বই: সায়েন্সভেঞ্চার: ৪৬০ কোটি বছরের ইতিহাস
লেখক: নাঈম হোসেন ফারুকী
প্রকাশনা: প্রান্ত প্রকাশন
পৃষ্ঠা সংখ্যা: ৩০৪
মুদ্রিত মূল্য: ৪৫০ টাকা
গুডরিডস রেটিং: ৪.৬৭/৫
ক্যাটাগরি: জীববিজ্ঞান, বিবর্তন
প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা, ২০২১
“If a butterfly flaps its wings at just the right time in just the right place. It can cause a hurricane thousands of miles away.”
৪৬০ কোটি বছর আগে সেই হেডিয়ান মহাযুগে থিয়া গ্রহটার পৃথিবীর সাথে সংঘর্ষ, অগুনতি ধুমকেতুর বুকে করে পানির ক্রিস্টাল নিয়ে আসা কিংবা বার বার কোটি বছর ব্যবধানে মহাদূর্যোগে পৃথিবীর নরকে পরিণত হওয়া—প্রতিটা ঘটনাই দায়ি আজকে আমার এই বুক রিভিউটা লেখার পেছনে। প্রতিটা ঘটনাই সমান ভাবে দায়ী হোমো স্যাপিয়েন্স নামের এক বুদ্ধিমান প্রজতির পৃথিবীর রাজত্বের পেছনে—”That’s how the butterfly effect is… A flap in a perfect time!”
কোথা থেকে আসলাম আমরা?
কেনই বা আজকের পৃথিবীতে এতো প্রাণীবৈচিত্র্য?
কিভাবেই বা সরল প্রোটোসেল থেকে এক কোষী প্রাণী আর তার থেকে পৃথিবীজুড়ে এই বিচিত্র প্রাণের বন্যা?
এই প্রশ্নগুলির সাবলীল উত্তর আলোচ্য বইটিতে।
এই বইটা একটা বিশাল বড় ভ্রমণের মতো। লেখক আপনাকে বইজুড়েই ডুবিয়ে রাখবেন প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর বিভিন্ন যুগে যুগে।
আপনার এ ভ্রমণের শুরু হবে একটু ভিন্নভাবে। শুরুতেই প্রাগৈতিহাসিক দুনিয়ায় যাচ্ছেন না।
কেমন হয় যদি আপনাকে ০.১ মিলিমিটার সাইজের করে ফেলে দেয়া হয় একটা মজা পুকুরে?
কতোটা ভয়াবহ আর নারকীয় হতে পারে এই পুকুর ০.১ মিলিমিটারের আপনার জন্য?
সেই পুকুরে আপনার মর্মান্তিক মৃত্যুর পর লেখক আপনাকে জীবিত করে পাঠাবেন আরেক অভিযানে। অসীম শক্তিশালী একটা ড্রীল মেশিন, যেটা আপনাকে নিয়ে যাবে মাটির হাজার হাজার কিলোমিটার গভীরে। ক্রাস্ট, মেহোরিভিক ডিসকন্টিনিউটি, নরক ম্যান্টল পেরিয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে। যেখানে সূর্যপৃষ্ঠের সমান তাপমাত্রা। চাপ ৪৮ হাজার হাতির ওজনের সমান। এই দুঃসাহসিক ভ্রমণে আপনার দেখা হবে নরকের ব্যাক্টেরিয়া থেকে শুরু করে দৈত্যাকার মহাসাগরীয় পানির আধারের সাথে। সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, এই দুঃসাহসিক এডভেঞ্চারের পাশাপাশি আপনার জানা হয়ে যাবে টেকটোনিক প্লেটের কাজ কি, কেন মহাদেশগুলির বিভাজন ঘটে। জানা হয়ে যাবে পৃথিবীর চুম্বকত্বের কারণ। জানা যাবে পৃথিবীর উত্তর মেরুতে রাতের বিশাল আকাশজুড়ে অরোরার উদয়ের কারণ।
বিবর্তন অবলোকনে যাত্রা
এ ভ্রমণের তৃতীয় যাত্রায় এবার লেখক আপনাকে পাঠাবেন শত শত কোটি বছর পূর্বে।
কতো পূর্বে?
কতো পূর্বে গেলে পৃথিবীর এই জীবন নাট্যের সূচনার স্বাক্ষী হওয়া যাবে?
—৪৬০ কোটি বছর!
আপনার ভ্রমণেই আপনি স্বাক্ষী হবেন থিয়ার সংঘর্ষে জ্বলন্ত নরক হয়ে যাওয়া পৃথিবীর। আপনার সামনেই পানির ক্রিস্টাল বুকে নিয়ে পৃথিবীতে আঁচড়ে পড়বে শত-হাজার ধুমকেতু। সময় যাবে, এগুতে থাকবে আপনার এই দুঃসাহসিক যাত্রা।
পৃথিবীকে আজকে অবধি আসতে চারটা মহাযুগ(eon) পাড়ি দিতে হয়েছে।
হেডিয়ান, আর্কিয়ান, প্রোটারোজয়িক আর ফ্যানারোজয়িক। লেখক চেষ্টা করেছেন এই চারটা মহাযুগের ইতিহাসকেই গ্রন্থবদ্ধ করতে। কাজটা বেশ কষ্টসাধ্য হলেও সেক্ষেত্রে তিনি চমৎকার লেখনী দক্ষতা দেখিয়েছেন।
বইয়ের “প্রাচীন পৃথিবী” অংশের ২৬ টা অধ্যায়ে তুলে ধরেছেন পৃথিবীর প্রাণের ইতিহাস। বিবর্তনের ইতিহাস।
শুরুতেই সাবলীল উপস্থাপনায় “বিবর্তন”, ” রেন্ডম মিউটেশন”, “ফসিল” সংক্রান্ত ব্যাপারগুলির ভিত্তিমূল থেকে ধারণা দেয়া হয়েছে।
তার পরপরই এ বিশাল যাত্রায় আপনাকে হেডিয়ানের নারকীয় পৃথিবী থেকে নিয়ে যাওয়া হবে আর্কিয়ানের প্রথম প্রাণের উৎপত্তির দিনগুলিতে।
আর্কিয়ান মহাযুগে RNA World Hypothesis, ব্যাক্টেরিয়াদের “সায়ানোব্যাক্টেরিয়ায়” রূপান্তর, অক্সিজেন উৎপাদন—এসব হাই থটের কাটখোট্টা ব্যাপারগুলি চমৎকার উপস্থাপন করেছেন লেখক।
আর্কিয়ানে উদ্ভব হওয়া এককোষীরা কিভাবে প্রোটারোজয়িক মহাযুগে বহুকোষী স্পঞ্জে রূপান্তরিত হলো কোটি কোটি বছরে?
কিভাবে সরল আদি কোষ বিবর্তিত হয়ে উন্নত বৈশিষ্ট্যের ইউক্যারিওটিক কোষে পরিণত হলো?
কিংবা বর্তমান জীবিত সব ইউক্যারিওটদের শেষ পূর্বপুরুষ, LECA-ই বা কিভাবে আসলো?
এ প্রশ্নগুলির সহজ ব্যখ্যা প্রোটারোজয়িক মহাযুগ ভ্রমণের সময়ই পেয়ে যাবেন।
বইয়ের যে কয়টা ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট, তার একটা হচ্ছে যেখানেই শ্রেণিবিন্যাস জানার প্রয়োজনবোধ করেছি, সেখানেই লেখক সেই আলোচ্য পর্বের প্রাণির শ্রেণিবিন্যাস নিয়ে হাজির হয়েছেন।
পাঠ্যবইয়ের কাঠখোট্টা উপস্থাপনায় যে ব্যাপারগুলিতে আমার এক প্রকার ভীতি জন্মে গিয়েছিলো, সেই ব্যাপারগুলিই খুব বেসিক একদম গোড়া থেকে বুঝিয়ে আনা হয়েছে বইয়ে।
আপনার ভ্রমণ রোমাঞ্চকর হওয়া শুরু করবে যখন ক্রায়োজেনিয়ানের হিমশীতল বরফ যুগ পেরিয়ে এডিয়াকারান যুগে আসবেন। প্রাগৈতিহাসিক পৃথিবীর এই যুগে পৃথিবীতে উদ্ভব হতে থাকে উদ্ভট, এলিয়েনের মতো আজব প্রাণিদের। এর যুগ-যুগান্ত পর আপনাকে নিয়ে লেখক ডুব দিবেন ক্যাম্ব্রিয়ানের প্রাণভর্তি মহাসাগরে। আপনাকে দেখানো হবে, কেন–কিভাবে সেই যুগে পৃথিবীতে প্রাণের বন্যা এসেছিলো।
কোটি কোটি বছর পর যখন আপনি ডাঙায় পা ফেলবেন, সেখানে মরতে বসবেন সাইলুরিয়ান যুগের অজানা, ভয়ানক প্রাগৈতিহাসিক খুনীদের কাছে।
তারপর ডেভোনিয়ান যুগ পেরিয়ে আপনার এডভেঞ্চার চলবে প্রাচীন পৃথিবীর সেই কার্বোনিফেরাস যুগে। যখন এই পৃথিবীতে রাজত্ব করতো ভয়ংকর, দৈত্যাকার আর রাক্ষুসে সব পোকামাকড়েরা। পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে ছিলো বিশালাকার ফার্ন। আকাশে উড়ে বেরাতো রূপকথার দানো দের মতো ভয়াবহ ও বড় আকারের কীটপতঙ্গ।
আসবে জীব বৈচিত্রের যুগ পার্মিয়ন। সময়ের কাঁটা এগুবার সাথে সাথে স্বাক্ষী হবেন ‘পার্মিয়ান মাস এক্সটিংকশানের’ মতো নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের। স্বাক্ষী হবেন মহাকালের সবচেয়ে বড় গণহত্যার।
গল্পের আদলে বইয়ের কথক আপনাকে শিখিয়ে যাবে প্রাগৈতিহাসিক সেই যুগ-যুগান্তের প্রাণের বিবর্তনের ইতিহাস। সময় যাবে, আর আপনার এই অভিযান ভয়াবহ হতে থাকবে। পরিচিত হবে প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপ, আমাদের পূর্বপুরুষদের একেক যুগে বিবর্তিত একেক প্রজাতির সাথে। জুরাসিক যুগের অভিযানে দানবীয় সব প্রাণিদের দুনিয়ায় আপনার বাঁচাটাই মুশকিল হয়ে যাবে। বই না পড়লে সে যুগটা আঁচ করতে পারবেন না কেবল রিভিউ পড়েই।
তারপর একদিন, বহুকোটি বছরের বিবর্তনে পৃথিবীতে আবির্ভাব হবে মানুষ নামের এক প্রজাতির। তখন আপনি ধীর পায়ে ঢুকে পড়বেন আদিম গুহামানবদের ডেরায়, রাতের নক্ষত্রভর্তি আকাশের নীচে তাদের সাথে গলা মিলিয়ে গাইবেন চারশো ষাট কোটি বছরের বিবর্তনের গান।
মানব বিবর্তন অবধি এসে শেষ হবে এ বিশাল যাত্রা। মাইটোকন্ড্রিয়াল ইভ, Y ক্রমোজোমাল এডাম এর মতো ব্যাপারগুলির উপস্থাপন অনেক সন্তোষজনক ছিলো। বিবর্তন শেখার জন্য আপনার বোধগম্যতা নিয়ে কোনো জটিলতা থাকুক, এমনটা না রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টার প্রতিফলন দেখলাম বইয়ে।
মানব বিবর্তনের প্রায় প্রতিটারই ফসিলের ছবি দেয়া হয়েছে বইয়ের শেষদিকে। সংযোজিত আছে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও নির্ভযোগ্য বিজ্ঞান জার্নালের সূত্র।
তৃপ্তিভরা একটা নিঃশ্বাসে শেষ হবে আপনার কোটি কোটি বছরের এই ভ্রমণ।
ব্যক্তিগত প্রাপ্তিস্বীকার:
এ বই নিয়ে আমার একান্ত কিছু প্রাপ্তিস্বীকার উল্লেখ করার ইচ্ছা পোষণ করছি। এগুলি হতে পারে আপনারও মাথায় ঘুরতে থাকা প্রশ্ন:
১. প্রোটিন, ডিএনএ এসবের উৎপত্তি নিয়ে পড়লেও আমার জানা ছিলো না জীবকোষের মতো একটা জটিল যন্ত্রে কোষীয় অঙ্গাণুগুলি কিভাবে আসলো। কিভাবেই বা আসলো পাওয়ারহাউজ খ্যাত মাইটোকন্ড্রিয়া কিংবা প্লাস্টিডের মতো অঙ্গাণুগুলি। লেখকের চমৎকার উপস্থাপন ব্যাপারটা পরিষ্কার করে দিয়েছে। একদম আণবিক পর্যায় থেকে আলোচনা করেছেন।
২. ব্যক্তিগত ভাবে আমি জীববিজ্ঞানে দূর্বল বিধায় জাইগোটে ব্লাস্টুলা- গ্যাস্ট্রুলা এগুলির উৎপত্তি, সংজ্ঞা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। আমি নিশ্চিত, আপনাদের অধিকাংশই আমার দলের। বইতে সুন্দর করে জীববির্তনের বিভিন্ন ধাপে একেকটা অংশের প্রয়োজনীয়তা দেখানো হয়েছে এদের। একই সাথে দেখানো হয়েছে কেন এদের উৎপত্তির দরকার ছিল। দেখানো হয়েছে, কিভাবে জাইগোটে মেসোডার্ম জরুরি ছিলো। কিভাবে কোষ মাত্রার প্রাণিরা কোষ টিস্যু মাত্রার প্রাণিতে বিবর্তিত হয়েছে। দেখানো হয়েছে, কেবল কোন পরিবর্তনটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিহীন স্পঞ্জ থেকে হাত পা ওয়ালা জটিল জটিল সব প্রাণিদের উদ্ভব ঘটিয়েছে।
সত্যি বলতে, এ বইতে আলোচনার এই অংশটা আপনার অ্যাকাডেমিক হোক কিংবা কৌতূহল মেটানোর জন্য হোক— যেকোনো পরিপ্রেক্ষিতেই খুব চমকপ্রদ লাগবে।
লেখকের কাছে আমার অনুরোধ থাকবে, পরবর্তী এডিশনে প্রাগৈতিহাসিক সব প্রাণির নামের ইংরেজি বানান যেন বন্ধনীর ভেতর লিখে দেন। বই নিয়ে আমার আপত্তির জায়গা এটুকুই।
পাঠকের উদ্দেশ্যে:
এবার, কথা হচ্ছে, ধরুন আপনি সারাদিন “গণিত-পদার্থবিজ্ঞান” জপ করা মানুষ। তাও আপনি এই বই পড়বেন কিনা? পড়ে বুঝবেন কিনা?
জ্বী, আপনি ন্যূনতম জানাশোনা নিয়েই এ বই পড়া ধরতে পারেন।
আগেই বললাম, বেসিক যেসব ব্যাপারে পাঠ্যবই পড়ে (কিছু না বুঝায়) ভীতি জন্মে গিয়েছিলো, সেগুলি এ বইয়ে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি আমার। অসুবিধা হবে না আপনারও।
এ বইটা একটুখানি গল্পের। তারচেয়েও বেশি বিজ্ঞানের।
সাথে অনেক খানি এডভেঞ্চারের।
“সায়েন্সভেঞ্চার “
নামের স্বার্থকতা এখানেই।
শুভ হোক আপনার এ বিজ্ঞান ভ্রমণ।
Leave a Reply