আকাশে প্রশ্নবোধক সপ্তর্ষী তারামণ্ডলী

লিখেছেন

লেখাটি , বিভাগে প্রকাশিত

বর্তমানে সূর্যাস্তের পরে উত্তর-পশ্চিম আকাশের দিকে তাকালে দেখতে পাবেন বিরাট এক প্রশ্ন বোধক চিহ্নের আকারে সাতটি নক্ষত্র জ্বল জ্বল করছে। এর নাম সপ্তর্ষী মন্ডল। এই তারা-মন্ডলটির নাম শুনেন নি এমন মানুষ খুব কম আছে। 

এই মন্ডলটির পাশ্চাত্য নাম উরসা মেজর (Ursa Major)। ‘দ্য প্লাফ’ ডাকনামে পরিচিত, একে বিগ ডিপারও বলে। প্রাচীন গ্রিকরা উরসা মেজরকে ভাল্লুক হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এর ল্যাটিন নাম ‘বৃহত্তর ভালুক’।  কিছু ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে নামকরণের এই ঐতিহ্য কমপক্ষে ১০,০০০ বছর আগের। 

সাধারণত, বিভিন্ন সভ্যতার নক্ষত্রপুঞ্জের বিভিন্ন নাম রয়েছে। উরসা মেজর সম্পর্কে একটি কৌতূহলী বিষয় হল ভিন্ন মহাদেশে, দুটি ভিন্ন সভ্যতায়, একে অপরের সাথে যোগাযোগ ছাড়াই এটি একই প্রাণীর সাথে যুক্ত ভাল্লুক।  নেটিভ-আমেরিকান এবং গ্রীক উভয়েরই এই তারামণ্ডলের সাথে ভালুকের সাথে জড়িত মিথ ছিল। নেটিভ-আমেরিকানরা এটিকে “মহা-ভাল্লুক” বলেও ডাকে। তারা এর পিছনে থাকা তিনটি নক্ষত্রকে শিকারী হিসাবে উল্লেখ করেছিল, যারা এটিকে তাড়া করেছিল।

আকাশে অন্যান্য তারামন্ডলীর সাপেক্ষে সপ্তর্ষী তারামন্ডল। ছবি: বিশ্ব.কম।

চীনা সভ্যতায় এই নক্ষত্রমণ্ডলকে ভাল্লুক হিসাবে উল্লেখ করেনি, তবে তারা বিগ ডিপারকে উত্তর ডিপার হিসাবে উল্লেখ করেছে এবং প্রধান সাতটি নক্ষত্রের সকলকে যথাযথ নাম দিয়েছে। জাপানে সাতটি প্রধান নক্ষত্র সবচেয়ে শক্তিশালী কামি (আত্মা) অ্যামেনোমিনাকানুশির অন্তর্গত।

উরসা মেজর বেশিরভাগ বিশ্ব সংস্কৃতিতে সুপরিচিত এবং বেশ কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনীর সাথে যুক্ত। এটি দ্বিতীয় শতাব্দীতে গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি দ্বারা তালিকাভুক্ত নক্ষত্রপুঞ্জের একটি ছিল। 

রোমান পুরাণে উরসা মেজর ক্যালিস্টোর মিথের সাথে যুক্ত।  ক্যালিস্টো ছিলেন একজন তরুণ, আকর্ষণীয়, মানব নারী যিনি বৃহস্পতি, দেবতাদের নেতা এবং জিউসের সমতুল্যদের নজর কেড়েছিলেন।  বৃহস্পতির স্ত্রী, জুনো ক্যালিস্টোর প্রতি ঈর্ষান্বিত ছিলেন তাই তিনি তাকে একটি ভালুকে পরিণত করার এবং তাকে নক্ষত্রের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে বৃহস্পতি আর তার প্রতি আকৃষ্ট না হয়।

ভিনসেন্ট ভ্যান গগের বিখ্যাত চিত্রকর্ম  স্টেরি নাইট ওভার দ্য রোনে (Nuit étoilée sur le Rhône) আকাশে বিগ ডিপার দেখা যায়। পেইন্টিংটিতে ফ্রান্সের রোন নদীর একটি রাতের দৃশ্য যেখানে এক দম্পতি নদীর পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে এবং নক্ষত্র  ভরা একটি উজ্জ্বল আকাশ রয়েছে।  পেইন্টিংটি ১৮৮৮ সালে অংকন করা হয়েছিল এবং বর্তমানে প্যারিসের Musée d’Orsay-এ প্রদর্শিত হয়।

ভ্যান গগের স্টেরি নাইট ওভার দ্য রোন।

শেক্সপিয়রের অনেক রচনায় উরসা মেজরের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যা প্রায়ই ‘দ্য বিগ বিয়ার’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।  কিং লিয়ার-এ খলনায়ক এডমন্ডও উল্লেখ করেছেন যে তার জন্ম ছিল উরসা মেজরের অধীনে।

পোলারিস এবং বিগ ডিপারের নক্ষত্র (উর্সা মেজর) হল আলাস্কার রাষ্ট্রীয় পতাকার প্রধান উপাদান।

আলাস্কা রাজ্যের পতাকা নীচে দ্য বিগ ডিপার এবং শীর্ষে পোলারিস।

প্রাচীন কালে ভ্রমণকারী এবং নাবিকরা সর্বদা এই নক্ষত্র মন্ডলকে নেভিগেট করতো সমুদ্রের মাঝখানে তাদের পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করার জন্য – যেখানে আপনাকে সঠিক পথে রাখতে সাহায্য করার জন্য কোনও ল্যান্ডমার্ক নেই।

এই মন্ডলে একটি বৃহৎ ভাল্লুকের কল্পনা করা হয়েছে। আরবীতে এই মন্ডলের নাম “দোব্বে আকবর” বা বৃহৎ ভাল্লুক। যদিও একে “বানাত নাশ” বা জানাযা হিসাবে অনেকেই জানে। এই নক্ষত্রমণ্ডলীর পশ্চিমের চারটি নক্ষত্র দিয়ে শবাধার এবং পূবের তিনটি নক্ষত্র দিয়ে পিছনের লোক কল্পনা করা হয়।

ভারতীয় পূরাণে এই মন্ডলকে “চিত্রশিখন্ডী” বলা হয়েছে যেখানে একটি ময়ূরের আকৃতি প্রকাশ পায়।

এই মন্ডলটি আকাশে যতগুলি নক্ষত্র মন্ডল আছে তার মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। এটি আকাশের ১,২৮০ স্কয়ার ডিগ্রী স্থান দখল করে আছে। এটি রাতের আকাশের সবচেয়ে আইকনিক চিহ্নগুলির মধ্যে একটি। এর চেয়ে বড় দুটি নক্ষত্রমণ্ডল হল কন্যা এবং হাইড্রা।

এই মন্ডলের পশ্চিমের চারটি নক্ষত্র দিয়ে ভাল্লুকের শরীর। পূবের তিনটি নক্ষত্র দিয়ে ভাল্লুকের লেজ কল্পনা করা হয়েছে। যদিও সাতটি নক্ষত্র নিয়ে এই মন্ডল গঠিত, তবুও চিত্রে ভাল্লুকের পায়ে এবং মুখে অনেকগুলি ছোট ছোট তারা আছে।

আবার একে যখন বড় চামচ (বিগ ডিপার) হিসাবে কল্পনা করা হয়, তখন মন্ডলের পশ্চিমের চারটি নক্ষত্র দিয়ে পেয়ালা এবং পূবের তিনটি নক্ষত্র দিয়ে এই পেয়ালার হাতল কল্পনা করা হয়। বিগ ডিপারে ছোট ছোট তারা গুলো স্থান পায়নি।

সপ্তর্ষী।

এই মন্ডলে প্রথম শ্রেনীর কোন উজ্জল নক্ষত্র নেই। সাধারনত অন্যান্য নক্ষত্র মন্ডলের উজ্জল নক্ষত্র গুলিকে ক্রমানুযায়ী গ্রীক বর্নমালার অক্ষর আলফা, বিটা, গামা, ইত্যাদি দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।

কিন্ত সপ্তর্ষী মন্ডলের ক্ষেত্রে এর পশ্চিম বাহুর উত্তরের নক্ষত্রটিকে আলফা, তারপরের নক্ষত্রটি বিটা, এরপরে গামা, ডেলটা, ইপসিলন, জিটা, ইটা ইত্যাদি অক্ষরে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন দেশে এই সাতটি নক্ষত্রের আলাদা নাম আছে।

ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে এই সাতটি নক্ষত্র সাতজন মূনীর নামে পরিচিত।

এই সাতটি নক্ষত্রের নাম-

বাংলা নাম ইংরেজি নামআরবী নাম  উজ্জ্বলতা 
ক্রতুDubheদোব্বে  ১.৯৫
পুলহMerakমেরাকোল আরাবে২.৪৪
পুলস্ত্যPhecdaফাখদোল আবে২.৫৪
অত্রিMegrezমেগরেজোল আবে৩.৪
অঙ্গিরাAliothআলইয়াম১.৬৮
বশিস্ঠMizarমেসরেজ২.১৬
অরুন্ধতীAlcorআলকোর৪.০
মরীচিAlkaidআলকায়েদ১.৯১

নক্ষত্রমণ্ডলের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হল এপসাইলন উরসা মেজরিস (Alioth)। এটির মাত্রা ১.৭৭, এটি আকাশের ৩২তম উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত হয়েছে। এই মন্ডলে পৃথিবীর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র হল লালান্দে ২১১৮৫, এটি একটি লাল বামন নক্ষত্র যা মাত্র ৮.৩১ আলোকবর্ষ দূরে, এটি পৃথিবীর ষষ্ঠ নিকটতম নক্ষত্রে পরিণত হয়েছে। 

লালান্দে।

এই সপ্তর্ষী মন্ডল আজকে আমরা যেভাবে দেখতে পাই তা এই রকম ছিল না। এই মন্ডলের প্রথম তারা ক্রতু (Dubhe) এবং লেজের তারা  মরীচি (Alkaid) এই নক্ষত্র দুটির গতি দুই দিকে আলাদা আলাদা। আজ থেকে ৫০,০০০ বছর পরে সপ্তর্ষীর বর্তমান আকার পরিবর্তন হয়ে যাবে।

এই মন্ডলের সাতটি উজ্জল নক্ষত্রের মধ্যে ক্রতু গাঢ় কমলা রংয়ের কম্পনশীল নক্ষত্র এবং মরীচি রুপালী নীল রংয়ের নক্ষত্র; বাকী পাঁচটি নীলচে সাদা রংয়ের।

এই মন্ডলের বশিষ্ঠ (জেটা উরসে মেজোরিস) নক্ষত্রটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বহু বছর ধরে এটিকে একটি বাইনারি নক্ষত্র (দুটি তারা একে অপরের চারপাশে প্রদক্ষিণ করে) বলে মনে করা হয়েছিল, কিন্তু পরে নিশ্চিত করা হয়েছিল যে দ্বিতীয় নক্ষত্রটিতে আরও চারটি ছোট নক্ষত্র রয়েছে। 

সপ্তর্ষী এবং ধুমকেতু নিওওয়াইস। লেখকের মোবাইলে বরিশাল থেকে তোলা।

মিজার নামে পরিচিত আসলে ছয়টি পৃথক নক্ষত্র যাকে সেক্সটুপল সিস্টেম বলা হয়। ১৯৫৭ সালে আবিষ্কারক জন এ. হুইপল এবং জ্যোতির্বিদ জর্জ পি. বন্ড দ্বারা ছবি তোলার জন্য এটিই প্রথম মাল্টি-স্টার সিস্টেম।

এই সপ্তর্ষী মন্ডলের সাহায্যে আকাশের অনেক গুলো প্রথম শ্রেনীর উজ্জল নক্ষত্র এবং মন্ডল খুজে বের করা যায়। যেমন-প্রথম দুটো তারা পুলহ ও ক্রতুকে একটি কাল্পনিক রেখা দ্বারা যোগ করে রেখাটিকে সামনে  বাড়িয়ে দিলে তা লঘু সপ্তর্ষী বা ধ্রুব (Poll star) নক্ষত্রে গিয়ে পৌছাবে।

বিগ ডিপার ব্যবহার করে পোলারিস খুজে বের করা।

পুলহ ও ক্রতুর মধ্যবর্তী দূরত্ব ৫ ডিগ্রী এবং ক্রতু থেকে ধ্রুব তারার দূরত্ব মোটামুটি ৩০ ডিগ্রী দূরে।

পেয়ালের হাতলের তিনটি তারা অঙ্গিরা, বশিষ্ঠ,মরীচি একটি কাল্পনিক বৃত্তচাপ গঠন করে। এই বৃত্তচাপটিকে ৫ গুন বাড়িয়ে দিলে বুটিস মন্ডলের উজ্জল তারা স্বাতী (Arcturus) এ গিয়ে পৌছাবে। এই বৃত্তচাপটিকে আরো একটু সামনে বাড়িয়ে দিলে কন্যা রাশির উজ্জল তারা চিত্রা (Spica) গিয়ে পৌছাবে। 

পেয়ালের নীচের দুটো নক্ষত্র অর্থাৎ পুলস্ত্যকে পুলহের সাথে যোগ করে বাড়িয়ে দিলে তা মিথুন রাশির প্রথম নক্ষত্র সোমতারা (Pollux) এ গিয়ে পৌছাবে। উত্তর গোলার্ধে (কলম্বিয়ার সর্বত্র উত্তরে) নক্ষত্রমণ্ডলটি সারা বছর দেখা যায়।  এটি উত্তর নক্ষত্রের (পোলারিস) চারপাশে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে প্রদক্ষিণ করে এবং একটি ল্যাপ তৈরি করতে প্রায় ২৪ ঘন্টা সময় লাগে। উরসা মেজর সহজে একটি প্রাকৃতিক ঘড়ি হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

যদিও পৃথিবীর বেশিরভাগ জায়গা থেকে উরসা মেজরকেদেখা যায়, তবে দক্ষিণ মেরুর কাছাকাছি কিছু অবস্থান রয়েছে যেখানে অবস্থানের কারণে এটি দেখা সম্ভব নয়। 

সপ্তর্ষী।

এই মন্ডলে অনেক গুলো বিখ্যাত গভীর আকাশের বস্তু রয়েছে যেমন পিনহুইল গ্যালাক্সী (M101), বোডে’স গ্যালাক্সী সিগার গ্যালাক্সী  আউল নেবুলা। এই গ্যালাস্কী গুলো মাঝারী আকারের দূরবীন দিয়ে দেখতে পাবেন। সময় পেলে আকাশের এই নক্ষত্র মন্ডলটিকে দেখে নিবেন।

তথ্যসুত্রঃ 

Ursa Major (The Big Dipper) Explained For Kids. Facts, Myth & Stars.

Interesting Facts About Ursa Major

লেখাটি 458-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 904 other subscribers