এক.
রতন মিয়া পত্রিকা অফিসে কাজ করে। তার কাজ ছোটখাট। চা বানানো, সম্পাদক সাহেবের জন্য সিগারেট এনে দেওয়া, পত্রিকা বিলি করা ইত্যাদি। তার বয়স ৫২। ৫২ থেকে ১৬ বাদ দিলে থাকে ৩৬। ১৬ বছর বয়সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল সে। যদিও পুরোটা দিতে পারেনি। এরপর গত ৩৬ বছর ধরে সে চাকরি করে আসছে পত্রিকার। এ চাকরিটা অসম্ভব ভাল। দেশ-বিদেশের তরতাজা খবরের সাথে যুক্ত থাকা যায়। এ সৌভাগ্যই বা ক’জনের হয়? সে রাতে পত্রিকা অফিসেই ঘুমায়। মাদুর পেতে শুয়ে পড়ে চুপচাপ। মেসে বা আলাদা বাড়ি ভাড়া করেও থাকতে পারতো। কিন্তু সে শৌখিন নয়। তাই একা মানুষ হওয়ায় তার কোন বাড়ি বা মেসের দরকার হয়না।
আজ সকাল বেলাটা যথেষ্ট ভাল যাবে বলে মনে হচ্ছে তার। ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়েই পত্রিকাগুলো নিয়ে বসে গেল। সব পাতার হেডলাইনের দিকে একবার করে চোখ বুলিয়ে নিল সে। এবার তিন নাম্বার পাতাটা খুলল। ‘আজকের দিনটা কেমন যাবে’ শিরোনামটা পড়ে লেখা পড়া শুরু করলো। তার ধনুরাশি। আজকের রাশিফলে লেখা-
ধনু রাশির জন্য যাত্রা শুভ। তবে কিঞ্চিত অর্থনাশের ও শত্রুপক্ষের কাছে সম্মানহানির আশঙ্কা রয়েছে।
এটুকু পড়েই খানিকটা চিন্তিত হলো রতন। সম্মান তো কিছুই নেই। যা আছে তাও যদি চলে যায় তাহলে তো মুশকিল। পরের পাতা উল্টাতে যাবে এমন সময় মফিজুর রহমান স্যারের ফোন এলো। রতন মিয়া ফোনের রিসিভারটা তুলে কিছুক্ষণ কথা বলার পর ‘জ্বে আচ্ছা’ বলে রেখে দিল। স্যার গতকাল যে কাগজটা দিয়েছিল তা লালমাটিয়ার ৪ নম্বর গলির বড় বাড়িতে দিয়ে আসতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে। প্রথমে বিকাশে ৫০ টাকা পেমেন্ট করে দিয়েছিল যাবার খরচ হিসেবে কিন্তু পরে বললো স্যারের অফিসের গাড়িটা নিয়ে যেতে। রতন মিয়া রওনা হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
*******
রাস্তায় আজ কেন জানি ভিড় কম। ঢাকার রাস্তায় তো এটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। পরক্ষণেই তার রাশিফলের কথাভেবে চিন্তিত হলো সে। না টাকা তো আছে বিকাশে! বিকাশ থেকে চোর টাকা নিতে পারবে? সে সিস্টেম কি আছে? কে জানি!! রতন মিয়া সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই লিফটে উঠলো।
লিফটে রতন একা। লিফটম্যান তাকে ঢুকিয়ে বোতাম টিপে দিয়ে বলল- আটতলায় গিয়ে থামবে। নেমে যাবেন। পারবেন না? রতন বলেছে, জ্বে পারবো। তার কথা শেষ হবার আগেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। লিফট চলছে না। স্থির হয়ে আছে। কি ব্যাপার লিফটম্যান কি বোতাম টিপে দেয়নি? সে কি বোতাম টিপবে? রতন মনস্থির করতে পারছেনা। হঠাৎ করে লিফটের ভেতরে পুরোটা অন্ধকার হয়ে গেল। ইলেকট্রিসিটি কি চলে গেল? রতনের বুকে ধক করে ধাক্কা লাগল। ঢাকা শহরে কারেন্টের কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। একবার চলে গেলে কখন যে আসবে কে জানে?
রতন খুব সাবধানে লিফটের দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দিল। জোরে ধাক্কা দিতে সাহসে কুলাচ্ছে। কল-কবজার কারবার কী থেকে কী হয় কে জানে? দমবন্ধ হয়ে আসছে। লিফটম্যান ব্রাদারকে ডাকছে কিন্তু গলা থেকে যেন শব্দই বের হচ্ছে না। লিফটের দরজায় আরেকবার ধাক্কা দিল সে। এবার লিফট চলতে শুরু করলো। কিন্তু কারেন্ট ছাড়া কিভাবে চলছে? আর এত জোরে শোঁ শোঁ শব্দ করেই বা চলছে কীভাবে? যেন মনে হচ্ছে আসমানে চলে যাবে। রতন মনে মনে কুল হুয়াল্লাহু সুরা পড়ে ফুঁ দিতে লাগল। সূরা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই সে মেঝেতে বসে পড়লো। আর অদ্ভুতভাবে তখনই লিফটের দরজা খুলে গেল। খোলামাত্রই সে লাফ দিয়ে বের হয়ে পড়লো। কিন্তু কোথায় এসেছে সে? লাফ দিয়ে কি ভুল করলাম নাকি? মনে মনে ভাবতে লাগলো সে। আবার লিফটে উঠার জন্য পেছনে ফিরলো। কিন্তু লিফট নেই! লিফট কেন কোন কিছুই নেই। চারদিকে ভয়াবহ শূন্যতা। আকাশ-ফাকাশ কিচ্ছু নেই। ইয়া রাহমানুর রাহীম এ কি বিপদে পড়লাম? আমাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করো মাবুদ। আল্লাহর নাম জপতে জপতে চোখ বন্ধ করে ফেললো রতন।
দুই.
আস্তে আস্তে চোখ খুললো রতন। অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হচ্ছে এবার। আগে কোন শব্দ ছিল না। এখন শিস দেওয়ার মতো করে তীব্র শব্দ হচ্ছে। আচ্ছা সে কি মারা গেছে? এটা কি মৃত্যুর পরের জগত? তাহলে তো কেরামান কাতিবীনের থাকার কথা। কই কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না!
– তুমি কে?
রতন চমকে গেল। প্রশ্নটা সে আবার শুনলো কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না।
– এই তুমি কে?
রতন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল – ‘আমার নাম রতন মেয়া।’
– তুমি এখানে কিভাবে এসেছ?
– স্যার, আমি কিছুই জানি না। লিফটের ভিতর ছিলাম। লাফ দিয়া বাইর হইছি। আপনে কিছু একটা করেন। আমারে বাঁচান।
– তোমার কথা তো আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রথম কথা হল- তুমি মাত্রা ভাঙলে কিভাবে?
– স্যার বিশ্বাস করেন, আমি কোন কিছুই ভাঙ্গি নাই। যদি কিছু ভেঙ্গেও থাকে আপনা আপনি ভাঙছে। তার জন্য আমি ক্ষমা চাই স্যার।
– তুমি তো ভাই বিরাট সমস্যা তৈরি করলা। তুমি কি বুঝতে পারছ ব্যাপারটা কি ঘটেছে?
– জ্বে না।
– তুমি ত্রি-মাত্রিক জগৎ থেকে চতুর্মাত্রিক জগতে প্রবেশ করেছ। এটা কীভাবে করেছ আমরা জানি না। জানার চেষ্টা করছি।
– স্যার আমাকে ফেরত পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আপনাদের মুখটাও দেখতে পাচ্ছি না। পেলে ভয়টা একটু কমতো হয়তো।
– আমরা ইচ্ছা করেই তোমাকে মুখ দেখাচ্ছি না। মুখ দেখলে আরো ভয় পাবে।
– স্যার যে ভয় লিফটের মধ্যে পাইছি তারপর থেকে আর কোনকিছুতেই ভয় পাবো না। এমনকি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সামনে গেলেও ভয় পাবো না।
– তোমার নাম কি যেন বললে- রতন?
– জ্বে স্যার, রতন।
– একটা জিনিস বোঝার চেষ্টা কর, তুমি হচ্ছ ত্রি-মাত্রিক জগতের মানুষ। তোমাদের জগতের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা এই তিনটি মাত্রা আছে। এই দেখে তোমরা অভ্যস্থ। আমরা চার মাত্রার প্রাণী। আমাদের সম্পর্কে তোমার কোন ধারণা নেই।
– স্যার, আপনে আমার মতো বাংলায় কথা বলছেন, এটা শুনেই বেশ আনন্দ পাচ্ছি। আপনার চেহারা খারাপ হলেও অসুবিধা নাই। সবই তো আল্লাহর দান।
– আচ্ছা ঠিক আছে তুমি আমাকে দেখ।
রতনের শরীরে হঠাৎ কাঁপুনি লাগল। হঠাৎ এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগলে যেরকম অনুভূতি হয় ঠিক সেরকম অনুভূতি হচ্ছে তার মনে হচ্ছে চারপাশের ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা পরিবেশ ভেদ করে কালো মতো একটা আবছা ছায়ার মতো কিছু দেখা যাচ্ছে। রতন তার চোখের সামনে কি যেন দেখলো। মানুষের মতোই তবে স্বচ্ছ কাচের তৈরি। একটা মুখের ভেতর আরেকটা, তার ভেতর আবার আরেকটা এরকম চলেই গিয়েছে। চোখ দুটাও যেন কাচের। চোখের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। একটা চোখের ভেতর আরেকটা, আবার তার ভেতর আরেকটা দেখা যাচ্ছে।
– তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
– জ্বে না, স্যার। যদি কিছু মনে না করেন তা হলে একটু কিছু খেতে চাই। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি।
– কিন্তু এখানে তো খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই!
– তাহলে তো স্যার জায়গাটা সুবিধার না।
– আমরা তো তোমাদের মতো দেহধারী না। শুধু দেহধারীদেরই খাদ্য লাগে। আর দেহধারী কারোরই এখানে আসার উপায় নেই।
– কিন্তু স্যার আমি যে চলে এসেছি!
– হুম… তুমি তো চলে আসলা। কিন্তু তুমি কীভাবে এসেছ কে জানে? সে রহস্য উন্মোচর করতে আমার টিম কাজ করে যাচ্ছে।
– স্যার, আপনাদের জায়গাটাতো সুবিধার না। এখানে দেহধারী কেউ নাই। আবার খাবারেরও ব্যবস্থা নেই। আমাদের জগতে সমুদ্র- নদী আছে। আপনাদের এখানে আছে?
– আমাদের এখানেও আছে। কিন্তু আমাদের সমুদ্র তোমাদের মতো নয়। আমরা সময়ের সমুদ্রে বাস করি। তোমাদের কাছে সময় নদীর মতো প্রবাহমান কিন্তু আমাদের সমুদ্র হচ্ছে স্থির।
– মনে কিছু নেবেন না স্যার। আপনার কথা আমার মাথায় ঢুকছে না।
– না ঢোকারই কথা। তোমাকে দেখেও বিশেষ জ্ঞানী লোক মনে হয় না। তবুও তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
– স্যার, মুর্খ লোকদের সবাই পছন্দ করে। তাদের সবাই ভালবাসে। আমার স্যারও আমাকে খুব ভালবাসে।
– চিন্তা করো না। আমরা তোমাকে ফেরার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তবে এখান থেকে ফেরার পর তোমার জীবন আনন্দময় হবে। তোমাকে আর চা-সিগারেট বানিয়ে ও পত্রিকা বিলি করতে হবে না।
-কী করব বলেন, স্যার! এটা ছাড়া তো রোজগারের কোন উপায় নাই। পড়াশোনা হয় নাই। ম্যাট্রিকটাও দিতে পারলাম না।
– তোমাকে ফেরত পাঠাচ্ছি ম্যাট্রিক পরীক্ষা শুরু হবার আগের দিন রাতে।
– কীভাবে পারবেন, স্যার?
– সময় আমাদের কাছে স্থির। আমরা তা করতে পারি। তুমি যখন ফিরে যাবে তখন এখানকার স্মৃতি তোমার মনে থাকবে না। তোমার নতুন জীবন শুরু হবে। যে জীবনটা হবে আনন্দে ভরা। পড়াশুনায় তুমি হবে অত্যন্ত মেধাবী।
– এখন কি স্যার আমি তাহলে চলে যাচ্ছি?
– কিছুক্ষণের মধ্যেই যাচ্ছ।
– আচ্ছা দোয়া রাখবেন, স্যার। এই বিপদ থেকে মুক্তি পাবো কোনদিন চিন্তাও করি নাই। আপনাকে আল্লাহ মনে হয় আমাকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই পাঠিয়েছিলেন। শোকর আলহামদুলিল্লাহ।
রতন হঠাৎ বুকে ধাক্কার মতো অনুভব করলো। তার মনে হচ্ছে সে যেন ভাসছে শূন্যে। এখান থেকে সে কি নিচে পড়ে যাবে? আর ভাবতে পারছে না। তার দুটো চুখোর পাতা বুজে আসছে। ভারি ঘুম পাচ্ছে।
তিন.
রতনের ঘুম ভেঙেছে।
সে তার গ্রামের বাড়িতে চৌকির উপর বই-খাতা মেলে পড়তে বসেছিল। পড়তে পড়তে ঘুমিয়েই পড়েছিল। কী সর্বনাশের কথা! কাল বাংলা ১ম পত্রের পরীক্ষা। রাচি ভ্রমণ গল্পটা পড়ছিল। কিন্তু এরইমধ্যে অন্য একটা জগৎ থেকে যেন ঘুরে এলো সে। পাশেই রাখা ছিল দুধের গ্লাস। মা কখন এসে দিয়ে গেছে টেরই পায় নি। অন্য দিন হলে এক ঢোকে সবটুকু শেষ করে ফেলতো সে। কিন্তু আজ সম্ভব হয়নি। দুধের গ্লাস হাত দিয়ে ধরার সময় মনে হলো গ্লাসটি আর গরম নেই। বরফের মতো ঠাণ্ডা! আচ্ছা, চতুর্মাত্রিক জগতে কি গরম বস্তুও ঠাণ্ডা হয়ে যায়?? মনে মনে ভাবতে থাকলো সে।
Leave a Reply