বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন চেষ্টা করেছেন সৃজনশীল মস্তিষ্কের ভিতরে উঁকি দিতে। জানার চেষ্টা করেছেন মস্তিষ্কের কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য তারা অন্যদের থেকে কাজে – সাফল্যে তফাত বজায় রেখেছেন। সাম্প্রতিক বেশ কিছু গবেষণায় তাদের প্রাপ্তি আলফা তরঙ্গ। তাহলে চলুন একটু ঢু মেরে দেখে আসি আলফা তরঙ্গের গতি-প্রকৃতি।
ব্রেইন ওয়েভ কি? কিভাবেই বা জন্ম এই ওয়েভের?
ব্রেইন ওয়েভ গুলো আর কিছুই নয় মস্তিষ্কের ভিতর ইলেকট্রিকাল তরঙ্গ। আমাদের মস্তিষ্কে নিউরনগুলো দলা পাকিয়ে কিছু গুচ্ছ বা center তৈরি করে থাকে। তারা তাদের প্রতিবেশী গুচ্ছ বা center এর সাথে যোগাযোগ করার জন্য যেই সিগনাল তৈরি করে পাঠায় তাকেই আমরা বলি ব্রেইন ওয়েভ। ধারণা করা হয় বেশ কিছু ভিন্ন ভিন্ন ক্রিয়াকলাপ এই তরঙ্গ উদ্ভব হওয়ার সাথে জড়িত। এর মধ্যে নিউরন কোষের ঝিল্লির উদ্দীপনার পরিবর্তন (Changes in the membrane permeability) থেকে শুরু করে কোষের বাইরে আয়ন এবং নিউরোট্রান্সমিটারের পরিবর্তন (Changes in Ion and neurotransmitter) জড়িত। ব্রেইনের মধ্যে একটা নিউরন আরেকটি নিউরনের মধ্যে আয়ন বিনিময়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। যাকে আমরা ইলেকট্রিকাল সিগনাল বলি। অনেকগুলো নিউরন যখন একসাথে উদ্দীপ্ত হয়ে ছন্দ তৈরি করে তখন এই ব্রেইন ওয়েভগুলোর জন্ম। তাই ব্রেইনকে একটা তড়িৎ রাসায়নিক যন্ত্র বললেও খারাপ হয় না। আমরা গরু বা ছাগলের মগজ এ দেখেছি, এর মধ্যে অনেক সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম তার আছে। যাকে খুব সাধারণভাবে নার্ভ ফাইবার (nerve fiber) বা নার্ভ ট্র্যাক্ট (nerve tract) বলে। ব্রেইনের কোষগুলো একটা অংশ অন্য অংশের সাথে এই ফাইবারের মধ্য দিয়ে তথ্য আদান প্রদানের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। একজন মানুষের আচার ব্যবহার, আবেগ সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয় এই ইলেকট্রিকাল তরঙ্গের মাধ্যমে।
ওয়েভ এর রকম-সকম:
আলফা নাম যেহেতু বলেই ফেলেছি, যেকোনো বিদগ্ধ পাঠক জানতে চাইবেন আর কি প্রকার আছে? আমাদের মস্তিষ্কের ভেতর এই তরঙ্গ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কম্পাংকে কাজ করে। এই তরঙ্গগুলোকে কিন্তু আমরা বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে ‘ধরতে’ পারি। এই যন্ত্রের নাম ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাম (EEG) । কম্পাংকের উপর ভিত্তি করে আমরা তরঙ্গকে পাঁচ ভাগে ভাগ করতে পারি। ডেল্টা, থিটা, আলফা, বিটা, গামা ওয়েভ। ব্রেইনের মস্তিষ্কের তরঙ্গের ফ্রিকোয়েন্সি হার্জ এককে পরিমাপ করা হয়। চলুন আমরা ব্রেইনের এসব তরঙ্গগুলোকে নিয়ে এবার কিছু তত্ত্ব-তালাশ করি।
ডেল্টা ওয়েভ: (1-3 Hz)
ব্রেইনের এই ধরণের তরঙ্গের কম্পাংক খুব কম। আমরা যখন গভীর ঘুমে থাকি তখন এই তরঙ্গ আমাদের ব্রেইনে আধিপত্য বিস্তার করে।
থিটা ওয়েভ: (4-7 Hz)
গভীর ঘুম থেকে আমরা আসতে আসতে ‘হাল্কা’ ঘুমের দিকে যেতে থাকি। তখন আমাদের ব্রেইন আস্তে আস্তে ডেল্টা থেকে থিটা তরঙ্গের দিকে যেতে থাকে। এই অবস্থায় ব্রেইন আধো ঘুম আধো জাগরণের এক গোধূলি লগ্নে অবস্থান করে। আমরা যাকে বলি দিবা স্বপ্ন (Daydream) তা এই থিটা তরঙ্গ অবস্থাতেই আমরা দেখি।
আলফা ওয়েভ: (8-12 Hz)
আমরা ঘুম থেকে ধীরে ধীরে জেগে উঠেছি। ব্রেইন আস্তে আস্তে থিটা থেকে আলফা ওয়েভের দিকে যেতে থাকে। আমাদের ব্রেইন তখন খুবই শান্ত (Relaxed) এবং পরিষ্কার (clear)। সারাটাদিন সুন্দর ভাবে অতিবাহিত করার জন্য তখন সুন্দর একটা প্লান আমরা সাজিয়ে নিতে পারি। আবার আমরা যখন কোন কাজ শেষ করি তখন একটা স্বস্তি অনুভব করি তখনও আলফা ওয়েভ কাজ করে।
বিটা ওয়েভ: (13-38 Hz)
এগুলো খুব ছোট ছোট দ্রুত গতির ওয়েভ। এখান থেকেই আমাদের ব্রেইনের এলার্ট স্টেট শুরু। ঘুম থেকে উঠে আমাদের অফিস আদালতের কাজ শুরু করি তখন বিটা ওয়েভ তৈরি হয়। আমরা যখন খুব উদ্বিগ্ন অস্থির থাকি তখনও এই ওয়েভ কাজ করে।
গামা ওয়েভ: (39-42 Hz)
এটি সবচেয়ে দ্রুত গতির। একাগ্রচিত্তে যখন কোন কাজ করি বা কোন বিপদে যখন আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকি তখন এই ওয়েভ কাজ করে।
ও ভালো কথা আমাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গ কিন্তু কখনও শূন্য হতে পারে না। আমাদের শয়ন, স্বপন, জাগরণ সকল অবস্থাতে মস্তিষ্কে সিগনাল আদান প্রদান হচ্ছে। কোন না কোন তরঙ্গ থাকবেই। শূন্য মানেই ব্রেইন ডেড। তাই সহজে বলা যায় যতক্ষণ জীবন ততক্ষণ ঢেউ।
সৃজনশীলতায় আলফা তরঙ্গঃ
২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে ব্রেইনে আলফা তরঙ্গ থাকলে সৃজন শীলতা ৭.৪% ‘বৃদ্ধি পায়। জনপ্রিয় লেখক জেমস হারড তার বই The Art of Smart Thinking তে লিখেছেন
আলফা ওয়েভ শুধুমাত্র আমাদের উদ্বিগ্নতা, দুশ্চিন্তা হতাশায় কমায় না, আমাদের কোন কাজে আরও গভীর-নিবদ্ধ হতে সাহায্য করে।
এর মধ্যে টনি রবিন্স তো বলেই ফেললেন
আলফা তরঙ্গ এমন এক ধন্বন্তরি যার সাহায্যে সব সমস্যা সমাধান সম্ভব।
পুরনো কিছুকে ভিন্ন উপায়ে তৈরি করা অথবা পুরনো পথ কে বাদ দিয়ে নতুন পথের পানে চলা এই তো সৃজনশীলতা। আলফা তরঙ্গ ব্রেইনের কিছু জায়গা কে সাময়িক বন্ধ করে, যা আমরা প্রায়শই ব্যবহার করি। এবং এমন কিছু সংযোগ তৈরি করে যেটা আমরা খুব কম ব্যবহার করি। কম ব্যবহৃত এই অংশ থেকে যেই চিন্তা বা কাজ বের হয়ে আসে তা গতানুগতিক থেকে অনেক ভিন্নতর। সৃজনশীল ধারণার কাছে পৌঁছানোর জন্য আমাদের মস্তিষ্ককে সুস্পষ্ট ও প্রকট ধারণাগুলোকে পাশ কাটিয়ে অপ্রচলিত ধারণাকে সামনে আনতে হয়। গবেষণায় দেখা গেছে আমাদের ব্রেইনের ডান টেম্পোরাল এরিয়াতে (Right Temporal area) যখন আলফা তরঙ্গ বৃদ্ধি পায় অপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু সংযোগকে আলফা তরঙ্গ বন্ধ করে।
কিভাবে ভাসবেন আলফা তরঙ্গের ভেলায়?
আলফা তরঙ্গ সম্পর্কে অনেক কথায় তো হল। তো কিভাবে এই তরঙ্গ নিউরনের মধ্য দিয়ে পাঠানো যায় সেটাও তো জানা জরুরি। আমি কিছু গবেষণালব্ধ উপায় আপনাদের সামনে তুলে ধরব।
১। মেডিটেশন বা ধ্যান করাঃ
প্রাচীনকাল থেকেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার উপশম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে মেডিটেশন। এর বেশ কিছু স্বাস্থ্যসুবিধা আছে, পাশাপাশি মেডিটেশন ব্রেইনে আলফা ওয়েভ ও বাড়ায়।
২। গভীর, ঘন নিঃশ্বাস নেয়াঃ
কোন কাজ দীর্ঘ সময় ব্যাপী করছেন? হঠাত খুব অস্থির লাগছে? কোন নাতিশীতোষ্ণ জায়গায় বসে চোখ দুটো বন্ধ করে গভীর ঘন নিশ্বাস নিন। মস্তিষ্ক দিয়ে বরফ শীতল আলফা তরঙ্গ বয়ে যাবে।
৩। ক্যাফেইন পরিহার করাঃ
বেশ কঠিন। ক্যাফেইন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ড্রাগ। গবেষণায় প্রমাণিত ক্যাফেইন সাময়িক সময়ের জন্য হলেও আলফা তরঙ্গকে বিঘ্নিত করে।
৪। ব্রেইন ট্রেইনঃ
ব্রেইনকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ব্রেইনকে এমন ভাবে তৈয়ার করুন যেন কোন নির্দিষ্ট সময়ে উদ্দিষ্ট কাজের পর যেন ব্রেইন আলফা তরঙ্গে প্রবেশ করতে পারে। যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমরা পড়তে বসি।
৫। যোগ ব্যায়াম বা Yoga করাঃ
যোগ ব্যায়াম আমাদের মস্তিষ্কের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দূর করে একটা শান্ত- সৌম্য অবস্থায় নিয়ে আসে। এই অবস্থায় আলফা ওয়েভ তৈরি হয়।
৬। সুললিত কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত শোনাঃ
হৃদয়গ্রাহী কুরআন তিলাওয়াত শোনার সময় ব্রেইন একটা শান্ত সৌম্য অবস্থায় প্রবেশ করে যার পরিণতি বেশি বেশি আলফা তরঙ্গ।এছাড়া কিছু হরমোনকেও বাড়িয়ে দেয় যা হৃদয়-মনে আরাম দায়ক শিথিলতা দান করে।
কগনিটিভ সায়েন্স নিয়ে গবেষণার ফলে অনেক নতুন নতুন জিনিস আসছে আমাদের সামনে। আমরা সফল হতে চাই, সৃজনশীল হতে চাই। তাই সৃজনশীলতার কাঁচামাল মস্তিষ্কের সাথে আমরা যত ভালো ভাবে পরিচিত হব তত সহজ হবে আমাদের কাজ। সবাইকে শুভেচ্ছা।
Leave a Reply