মহাবিশ্বে এমন অনেক রহস্যঘেরা বস্তু আছে যা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না হলেও যার অস্তিত্ব প্রমাণে মানুষ করে যাচ্ছে নিরন্তর গবেষণা। এমনই একটি মহাজাগতিক বস্তু হল ডার্ক স্টার। ডার্ক স্টারের অন্তর্নিহিত গঠনে ডার্ক ম্যাটারের উপস্থিতি থাকার কারণে এর এমন নামকরণ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, মহাবিশ্বের একদম শুরুর দিকে গঠিত নক্ষত্রগুলোই ডার্ক স্টার। ডার্ক স্টার যে আসলেই ডার্ক, এমনটা কিন্তু নাও হতে পারে। এমনও হতে পারে যে ডার্ক স্টার আমাদের চেনা-পরিচিত তারাগুলোর চেয়েও উজ্জ্বল!
প্রায় ১৩ বিলিয়ন বছর আগে যখন মহাবিশ্বের রূপ আজকের মহাবিশ্বের থেকে অনেক ভিন্ন ছিল- যখন মহাবিশ্ব অত্যধিক ঘন ও উত্তপ্ত ছিল তখনই ডার্ক স্টার গঠিত হয়। বিগ ব্যাঙের পর মহাবিশ্বে শুধু হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম গ্যাস বিদ্যমান ছিল, সামান্য পরিমাণ লিথিয়াম ও বেরোলিয়ামও ছিল। মহাকর্ষীয় আকর্ষণের কারণে পদার্থ একত্রে পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তবে সর্বপ্রথম একত্রিত হতে থাকে ‘ডার্ক ম্যাটার’। ডার্ক ম্যাটার ও সাধারণ ম্যাটার একত্রে মিলে তৈরি করে ‘মিনিহ্যালো’, যার ভর সূর্যের ভরের কয়েক মিলিয়ন গুণ বেশি হতে পারে। এই মিনিহ্যালো থেকেই বিগ ব্যাঙের ২০০ মিলিয়ন বছর পর প্রথম নক্ষত্রসমূহের জন্ম হয়। মিনিহ্যালোর মধ্যকার ডার্ক ম্যাটারগুলো মহাবিশ্বের প্রথম নক্ষত্রসমূহের মধ্যে গভীরভাবে একীভূত হয়ে যায়- এগুলোকেই বলা হয় ডার্ক স্টার। ডার্ক স্টার আমাদের সূর্যের চেয়ে প্রায় কয়েক মিলিয়ন গুণ বড় হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে যে উজ্জ্বলতার দিক থেকে ডার্ক স্টার সূর্যের থেকেও কয়েক বিলিয়ন গুণ বেশি উজ্জ্বল।
এখন কথা হল এই ডার্ক স্টার গঠনের প্রধান রহস্যময় উপাদান ডার্ক ম্যাটার কি? সাধারণভাবে ডার্ক ম্যাটার এমন কণা দ্বারা গঠিত যারা আলো শোষণ করে না, প্রতিফলন করে না, নিঃসরণ করে না। ফলে তাদেরকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক বিকিরণ দ্বারা শনাক্ত করা যায় না। এটি সরাসরি দেখা সম্ভব নয়, তবে স্পষ্টতই এর অস্তিত্ব রয়েছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, ডার্ক ম্যাটার মূলত Weakly Interacting Massive Particle (WIMP) দ্বারা গঠিত। এগুলো এমন ধরণের কণা যারা নন-ব্যারিয়নিক, যাদের ভর প্রোটনের ভরের দশ থেকে একশ গুণ বেশি হতে পারে। ধারণা করা হয়, এই কণাগুলো নিজেরাই নিজেদের প্রতিকণা। এগুলো হয়ত প্রতিনিয়তই পৃথিবীতে আসছে এমনকি আমাদের দেহ ভেদ করে চলে যাচ্ছে, তবুও এখন পর্যন্ত এর কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। কারণ এরা সাধারণ পদার্থের কণাগুলোর সাথে বিক্রিয়া করে না। এই WIMP খোঁজার জন্য তোরজোড় চেষ্টা চলছে বিজ্ঞানী মহলে!
ডার্ক ম্যাটারকে পরোক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় এর গ্র্যাভিটেশনাল আচরণ দেখে অর্থাৎ দৈত্যাকার গ্যালাক্সিগুলোর পাশ দিয়ে আলো কীভাবে বেঁকে যায় তার ধরণ দেখে। এছাড়া গ্যালাক্সি ও ক্লাস্টারের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে অবগত হওয়া আবশ্যক। একটি গ্যালাক্সির ঘূর্ণন বজায় রাখার জন্য বিপুল পরিমাণ মহাকর্ষীয় বল প্রয়োজন যা ভিজিবল ম্যাটার থেকে আসা সম্ভব নয়। তাই বিজ্ঞানীরা এই অদৃশ্য ভরকেই ডার্ক ম্যাটার বলে আখ্যায়িত করেন। মহাবিশ্বের সমস্ত গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ ও অন্যান্য যা কিছু সাধারণ ভর দ্বারা গঠিত তা মহাবিশ্বের মোট ভরের মাত্র ৫%। মহাবিশ্বের ২৭ শতাংশই হল অজানা ভর বা ডার্ক ম্যাটার। অন্যদিকে মহাবিশ্বে ৬৯% নিয়ন্ত্রণ করছে ডার্ক এনার্জি যা সমগ্র মহাবিশ্বের প্রসারণ ঘটার জন্য দায়ী। অর্থাৎ ডার্ক এনার্জির প্রভাব মহাবিশ্বের শুধু নির্দিষ্ট কোনো অংশের ওপর নেই বরং পুরো মহাবিশ্বে এর প্রভাব রয়েছে কারণ এর পরিমাণ মহাবিশ্বের সর্বত্রই সমান।
ডার্ক ম্যাটারই ডার্ক স্টারগুলোকে অন্যান্য নক্ষত্রের থেকে অনন্য করে রেখেছে। যেমন ডার্ক স্টারগুলো কোনো প্রকার নিউক্লিয়ার ফিউশন (দুটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে ভারী নিউক্লিয়াসে পরিণত হওয়া যেমন- দুটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসে পরিণত হওয়া) প্রক্রিয়া ছাড়াই প্রসারিত হতে পারে এবং শক্তি বিকিরণ করতে পারে। অন্যান্য নক্ষত্র নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের জ্বালানি উৎপন্ন করতে সক্ষম। ডার্ক স্টার প্রায় পুরোটাই হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত। তবে এর এক হাজার ভাগের এক ভাগ হল ডার্ক ম্যাটার। এত ক্ষুদ্র পরিমান হলেও ডার্ক ম্যাটারই ডার্ক স্টারকে কয়েক বিলিয়ন বছর ধরে শক্তি দিতে সক্ষম। যেহেতু WIMPs নিজেরাই তাদের অ্যান্টি-পার্টিকেল, তাই তারা একে ওপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ও প্রচুর পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে। ডার্ক স্টারের ভেতর মহাশক্তিশালী এই কণাগুলোর সংঘর্ষ পর্যাপ্ত বহির্মুখী বল সৃষ্টি করে, যা মহাকর্ষের কারণে সৃষ্ট অন্তর্মুখী বলের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখে। তবে এক পর্যায়ে ডার্ক ম্যাটারের সমস্ত কণা যখন শেষ হয়ে যায়, তখন মহাকর্ষের কারণে ডার্ক স্টার আবার সংকুচিত হতে শুরু করে। আর যেগুলো ছোট আকারের ডার্ক স্টার (সূর্যের ভরের ১০০ গুণ), সেগুলোতে তখন নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং এগুলো জলন্ত নক্ষত্র আকারে আরও দীর্ঘ সময় টিকে থাকে।
এখন পর্যন্ত কোনো ডার্ক স্টারের সন্ধান বিজ্ঞানীরা খুঁজে পাননি তবে সম্প্রতি মহাকাশে পাঠানো নাসার ‘জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ’ ইনফ্রারেড রশ্মি ক্যাপচার করতে সক্ষম যা মহাবিশ্বের দূরতম বস্তু ও আদি মহাবিশ্বের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম হবে। এটি হয়ত মহাবিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো ও মানুষের অধরা মহাজাগতিক বস্তু ডার্ক স্টারের সন্ধান দিতে পারবে।
বিজ্ঞানীদের ধারণা অনুযায়ী, ডার্ক স্টারগুলো অন্যান্য নক্ষত্রের মতই ব্ল্যাকহোলের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। তবে একেকটি ডার্ক স্টার সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের উৎস, যা প্রত্যেক গ্যালাক্সির কেন্দ্রে বিরাজমান। মহাজগতের অন্যতম বিস্ময়কর সুপার-ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের উৎপত্তির কারণ হিসাবে ডার্ক স্টারকেই বিবেচনা করেন অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী। গবেষণায় দেখা যায়, আদি মহাবিশ্বে কিছু বৃহৎ ব্ল্যাকহোল বিদ্যমান ছিল, যেগুলোর ভর প্রায় সূর্যের ভরের চেয়ে মিলিয়ন-বিলিয়ন গুণ বেশি। কিন্তু গবেষকরা অনিশ্চিত যে কীভাবে এত ক্ষুদ্র সময়ে এমন দৈত্যাকার ব্ল্যাকহোল গঠিত হওয়া সম্ভব। মহাবিশ্ব সৃষ্টির প্রথম বিলিয়ন বছরেই একটি সুপার মাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠনের জন্য যে গতিতে ভর অর্জন করা প্রয়োজন, তা সাধারণ পদার্থ দ্বারা হওয়া সম্ভব নয়। তবে ডার্ক স্টার সাধারণ নক্ষত্রের চেয়ে আকারে বড় ও বৃহৎ ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি করতে পারে। তাই হতে পারে এই তারাগুলোই সুপার-ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল গঠনের একটি উৎস।
ডার্ক স্টার কী, কেন, কিভাবে গঠিত হয়েছে – তার সুস্পষ্ট থিওরি এখনও মানুষের হাতে নেই। ডার্ক স্টারের আবিষ্কার ডার্ক ম্যাটারকেও মানুষের ধরা ছোঁয়ার মধ্যে এনে দিতে পারে। অথবা ডার্ক ম্যাটারের আবিষ্কার হতে পারে ডার্ক স্টার খোঁজার তুরুপের তাস। নিরন্তর গবেষণার ফলে একদিন নিশ্চয়ই মানুষ ডার্ক স্টারের খোঁজ পাবে, আর তখন মহাবিশ্ব নিয়ে অনেক রহস্যই স্পষ্ট হয়ে উঠবে!
তথ্যসূত্র:
- Dark stars: The first stars in the universe – Space.com
- Dark stars come into the light – Astronomy.com
Leave a Reply