আজ থেকে ২৭ বছর আগে লস অ্যাঞ্জেলেসে শক্তিশালী একটি ভূমিকম্পের কারণে বিশাল এলাকা বিদুৎহীন হয়ে পরে। পুরো শহর অন্ধকারে তলিয়ে যায়। আতঙ্কিত বাসিন্দারা জরুরী পরিসেবাকেন্দ্র ৯১১ ফোন করে বলেন যে, তাদের মাথার উপরে েক বিশাল রুপালী মেঘ পুরো আকাশ ঢেকে ফেলেছে।
আসলে তারা সেইদিন প্রথমবারের মতো রাতের নক্ষত্রখচিত আকাশের সাথে আমাদের ছায়াপথের বাহুর কিছু অংশ দেখতে পেয়েছিলো। যেটা তাদের কাছে “রুপালী মেঘ” মনে হয়েছে। লস অ্যাঞ্জেলস শহরের কিছু বাসিন্দা কখনোই আগে ঘন-অন্ধকার আকাশ দেখেন নি।
মাত্র একশো বছর আগেও আপনি কোন শহরে রাতে বাইরে হাঁটতে বের হলে আকাশ জুড়ে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি খিলান দেখতে পেতেন। হাজার হাজার নক্ষত্র দেখতে পারা ছিল দৈনন্দিন জীবনের অংশ।
বিশ্বের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি এখন শহরে বসবাস করে। শহরে প্রতি ৪ জনের মধ্যে ৩ জন কখনও আদিম অন্ধকার আকাশের বিস্ময় অনুভব করেননি। এখন, বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন শিশু-কিশোর তারা যেই ছায়াপথে বসবাস করে তা দেখার সৌভাগ্য কখনোই লাভ করে না।
রাতে কৃত্রিম আলোর বর্ধিত ও বিস্তৃত ব্যবহার কেবল মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিই শুধূ নয়, অত্যাধিক আলোক দূষণের ফলে এটি রাতের আকাশে নক্ষত্রের আলো মুছে ফেলে। এটি জ্যোতির্বিদ্যা গবেষণায় হস্তক্ষেপ করে, বাস্তুতন্ত্রকে ব্যাহত করে, আমাদের পরিবেশ, সুরক্ষা, শক্তি এবং স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
বেশিরভাগ মানুষ বাতাস পানি, এবং ভূমি দূষণের সাথে পরিচিত। তবে আপনি কি জানেন যে আলোও দূষণ হতে পারে? কৃত্রিম আলোর অতিরিক্ত ব্যবহার আলোক দূষণ হিসাবে পরিচিত।
আলো দূষণ হলো রাতের বেলা মানুষের দ্বারা উৎপাদিত অতিরিক্ত এবং অবিরাম আলো। এই আলো কৃত্রিম উৎস থেকে আসে প্রধানত ঘর, অফিস, স্ট্রিটল্যাম্প, বিলবোর্ড, বা গাড়ির হেডলাইট থেকে। দুই রকমের আলো দূষণ আছে। একটি পয়েন্ট সোর্স, যা সরাসরি কোন একক উৎস থেকে আসে। অন্যটি স্কাই-গ্লো। কোনও গ্রামীণ অঞ্চল থেকে কোনও শহরের দিকে তাকালে দিগন্তের আকাশকে আলোকিত অবস্থায় দেখা যায়। এটি পয়েন্ট সোর্স লাইটিংয়ের সম্মিলিত এবং জমে থাকা প্রভাব যা বায়ুমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ে। এটাকেই স্কাই-গ্লো বলে।
বিশ্বজুড়ে প্রায় এক চতুর্থাংশ অঞ্চলের আকাশ এখন আলো দূষণের আওতায়। ২০১৬ সালের ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস অফ আর্টিফেসিয়াল নাইট এর স্কাই ব্রাইটনেস এর হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের জনসংখ্যার ৮৩% এইরকম আলো দূষিত আকাশের নীচে বাস করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের ৯৯% মানুষ প্রাকৃতিক রাত উপভোগ করতে পারে না।
আপনি কোথায় থাকেন সেখানে আলোকের দূষণ কতটা খারাপ, তা জানতে চাইলে ওয়ার্ল্ড অ্যাটলাস ডেটা বা নাসা ব্লু মার্বেল নেভিগেটর থেকে তৈরি করা ইন্টারেক্টিভ মানচিত্রটি ব্যবহার করুন। এটি নাগরিক এবং বিজ্ঞানীদের দ্বারা সংগৃহীত আট বছরের ডেটা দিয়ে তৈরি করা।
তিন বিলিয়ন বছর ধরে পৃথিবীতে জীবন আলো এবং অন্ধকারের ছন্দে বিদ্যমান ছিল যা শুধুমাত্র সূর্য, চাঁদ এবং নক্ষত্রের আলোকসজ্জার দ্বারা তৈরি হয়েছিল।
এখন কৃত্রিম আলো অন্ধকারকে হটিয়ে দিয়ে শহরগুলিকে রাতে আলোকিত করে তোলে, প্রাকৃতিক দিন-রাতের ধরণকে ব্যাহত করে এবং আমাদের পরিবেশের সূক্ষ্ম ভারসাম্যকে নষ্ট করে ফেলে। আলো দূষণ হলো শিল্পভিত্তিক সভ্যতার একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া।
অনেক প্রজাতি আছে যারা সূর্যের ও চাঁদের আলোর চক্র ব্যবহার করে। তাদের আচরণ, ক্রিয়াকলাপ খাওয়া এবং ঘুমের ধরন এর উপরে নির্ভর করে। তবে এখন আলো দূষণের স্থান বড় হচ্ছে এবং এর তীব্রতাও বাড়ছে। আলোক দূষণ বিশেষ করে নিশাচর বন্যপ্রাণীর জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে, যা উদ্ভিদ ও প্রাণীর শারীরবৃত্তের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এটি প্রাণীদের অভিবাসন পদ্ধতিকে বিভ্রান্ত করতে পারে। প্রাণীদের প্রতিযোগিতামূলক মিথস্ক্রিয়া পরিবর্তন করতে পারে, শিকারী-শিকার সম্পর্ক পরিবর্তন করতে পারে এবং শারীরবৃত্তীয় ক্ষতি করতে পারে। জীবনের ছন্দ আলো এবং অন্ধকারের প্রাকৃতিক প্রতিদিনের নিদর্শন দ্বারা সাজানো হয়; তাই এই প্যাটার্নগুলির ব্যাঘাত পরিবেশগত গতিবিদ্যাকে প্রভাবিত করে।
বর্তমানে এই আলো দূষণের বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে বলে প্রমাণ যাচ্ছে। আলো পরিবেশকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কারণ এটি প্রাকৃতিক আলোকচক্রকে বিঘ্নিত করে, যার প্রভাব বিভিন্ন প্রজাতির উপরে পরে।
পৃথিবীর বেশিরভাগ প্রাণের মতো মানুষ একটি সার্কেডিয়ান রিদম নামে পরিচিত প্রাকৃতিক শারীরিক চক্রের উপর নির্ভরশীল। আমাদের জৈবিক ঘড়ি দিন এবং রাতের ঘুম চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। রাতের কৃত্রিম আলো সেই চক্রটিকে ব্যাহত করতে পারে।
এই আলো মানুষের স্বাস্থ্যের উপরেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমাদের দেহ সার্কাডিয়ান তালের প্রতিক্রিয়াতে মেলাটোনিন হরমোন উৎপাদন করে। মেলাটোনিন আমাদের সুস্থ রাখতে সহায়তা করে। ঘুমকে প্ররোচিত করে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, কোলেস্টেরল কমায় এবং থাইরয়েড অগ্ন্যাশয়, ডিম্বাশয়, টেস্টিস এবং অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিগুলিকে আরো সক্রিয় করে তোলে।
আলোক দূষণের ফলে এই গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের কার্যকলাপ ব্যাহত হতে পারে এবং এর উৎপাদনকে কমে যেতে পারে।
এর ফলে মোটা হওয়া, ঘুম হ্রাস, পাওয়া, ডায়াবেটিস,স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেতে পারে। মেলাটোনিন একটি অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট যা ফ্রি র্যাডিকেলগুলি সরিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু আলোতে এর কার্যকলাপ হ্রাস পেতে পারে এবং এতে করে ক্যান্সারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
সমস্ত কৃত্রিম আলো সমানভাবে তৈরি করা হয় না। রাতে নীল আলোর বহিঃপ্রকাশ বিশেষ ক্ষতিকারক। দুর্ভাগ্যক্রমে নতুন এলইডি (লাইট ইমিটিং ডায়োড) লাইট প্রাকৃতিক আলোক চক্রকে প্রচন্ড ব্যাঘাত ঘটায়।
কিন্ত এই লাইটের বিশেষ সুবিধার জন্য বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার বেড়ে চলছে। পাশাপাশি কম্পিউটার স্ক্রিন, টিভি এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক প্রদর্শন প্রচুর নীল আলো তৈরি করে। কিন্তু এর নেতিবাচক স্বাস্থ্য পরিণতি সম্পর্কে খুব কম বিবেচনা করা হচ্ছে।
বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক পর্যালোচনা বিশ্বব্যাপী আলো দূষণ কমাতে পাঁচটি মূল কৌশল ব্যবহার করার কথা বলছে। তা হলো-
- পূর্ববর্তী অন্ধকার অঞ্চলে আলোর ভূমিকা এড়ানো উচিৎ।
- আলো সর্বনিম্ন ব্যবহারযোগ্য তীব্রতায় ব্যবহার করা।
- আলো কেবল যেখানে প্রয়োজন সেখানেই শুধু ব্যবহার করা উচিৎ।
- প্রয়োজনের সময় কেবল আলো ব্যবহার করা উচিৎ।
- আলো উষ্ণ হওয়া উচিৎ। যার অর্থ তীব্র সাদা বর্ণালীর পরিবর্তে কমলা রঙের আলো বেশি ব্যবহার করা উচিৎ।
আলো দূষণের ফলে যেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য যথেষ্ট সচেতন হওয়ার প্রয়োজন। রাতে আপনার নিজের বাড়ি থেকে আলো কমিয়ে শুরু করতে পারেন। এরপরে আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের এই কাজ করতে উৎসাহিত করুন। আলো দূষণ এবং রাতে কৃত্রিম আলোর নেতিবাচক প্রভাবগুলি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না, অন্যদের কাছে বিষয়গুলি ব্যাখ্যা করুন।
আপনি এই ক্রমবর্ধমান সমস্যায় সচেতনতা আনতে এবং আমাদের প্রাকৃতিক রাতের আকাশ রক্ষা করার জন্য আরও বেশি লোককে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনুপ্রাণিত করুন। আফ্রিকা এখনও স্বল্পতম আলো দূষিত মহাদেশগুলির মধ্যে একটি। তবে অবকাঠামোর প্রসারণের সাথে সাথে দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক বিকাশের সাথে এটি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
আলো দূষণের কারণে, আমাদের শহরগুলির রাতের আকাশ প্রাকৃতিক, নক্ষত্রখচিত আকাশের চেয়ে কয়েক গুণ উজ্জ্বল থাকে।
এই স্কাইগ্লো নক্ষত্রগুলিকে আমাদের দৃষ্টির আড়াল করে দেয়। সেই সাথে আমাদের এবং পৃথিবীর সমস্ত জীবনকে প্রাকৃতিক রাতের আকাশ উপভোগ করতে বাধা দেয়। দিনরাত্রির প্রাকৃতিক আলো অন্ধকার চক্রের মধ্যে মানুষ বিকশিত হয়েছিল। কৃত্রিম আলো ছড়িয়ে যাওয়ার অর্থ হলো আমরা বেশিরভাগই সত্যিকারের অন্ধকার রাতের অভিজ্ঞতা লাভ করা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।
তথ্যসুত্রঃ
Leave a Reply