বেরিবেরি রোগের কথা প্রথম পড়েছিলাম মাস্টার্সের এক কোর্সে। ইদানীংকালে এই রোগে আক্রান্তের খবর বাংলাদেশে খুব একটা পাওয়া না গেলেও , আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দরিদ্র দেশে এখনো বেরিবেরি রোগের প্রাদুর্ভাব চোখে পড়ার মতন। বেরিবেরিতে আক্রান্ত মানুষের প্রথম লক্ষনগুলো একই রকম – যেমন শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করা, পা ভারী হয়ে যাওয়া ,হাত পা অবশ আর ঝিনঝিন বোধ করা। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে দুই ধরনের লক্ষন দেখা দিতে পারে। এক – আর্দ্র বেরিবেরি, যেটাতে আক্রান্ত হওয়া মানুষগুলোর শ্বাস নিতে কষ্ট হয়, বুক ধড়ফড় করে, পায়ে পানি জমে যায় আর হাত পা বেশ ফুলে যায়। দুই – শুষ্ক বেরিবেরি ,যাতে আক্রান্ত মানুষগুলোর পায়ের মাংশপেশী শুকিয়ে জীর্ন হয়ে যায়, শ্বাসকষ্ট হয়, মুখ আর নাকের পাশের অংশ নীল হয়ে যায় এবং অবশেষে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে একসময় মারা যায়।
ঘটনাটা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ন্যাদারল্যান্ডের (ডাচ) ডাক্তার ক্রিশ্চিয়ান আইকম্যান তখন জার্মানীর বার্লিনে এক বিখ্যাত ল্যাবে বেরিবেরি রোগ নিয়েই গবেষণা করছিলেন। তখনকার ডাচ শাসিত ইন্দোনেশিয়াই বেরিবেরি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে ,ডাচ রাজতন্ত্র আইকম্যানকে ১৮৮৮ সালে ইন্দোনেশিয়া পাঠাই বেরিবেরি রোগ নিয়ে গবেষণা করতে এবং মানুষগুলোকে বেরিবেরি রোগ থেকে বাঁচানোর কোন একটা রাস্তা বের করতে। সেই উদ্দেশ্যেই ইন্দোনেশিয়ায় মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিয়ে বেরিবেরি রোগের কারন খুঁজতে থাকেন আইকম্যান। প্রথম দিকে বিজ্ঞানী আইকম্যানের ধারনা ছিল বেরিবেরি রোগ হয়তো কোন এক অদৃশ্য জীবাণুর আক্রমনে হয়। কারন ততদিনে লুই পাস্তুরের প্রচারকৃত জীবাণুতত্ত্ব সবার মাঝেই বেশ গ্রহনযোগ্যতা পেয়ে গেছে এবং সবারই তখন ধারনা ছিল সব ধরনের রোগের কারনই হল কোন না কোন জীবাণু। এই ধারনাকে মাথায় রেখেই উনি উনার গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৮৯০ সালে তাঁর গবেষণাগারের মুরগীগুলোর মধ্যে হঠাৎ বেরিবেরি রোগের লক্ষন দেখা দিলে বিজ্ঞানী আইকম্যানের ভাবনায় নতুন মোড় নেয়। উনি বেরিবেরি রোগের জীবাণু খোঁজার জন্য রুগ্ন মুরগী থেকে সুস্থ মুরগীর শরীরে রোগ ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হলনা। বরং কিছুদিন পর আইকম্যানকে অবাক করে দিয়ে অসুস্থ মুরগীগুলোই আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে যায়। এর কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে উনি দেখলেন খাদ্যাভাসের পরিবর্তন। গবেষণাগারের মুরগীগুলোকে এতদিন ধরে দেওয়া হত সেনাবাহিনীর রেশন থেকে পাওয়া বেশি দামী সাদা চাউলের ভাত, কিন্তু বাজেট ঘাটতির জন্য কমদামী লাল চাউলের ভাত ঐ মুরগী গুলোকে খেতে দেওয়ার পর থেকেই মুরগীগুলো আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠে। এই প্রথম আইকম্যান বুঝতে পারলেন রোগ শুধুমাত্র জীবাণুর মাধ্যমেই হয়না , খাবারে কোন একটা উপাদান না থাকলে ও রোগ হতে পারে।
কিন্তু এই উপাদানটা কি করে এল কোথা থেকেই বা এল সেটা বের করার আগেই আইকম্যান অসুস্থ হয়ে পরেন এবং নিজ দেশ নেদারল্যান্ডে ফেরত যান। কিন্তু যাওয়ার আগে একই ইন্সটিটিউট এর চীপ মেডিকাল অফিসার ও বন্ধু এডল্ফ গিয়ম ভডারম্যান( Adolphe Guillaume Vorderman) কে অনুরোধ করে যান গবেষনাটা চালিয়ে যেতে এবং সাদা চাল , বাদামী চাল আর বেরিবেরি রোগের মধ্যে থাকা যোগসূত্রটা বের করতে। সেই উদ্দেশ্যেই ১৮৯৭ সালের মধ্যে এডল্ফ ইন্দোনেশিয়ার ১০০ টা জেল এ কোন ধরনের চাউলের ভাত দেওয়া হয় এবং কোন জেল এ কত বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত মানুষ আছে তার তথ্য সংগ্রহ করেন । লক্ষ্য করে দেখেন, যে সকল জেল এ কয়েদিদেরকে কমদামী লাল চাউল দেওয়া হয় সেসব জেলে বেরিবেরিতে আক্রান্তের পরিমান দশ হাজারে একজন আর যে সকল জেল এ সাদা চাউলের ভাত দেওয়া হত নিয়মিত সেখানে বেরিবেরিতে আক্রান্তের হার ৩৯ জনে ১ জন ! বিজ্ঞানী এডল্ফের এই গবেষণা আইকম্যানের ধারনাকে সত্যি প্রমান করে। যার ফলে লাল চালের ভাতের ব্যবহারকে সম্প্রসারণ করেই তখন লাখো লাখো মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিলেন এই দুই বন্ধু । যার জন্য বিজ্ঞানী আইকম্যান ১৯২৯ সালে আরেক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক হপকিন্স (Sir Frederick Gowland Hopkins ) এর সাথে মেডিসিনের নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন।( যদিও বিজ্ঞানী এডল্ফকে কেন সেই নোবেল পুরষ্কারের অংশীদার করা হয়নি সেটা এখনো রহস্যই থেকে গেছে ) কারন বিজ্ঞানী হপকিন্স তাঁর গবেষণাগারের ইঁদুরের উপর গবেষণা করে দেখেছিলেন, ইঁদুরকে পেট ভরে খেতে দেওয়ার পর ও তাদের শরীর জীর্ণ শীর্ণই থেকে যায়, সেই একই ইঁদুরের খাদ্যে সামান্য একটু গরুর দুধ যোগ করে দিলেই ইঁদুরগুলোর শারীরিক বৃদ্ধি বহুগুণ বেড়ে যায়। এই গবেষনা থেকেই হপকিন্স বুঝতে পারেন গরুর দুধে এমন একটা উপাদান আছে যা অন্য সকল খাবারগুলোতে নেই এবং ইঁদুরের শরীরেও নিজে নিজে তৈরি হয়না বরং বাইরে থেকে খাদ্যের মাধ্যমে সরবরাহ করতে হয়। তাই গরুর দুধকে রাসায়নিক বিশ্লেষন শুরু করেন তিনি এবং কিছু অ্যামিনের (-NH2 ) অস্তিস্ব খুঁজে পান। যা শুধু ইঁদুরের জন্যই নই, এমনকি মানুষের দেহের বৃদ্ধির জন্যও খুবই প্রয়োজনীয় বা ভাইটাল ( Vital) এই সকল অ্যামিন। তাই তার নামকরন করা হয় ভাইটাল অ্যামিন, পরবর্তিতে যা সংক্ষেপে ভিটামিন নামেই পরিচিতি পায়।
কিন্তু এই সকল ভাইটাল অ্যামিন বিভিন্ন প্রাকৃতিক উৎসে খুব সামান্য পরিমানে খুঁজে পাওয়া গেলেও পরীক্ষাগারে বানানো তখনো অসম্ভবই ছিল। সেই অসাধ্যকেই সাধন করেন পাশের দেশ ভারতের মাদ্রাজে জন্ম নেওয়া পাদ্রী বাবার সন্তান রবার্ট উইলিয়ামস । ছোটবেলা থেকেই যার স্বপ্ন ছিল রসায়নবিদ হওয়ার। সেই উদ্দেশ্যেই আমেরিকার ইউনিভারসিটি অফ শিকাগো থেকে রসায়নের মাস্টার্স শেষ করে ফিলিপাইনের এক গবেষনাগারে যোগ দেন গবেষক হিসেবে। দুই বন্ধু আইকম্যান এবং এডল্ফ’র লাল চাউল খাইয়ে বেরিবেরি রোগ নিরাময়ের কথা তখনো মানুষের মুখে মুখে। তাই সেই লাল চাল নিয়েই গবেষণা শুরু করলেন বিজ্ঞানী উইলিয়ামস।
উইলিয়ামসের ধারনা ছিল লাল চালের ঐ লাল আবরণেই এমন কিছু লুকিয়ে আছে যা বেরিবেরি রোগ সারতে পারে। সেটা পরীক্ষা করবার জন্য তিনি আরো কয়েকজন বন্ধুর সহযোগীতায় সেই লাল চালের আবরণটা আলাদা করে নির্যাস বানিয়ে সেটা ব্যবহার করা শুরু করলেন বেরিবেরি আক্রান্ত কুকুরের উপর, ভাল ফল পাওয়ার পর ব্যবহার করলেন মানুষের উপর। দেখলেন লাল চাউলের ভাত না খাইয়ে শুধুমাত্র এই নির্যাস বা ঔষধ ব্যবহার করেই কয়েকদিনের মধ্যেই বেরিবেরি আক্রান্ত মানুষ সম্পূর্ন সুস্থ হয়ে যায়।
কিন্তু মাত্র ৯ গ্রাম লাল আবরন সংগ্রহ করতেই বিজ্ঞানী উইলিয়ামস আর তাঁর বন্ধুদেরকে বাছায় করতে হয়েছিল একটন লাল চাল! আর ঐ ৯ গ্রাম লাল খোসা থেকে তিনি নির্যাস পান মাত্র কয়েকমিলিগ্রাম। এক টন লাল চাউল থেকে এত খাটা খাটনির পর মাত্র কয়েক মিলিগ্রামের নির্যাস সংগ্রহ বিজ্ঞানী উইলিয়ামসকে ভাবনায় ফেলে দেয়। তাই তিনি সহ সকল বিজ্ঞানী এই নির্যাসের মধ্যে থাকা অ্যামিনের রাসায়নিক গঠন জানার জন্য উঠে পরে লাগলেন। সেই উদ্দেশ্যেই অনেক পরিশ্রম করে সেই অণুকে ভেংগে তার মধ্যে থাকা কার্বন, হাইড্রোজেন , নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন পরমাণুর সংখ্যা এবং অনুপাত বের করলেন নিঁখুতভাবে। আর তার রাসায়নিক নাম দিলেন থায়ামিন। এই সেই থায়ামিন যা পরীক্ষাগারে বানানো গেলে মানুষের শরীর স্বাস্থ্য আর সাদা চাউল লাল চাউলের উপর নির্ভর করবে না। একটা প্রাণ ও ঝরে যাবেনা বেরিবেরি রোগে। অনেক চেষ্টার পর ১৯৩৬ সালে সেই অসম্ভব কাজটাই করে ফেললেন বিজ্ঞানী উইলিমস। পরীক্ষাগারে এক ফোঁটা বিশুদ্ধ থায়ামিন বানাতে সক্ষম হলেন এই কালজয়ী বিজ্ঞানী। যা এক টন লাল চাউলের খোসার নির্যাস থেকে পাওয়া থায়ামিনের পরিমান থেকেও বেশি। আর এই থায়ামিনের পরবর্তি নাম দেওয়া হয় ভিটামিন বি ১ ।
Leave a Reply