aerial photography of rock formation

মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত ব্যর্থ কিছু মডেল

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

বিগ ব্যাং তত্ত্ব বা ইংরেজিতে বললে Big Bang theory নামটা হয়তো আমরা সবাই জানি। মহাবিশ্বের উৎপত্তি নিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত এবং গ্রহনযোগ্য তত্ত্ব। কিন্তু এটাই কি একমাত্র মডেল যা বিজ্ঞানীরা দিয়েছিলো মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখা করতে? আসলে তা কিন্তু নয় এর আগেও কিছু মডেল ছিলো যা দ্বারা মহাবিশ্বের উৎপত্তি ব্যাখা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া আরও কিছু মডেল দেয়া হয়েছিলো যা দিয়ে বিগব্যাং কে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কোনো মডেলই টেকেনি কারণ মহাবিশ্বে ঘটে চলা ঘটনা বিগব্যাং যেভাবে ব্যাখা দিতে পারে, অন্য মডেলগুলো তা পারেনি। আজ আমরা ব্যর্থ হয়ে যাওয়া কিছু মডেল নিয়ে জানবো।

বিগ ব্যাং তত্ত্বটি ১৯৩১ সালে প্রথম প্রস্তাব করেন জর্জ ল্যমেত্র (Georges Lemaître) নামক একজন পাদ্রি এবং সৃষ্টিতত্ত্ববিদ। এককথায় বিগ ব্যাং হলো আসলে একটি মহাবিস্ফোরন তত্ত্ব। মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে সকল কিছু একটি বিন্দুতে কেন্দ্রভূত ছিলো আর এই বিন্দুটির ঘনত্ব আর তাপমাত্রা ছিলো অপরিসীম। ১৩.৭ বিলিয়ন বছর আগে এই বিন্দুর বিস্ফোরনের মাধ্যমেই আজকের মহাবিশ্বের শুরু।

অনেক গুলো মডেলকে পাশ কাটিয়ে বিগ ব্যাং তত্ত্ব আজ এখানে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ

  •  শাশ্বত মহাবিশ্ব (Eternal universe)
  •  স্থির মহাবিশ্ব (Steady-state universe)
  • বৈদ্যুতিক মহাবিশ্ব (Electric universe)
  • চক্রাকার মহাবিশ্ব (Cyclic universe)

শাশ্বত মহাবিশ্ব (Eternal universe)

বিগ ব্যাং তত্ত্বের আগে বিজ্ঞানীদের বা যারা এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে ভাবতেন, তাদের ধারনা ছিল এই মহাবিশ্ব শ্বাশত বা অপরিবর্তনশীল। তাদের মতে এই মহাবিশ্ব এমনই ছিল,এই মহাবিশ্বের যা দেখা যাচ্ছে তা আগেও এমন ছিল আর ভবিষ্যতেও এমনই থাকবে। এই মডেল অনুযায়ী নতুন তারার জন্ম বা কোনো ধুমকেতুর আগমন এগুলো বিশাল মহাবিশ্বের সাপেক্ষে ছোট্ট ঘটনা। মূলত বিশাল মহাবিশ্বের কোনো পরিবর্তন হয় না।

এই মডেলে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে এডুইন হাবলের মহাবিশ্বের সম্প্রসারনশীলতা আবিষ্কারের মাধ্যমে। যেহেতু মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল তাই এটি অবশ্যই প্রথম দিকে এখনকার মতো ছিলো না এটি অবশ্যই প্রথম দিকে অন্যরকম ছিলো আর ভবিষ্যতেও অন্যরকম হবে। হাবলের আবিষ্কার শ্বাশত মহাবিশ্বের ধারনা বাতিল করে দেয়।

স্থির বা অবিচল মহাবিশ্ব (Steady-state universe)

হাবলের আবিষ্কার থেকে এটা জানা গেলো মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। কিন্তু তাও কিছু বিজ্ঞানী এটা কে ব্যাখা করা বিগ ব্যাং তত্ত্বকে মেনে নিতে পারছিলেন না কারণ তাদের মতে মহাবিশ্বে পরিবর্তন সম্ভব নয়। বিংশ শতকে বিগব্যাং তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগী ছিলো স্থির বা অবিচল মহাবিশ্ব মডেলটি। এটি প্রথম উপস্থাপন করেছিলেন জ্যোতির্বিদ ফ্রেড হোয়েল। এই মডেলের মতে, মহাবিশ্বে সর্বদা নতুন ভর তৈরী হচ্ছে যা মহাবিশ্বের সম্প্রসারনের কারনে যে ফাঁকা স্থান তৈরী হচ্ছে তার স্থান দখল করছে। এক কথায় বললে, এই মডেল মতে মহাবিশ্ব সম্প্রসারণ হচ্ছে সাথে সাথে তার সব স্থানে ভরও একই থাকছে। এটা অনেকটা শ্বাশত মহাবিশ্ব মডেলের মতোই। স্থির বা অবিচল মহাবিশ্ব মডেলে মহাবিশ্ব পরিবর্তনশীল ঠিকই কিন্তু বৃহৎ সময়ে এটি অপরিবর্তনীয়।

এই মডেলটি ব্যর্থ হয়ে যায় মূলত দুটি কারনে। একটি হল কোয়েজারের আবিষ্কার আর অন্যটি হলো মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণ বা Cosmic Microwave Background (CMB) Radiation এর আবিষ্কার। কোয়েজার হলো দূর মহাবিশ্ব থেকে আশা প্রচন্ড শক্তিশালী রেডিও তরঙ্গের উৎস আর CMB আমাদের চারিদিক ঘিরে আছে। এগুলোকে বিগ ব্যাং তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখা করা গেলেও স্থির বা অবিচল মহাবিশ্ব মডেল দিয়ে ব্যাখা করা যায় না। স্থির বা অবিচল মহাবিশ্ব মডেলের মতে, মহাবিশ্ব এখন যেমন আছে, পূর্বেও এমনই ছিল। কিন্তু কোয়েজার ও CMB রেডিয়েশন থেকে এটা স্পষ্ট যে মহাবিশ্ব পূর্বে এখনকার মতো ছিল না।

বিজ্ঞানী হোয়েলের একটা মজার ঘটনা আছে, তিনিই কিন্তু বিগ ব্যাং তত্ত্বটি নামকরণ করেছিলেন। তিনি BBC কে দেয়া এক বক্তৃতায় সমালোচনা করতে গিয়ে এটাকে “বিগ ব্যাং” বলে ব্যঙ্গ করেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো পরবর্তিতে এটাই জনপ্রিয় হয়ে যায়।

বৈদ্যুতিক মহাবিশ্ব (Electric universe)

বিগ ব্যাং তত্ত্বকে টেক্কা দিতে আরও একটি সৃষ্টি সংক্রান্ত মডেলের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো সেই সময় আর সেটা হলো বৈদ্যুতিক মহাবিশ্ব। এই মডেলের প্রস্তাব দেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ হানস আলফভেন (Hannes Alfvén)। আলফভেন চার্জিত গ্যাসের কণা বা প্লাজমা বিষয়ে বিশেষঙ্গ ছিলেন আর পদার্থ বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা Megnetohydrodynamics এর সূচনা করেন।

তার মতে যেহেতু তড়িৎচৌম্বকীয় বল মহাকর্ষ বলের চেয়ে শক্তিশালী, তাই আমাদের মহাবিশ্বকে তড়িৎচৌম্বকত্ব দিয়ে দেখা উচিৎ মহাকর্ষ দিয়ে নয়। আলফভেনের মতে আমাদের মহাবিশ্ব ম্যাটার আর অ্যান্টি ম্যাটার দ্বারা পূর্ণ এবং এরা একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে চলছে। এরা একে অপরের থেকে দূরে যাচ্ছে। আর দূরে যেখানে মিলিত হচ্ছে, সেখান থেকেই আসছে এই CMB রেডিয়েশন। কিন্তু আলফভেনের প্রস্তাব একদম অগ্রহনযোগ্য। কারণ মহাবিশ্ব কখনোই বৈদ্যুতিক নয়। সকল পর্যবেক্ষনই এটা বলে আর বিশেষ করে হাবলের সূত্র মতে মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর দূরে চলে যাওয়ার হার এর দূরত্বের সমানুপাতিক। অর্থাৎ গ্যালাক্সি যত দূরে তার গতি তত বেশি কিন্তু আলফভেনের মডেল সত্যি হলে এই গতি সব জায়গায় সমান হওয়ার কথা। সুতরাং বৈদ্যুতিক মহাবিশ্ব মডেলটি গ্রহনযোগ্য নয়।

চক্রাকার মহাবিশ্ব (Cyclic Universe)

বিগ ব্যাং তত্ত্বের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো এর সূচনা নিয়ে। মহাবিশ্বের ঠিক শুরুতে অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের আগে মহাবিশ্ব কেমন ছিল এটা বিগ ব্যাং বলতে পারে না। অনেকের ধারনা এই মহাবিশ্ব চক্রাকারের সূচনা হচ্ছে এবং ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে আর তারই একটি রুপ হলো এই বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরন।

অনেকের ধারনা আমাদের মহাবিশ্বের পাশেই আরও মহাবিশ্ব রয়েছে। আবার কারো কারো মতে মহাবিশ্ব বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে তৈরী হয় এবং একটা সময় পর এটি সংকোচিত হয়ে আবার বিগ ব্যাং ঘটায় এবং এভাবেই চলতে থাকে। এই চক্রাকারে চলা অনেকটা শ্বাশত মহাবিশ্ব মডেলেরই আধুনিক রুপ বলা যায়। কারণ একই ভাবে যদি একের পর এক বিগব্যাং হতেই থাকে তাহলে মূলত কিছুই পরিবর্তন হচ্ছে না। তাই এটা শ্বাশত মহাবিশ্ব মডেলই খালি অনেকগুলো ধাপ নিয়ে।

বিগ ব্যাং তত্ত্বের পাশাপাশি অনেক মডেল থাকলেও বিগ ব্যাং তত্ত্ব এখনো টিকে আছে। কারণ এখন পর্যন্ত পাওয়া বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের ফলাফল এটার ব্যাখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাই বর্তমানে এটা সৃষ্টিতত্ত্ববিদদের সাথে ব্যাপকভাবে গৃহীত। আশা করি সামনে আরো অনেক প্রমাণ পাওয়া যাবে যা বিগব্যাং তত্ত্বকে আরো উন্নত ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সাহায্য করবে। 

তথ্যসূত্রঃ 5 failed alternatives to the Big Bang theory and why they didn’t work – space.com

লেখাটি 201-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 906 other subscribers