পানির ঘনত্ব ও চার ডিগ্রির ধাঁধা

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

১. দুটো থট এক্সপেরিমেন্ট।

বক্কর ভাইয়ের কাছে এক গ্লাস পানি আছে। বক্কর ভাই একটু বিজ্ঞানী-কিসিমের মানুষ। তার দেখতে ইচ্ছে হলো পানির তাপমাত্রা কতো। তিনি মেপে দেখলেন সাতাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মোটামুটি কক্ষ তাপমাত্রা। তার মনে হলো পানির এতো গরম থাকবার কোনো কারণ নেই। তিনি পানিটুকু ঠাণ্ডা করতে শুরু করলেন। কী ঘটবে এবার?

প্যারালাল ইউনিভার্সে তার অনুজ লক্কড় ভাই’ও খানিকটা বিজ্ঞানী-কিসিমের মানুষ। তার সামনে পানি নেই, আছে বরফ। বরফের আদর্শ তাপমাত্রা শূন্য ডিগ্রি,এ মোটামুটি সবারই জানা। তার ইচ্ছে হলো বরফটাকে একটু তাপ দেয়া যাক। ভাবুন, কী ঘটবে এবার?

২. মোটামুটি ক্লাস এইট-নাইনে পড়া একটা ছেলে বা মেয়ে জানে,কোনো পদার্থে তাপ দিলে তার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে, এবং সাথে সাথে তার আয়তনও বাড়ে। নাইনে উঠে সে জানতে পারে এই আয়তন বৃদ্ধি মাপার নানারকম সমীকরণ, তিন রকম ধ্রুবক(দৈর্ঘ্য,ক্ষেত্রফল ও আয়তন প্রসারণ গুণাঙ্ক)। তাকে সাথে নিয়ে যদি ওপরের পরীক্ষা দুটো করা হয়,তাহলে সে ভবিষ্যদ্বাণী করবে ১ম পরীক্ষায় পানির তাপমাত্রা কমার দরুন আয়তন কমতে কমতে পানি একসময় বরফ হয়ে যাবে, আর দ্বিতীয় পরীক্ষায় উল্টোভাবে, তাপমাত্রা বাড়তে বাড়তে বরফ একসময় পানি হয়ে যাবে। কিন্তু ওপরের পরীক্ষা দুটো করলে সে দেখবে তার ভবিষ্যদ্বাণী এক জায়গায় গিয়ে আর কাজ করছে না,কিংবা ঐ জায়গায় তার ভবিষ্যদ্বাণী উল্টো করে কাজ করছে। জায়গাটা হলো চার ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পানির তাপমাত্রা সাতাশ ডিগ্রি থেকে যখন কমতে শুরু করেছে মাত্র,তখন কোনো সমস্যা নেই। সাতাশ থেকে পঁচিশ….বিশ…পনেরো…পাঁচ এই পর্যন্ত ঐ সাধারণ নিয়মেই পানির আয়তন তাপমাত্রার সাথে সাথে কমতে থাকবে। চার ডিগ্রির পর দেখা যাবে তাপমাত্রা কমার সাথে সাথে পানির আয়তন কমছে না বরং বাড়ছে। এই বৃদ্ধি চলতে থাকবে বরফের স্ফটিক তৈরি হওয়া পর্যন্ত,অর্থাৎ শূন্য ডিগ্রি পর্যন্ত। আবার,শূন্য ডিগ্রির বরফকে যদি তাপ দেয়া হয়,দেখা যাবে তাপমাত্রা বাড়ছে বটে,কিন্তু আয়তন কমছে। ঠিক চার ডিগ্রি পর্যন্তই এভাবে চলতে থাকবে, তারপর আবার স্বাভাবিক,তাপমাত্রা বাড়ালে আয়তন বাড়বে। পানির জন্য চার ডিগ্রি যেন রীতিমতো ভুতুড়ে একটা বিন্দু! এর নিচে গেলেও আয়তন বাড়ে, ওপরে গেলেও আয়তন বাড়ে! আমরা একটু দেখতে চেষ্টা করি কেনো এই অদ্ভুত প্রসারণ….

বরফ পানিতে ভাসে

৩. রসায়নের প্রাথমিক জ্ঞানে আমরা মোটামুটি জানি, পানি হলো এইচ টু ও। সংকেত দিয়ে লিখলে H2O । পানির একটা অণুতে আছে দুটো হাইড্রোজেন পরমাণু, আর একটা অক্সিজেন পরমাণু। রাসায়নিক বন্ধন ব্যাপারটা আমাদের বলে,হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন ইলেকট্রন শেয়ার করে পানির অণু তৈরি করে,যাকে আমরা বলি সমযোজী বন্ধন। আবার পোলারিটির ধারণা থেকে আমরা জানি পানি অণুতে ডাইপোল তৈরি হয়—বেশি তড়িৎ-ঋণাত্মকতার কারণে অক্সিজেন হয় আংশিক ঋণাত্মক,আর হাইড্রোজেন হয় আংশিক ধনাত্মক। পানি অণুর আকৃতি ইংরেজি V এর মতো।

দেখা যায় অনেকগুলো পানির অণু যখন পাশাপাশি থাকে, তখন একটা অণুর ঋণাত্মক অক্সিজেন প্রান্ত আর পাশের অণুর ধনাত্মক হাইড্রোজেন প্রান্তের মধ্যে একরকম দুর্বল আকর্ষণ তৈরি হয়, যাকে বলে হাইড্রোজেন বন্ধন। হাইড্রোজেন বন্ধন অনেকগুলো অণুকে কাছাকাছি আনতে পারে,মোটামুটি একসাথে ধরে রাখতে পারে। এই হাইড্রোজেন বন্ধনের কারণেই পানি তরল, আর এই বন্ধন না থাকার কারণে পানির বন্ধুস্থানীয় অণু হাইড্রোজেন সালফাইড হয় গ্যাস।

আপনি যদি একফোঁটা পানির ভেতরের জগতটা দেখতে পেতেন,তাহলে অসংখ্য পানির অণুই দেখতেন,যারা কি না মোটামুটি গতিতে ইতস্তত ছোটাছুটি করছে,ঘুরছে,লাফালাফি করছে—তাদের মধ্যে অনবরত হাইড্রোজেন বন্ধন তৈরি হচ্ছে, আবার ভাঙছে। পানিকে,মানে এর অসংখ্য অণুকে, তাপ দিলে পানি যখন বাষ্প হয়, তখন আসলে এই হাইড্রোজেন বন্ধনগুলোই ভাঙা হয়, যাতে করে অণুগুলো সম্পূর্ণ বন্ধনমুক্ত হতে পারে। বরফের দিকে যদি তাকান তাহলে দেখবেন বরফের গঠন আরো মজার! আমরা সবাই জানি, বরফ হলো পানির কঠিন রূপভেদ। বরফে দেখা যায় অণুগুলো হাইড্রোজেন বন্ধনের মাধ্যমে মোটামুটি একটা রিং তৈরি ফেলেছে। একেকটা রিং-এ আছে ছয়টা করে অণু,প্রত্যেকটা অক্সিজেন পরমাণু দুটো হাইড্রোজেনের সাথে সমযোজী বন্ধন তৈরি করেছে, আর রিং-এ পাশের পানি অণুর হাইড্রোজেনের সাথে তৈরি করেছে হাইড্রোজেন বন্ধন। এখানেই শেষ নয়, এই চক্রগুলোও কাছাকাছি, পাশাপাশি আসে। তখন অক্সিজেন পরমাণু পাশের রিং এর একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর সাথে হাইড্রোজেন বন্ধন তৈরি করে, অর্থাৎ তখন একটা অক্সিজেন পরমাণুর বন্ধন থাকে মোট চারটে হাইড্রোজেনের সাথে(দুটো সমযোজী,দুটো হাইড্রোজেন বন্ধন)!

আসল মজা শুরু এইখানে,রিং যখন তৈরি করেছে,তখন রিং এর মাঝখানে নিশ্চয়ই একটা ফাঁকা জায়গা আছে! এই ফাঁকা জায়গাটাই যতো নষ্টের গোড়া। দেখা যায়,কিছু সংখ্যক অণু তরল অবস্থায় যতোটা জায়গা দখল করেছে—সমসংখ্যক অণুই কঠিন অবস্থায় দখল করেছে তারচে’ বেশি জায়গা,কারণ ঐ রিং-এর মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটা! বরফের বেলায় আয়তন মাপতে তো পুরোটুকুই নিতে হচ্ছে,তরলের বেলায় আবার সেটুকুই বাদ যাচ্ছে। তাহলে আমরা বলতে পারি, বরফের আয়তন পানির চেয়ে নিশ্চয়ই বেশি!

পানি ও বরফের আণবিক গঠন

পদার্থবিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে, আয়তন আর ঘনত্বের সম্পর্ক ব্যাস্তানুপাতিক—মানে আয়তন বাড়লে ঘনত্ব কমবে,ঘনত্ব বাড়লে আয়তন কমবে।পানিরচে’ বরফের আয়তন বেশি,তাহলে ঘনত্ব কার বেশি হবে? অবশ্যই পানির! ঘটেও তাই,আমরা দেখি পানির ঘনত্ব ১০০০ কেজি/ঘনমিটার,যেখানে বরফের ঘনত্ব ৯২০ কেজি/ঘনমিটার। বরফের ঘনত্ব যেহেতু কম, তাহলে বরফ তো পানিতে ভাসবেই!

৪. এবার আমরা আবার ফিরে আসি চার ডিগ্রিতে। বরফকে যখন তাপ দেওয়া হচ্ছে তখন সে ধীরে ধীরে পানিতে পরিণত হচ্ছে,তার হাইড্রোজেন বন্ধনগুলো দুর্বল হচ্ছে আস্তে আস্তে। তার রিং স্ট্রাকচার ভেঙে পড়ছে, অণুগুলো দূরে সরে যাচ্ছে। পানিতে পৌছুতে গেলে তাকে আয়তন কমাতেই হবে, সেটাই হচ্ছে এখন। চার ডিগ্রিতে এসে পানির হাইড্রোজেন বন্ধন সবচেয়ে দৃঢ়,সবচেয়ে সুগঠিত। এখান থেকে তাপমাত্রা বাড়ালে সেগুলো ভেঙে অণুগুলো আরো দূরে সরে যাবে,আয়তন বাড়বে,ঘনত্ব কমবে। আবার তাপমাত্রা কমালে অণুগুলো রিং এর মতো করে সজ্জিত হবে যাতে করে আয়তন বাড়ে। এই পরিবর্তনকে আমরা যদি আয়তন বনাম তাপমাত্রা গ্রাফে প্লট করি, দেখা যাবে আমরা মোটামুটি V এর মতো একটা গ্রাফ পাচ্ছি,যার নিম্নতম মোচড় বিন্দু(যে বিন্দুতে গ্রাফ তার দিক বদলাচ্ছে)র তাপমাত্রা চার ডিগ্রি! অর্থাৎ চার ডিগ্রিতে পানির আয়তন সর্বনিম্ন,উল্টো করে বললে চার ডিগ্রিতে পানির ঘনত্ব সর্বোচ্চ। পানির যে ঘনত্ব আমরা বলেছি,১০০০ কেজি/ঘনমিটার,সেটা চার ডিগ্রিতেই মাপা!

পানির আয়তন বনাম তাপমাত্রা লেখ

পানির এই অদ্ভূত প্রসারণ না হলে কি হতো, একটু ভাবা যাক। পৃথিবীর তিন চতুর্থাং‌শই সাগর।ঠাণ্ডার সময় উপরিতলের পানি জমে বরফ হয়ে যায়,কিন্তু বরফ যেহেতু পানির চেয়ে হালকা, তাই বরফ পানিতে ভাসে। বরফ যদি ডুবে যেতো, ‌তাহলে নিচের তরল পানি উপরে উঠে আসতো এবং একসময় পুরো সাগরের পানিই জমে বরফ হয়ে যেতো। তা হয় না, এবং হয় না বলেই শীতপ্রধান দেশে জলাশয়ে,বরফের নিচে প্রাণীরা বেঁচে থাকতে পারে। এবং হয় না বলেই জেমস ক্যামেরন সাহেব অস্কার পেয়েছিলেন,নয়তো টাইটানিক ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে যেতো!

৫. বক্কর ভাই আইসড্ টি খাচ্ছেন। তার মুখে স্মিত হাসি; চায়ের দিকে তাকিয়ে হাইড্রোজেন বন্ধনের প্রতি খানিকটা কৃতজ্ঞতাও বোধ করছেন তিনি! তাছাড়া চার ডিগ্রির ধাঁধাটা তিনি নিজে নিজে ভেবেই বের করেছেন। প্রকৃতি যে অপার রহস্য আমাদের সামনে সাজিয়ে রেখেছে, তার সবচেয়ে তুচ্ছটিও নিজে নিজে উদ্ঘাটন করতে পারার চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?

সাহায্যকারী সূত্র:

Anomalous Expansion of water

Why does ice float in water

লেখাটি 1,696-বার পড়া হয়েছে।


নিজের ওয়েবসাইট তৈরি করতে চান? হোস্টিং ও ডোমেইন কেনার জন্য Hostinger ব্যবহার করুন ৭৫% পর্যন্ত ছাড়ে।

আলোচনা

Leave a Reply

ই-মেইল নিউজলেটার

বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবর সম্পর্কে আপডেট পেতে চান?

আমরা প্রতি মাসে ইমেইল নিউজলেটার পাঠাবো। পাক্ষিক ভিত্তিতে পাঠানো এই নিউজলেটারে বিজ্ঞানের বিভিন্ন খবরাখবর থাকবে। এছাড়া বিজ্ঞান ব্লগে কি কি লেখা আসলো, কি কি কর্মযজ্ঞ চলছে, সেটার খবরও থাকবে।







Loading