁতে ফেললে মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পায়। মাটি দূষিত ও অনুর্বর হয়ে যায়।সেখানে সাধারণত আর গাছ জন্মায় না।
তাছাড়া এই প্রকল্পের খরচ অনেক বেশি।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনায় ডিসলিন্যাশন
ব্যয়বহুল হলেও বিশ্বের অনেক দেশ ডিসলিন্যাশন প্রযুক্তিকে নিরাপদ পানি পাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। বিশ্বব্যাপী ডিসলিন্যাশন প্ল্যান্টগুলোর সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে তা নিয়ে গবেষণা কার্যক্রমও ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত পাঁচ দশকে সরকারী ও বেসরকারীভাবে এই প্রকল্পে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। ব্যয়বহুল এই প্রকল্পের মাধ্যমে যে বিপুল পরিমাণ শক্তির অপচয় ঘটে তা হয়তো ভবিষ্যতে উন্নত প্রযুক্তিজ্ঞানের সাহায্যে আরও কমিয়ে আনা সম্ভব, এমনটাই প্রত্যাশা বিশ্বব্যাপী বিজ্ঞানীদের।ভবিষ্যতে হয়তো এই ডিসলিন্যাশনই হবে আমার আপনার নিরাপদ পানি পাওয়ার একমাত্র মাধ্যম।
আমাদের করণীয়
বিশ্বে দ্রুতহারে বাড়ছে জনসংখ্যা, সংকটে বিশুদ্ধ পানি। পৃথিবীব্যাপী প্রতিদিন প্রায় দুই মিলিয়ন টন শিল্পকারখানা, কৃষিকাজ, গৃহস্থালিসহ অন্যান্য বর্জ্য সমুদ্র, নদ-নদী ও অন্যান্য জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে(UN WWAA 2003). তাছাড়া আমাদের পানি অপচয়ের পরিমাণও কম নয়। তবুও যেন অধিকাংশেরই সেদিকে কোনো দৃষ্টিপাত নেই, তারা যে যার মতো পানি দূষণ ও অপচয় করেই যাচ্ছে। ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবেলায় আমাদের সকলকেই সচেতন হতে হবে, পানি দূষণ ও অপচয় যথাসম্ভব রোধ করতে হবে। নিজে সচেতন হতে হবে, অন্যকেও সচেতন করে তুলতে হবে।
তথ্যসূত্রঃ-
১/ ScienceDirect: Multi-Stage Flash Distillation
২/ How Stuff Workds: Desalination
৩/ What Is Desalination?
Leave a Reply