ব্যথা কেন দরকারী?

লেখাটি বিভাগে প্রকাশিত

ব্যথা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে হোক আর ভুলে গরম পানিতে হাত দিয়ে হোক, জীবনে ব্যথ্যা পেতেই হয়। প্রিয়জনের মৃত্যু কিংবা বিচ্ছেদের কারণে তীব্র মানসিক কষ্টের সম্মুখীনও হন মানুষ। ব্যথা স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া। এর উৎপত্তি মস্তিষ্কে। ক্ষতস্থান সম্পর্কে জানতে পারা, ক্ষতের তীব্রতা বুঝতে পারা, রোগের উপসর্গ বুঝে সময়মতো চিকিৎসা ও বেঁচে থাকায় ব্যথা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শারীরিকভাবে ব্যথা পাওয়ার সঙ্গে মানসিক অবস্থার একটি জটিল সম্পর্ক আছে। ব্যথা শরীরিক, মানসিক, ক্ষণস্থায়ী, দীর্ঘমেয়াদি, তীব্র, মৃদু বিভিন্ন রকমের হতে পারে। একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমরা ব্যথা কীভাবে সৃষ্টি হয়, কীভাবে একে দূর করা যায় তা পুরোপুরি বুঝতে পারিনি।

ব্যথা অনেক ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী, কিন্তু এটাই জীবনকে নরকে পরিণত করতে পারে। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতির কারণে মানুষের আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু জীবনের শেষ বছরগুলো বিভিন্ন রকম স্বাস্থ্য সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। ব্যথা তার মধ্যে প্রধান। এর কার্যকরী কোনো চিকিৎসা নেই। যেগুলো আছে সেগুলো আবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে অন্য সমস্যা বয়ে নিয়ে আসে।

ডর্সাল রুট গ্যাংগ্লিয়া।

সম্প্রতি ব্যথা কোথায়, কীভাবে সৃষ্টি হয় তা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধারণা পাওয়া গেছে। ত্বক, পেশি, অঙ্গসহ শরীরের যেকোনো অংশ তাপ, চাপের সংস্পর্শে এলে সংবেদনশীল স্নায়ুগুলো সেই তথ্য সংগ্রহ করে। এই স্নায়ুগুলো গুচ্ছ আকারে থাকে। আর এই গুচ্ছকে বলে ডর্সাল রুট গ্যাংগ্লিয়া। এই স্নায়ুগুচ্ছ সুষুম্না ও মস্তিষ্কে সংকেত পাঠানোর কাজ করে। কোনো নির্দিষ্ট ধরন ও মাত্রার উদ্দীপনা স্নায়ুগুচ্ছের কোনো নিদিষ্ট স্নায়ুকে সংকেত পাঠায়। সংকেত গ্রহণকারী স্নায়ুকে নসিরিসেপ্টর বলে। এই সংকেতই আসলে ব্যথার অনুভূতি তৈরি করে।

ব্যথার সংকেত পাঠানোর সাধারণ প্রক্রিয়া উনিশ শতকের শুরুই দিকেই জানা যায়। কিন্তু বিস্তারিত আমাদের অজানা ছিল। ১৯৯৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরতত্ত্ববিদ ডেভিড জুলিয়াসের একটা গবেষণা অন্ধকারে আলোর দিশা দেখায়। তিনি আবিষ্কার করেন TRPV1 নামের একটা জিন নসিরিসেপ্টরকে তাপ সংবেদশীল করে তোলে। এই আবিষ্কারের জন্য তাকে ২০২১ সালে নোবেল পুরস্কারও দেয়া হয় জুলিয়াসকে। এই গবেষণার একটা ইঙ্গিত ছিল, হয়তো কোনোভাবে প্রোটিনকে বাধা দিয়ে ব্যথা নিরাময়ের উপায় বের করা সম্ভব।

২০২১ সালে শরীরতত্ত্বে নোবেল জেতেন ডেভিড জুলিয়াস।

২০০৬ সালে যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি গবেষণা চালানো হয়। অধ্যাপক জিওফ উডস গবেষণাটি পরিচালনা করেন। ফলাফল হিসেবে একটি জটিল শারীরিক অবস্থার কথা জানা যায়। অবস্থাটির নাম দেয়া হয় কন্টিজেন্টাল ইনসেন্সিভিটি টু পেইন (CIP)। প্রতি দশ লাখে একজন মানুষ এই সমস্যাতে ভোগে। তারা কোনো ব্যথা অনুভব করতে পারে না। এদের বেশির ভাগই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই মারা যায়। তাদের ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় মূলত SCN9A জিনের মিউটেশনই এই অবস্থার জন্য দায়ী। এই জিনের কাজ হলো নসিরিসেপ্টরকে নির্দেশনা দেয়া। কিন্তু কোনো কারণে এটার মিউটেশন ঘটলে নির্দেশনা দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে মস্তিষ্কে ব্যথার সংকেতই পৌঁছাতে পারে না। এ জন্য ব্যক্তিও ব্যথা অনুভব করতে পারে না।

TRPV1 জিনের আবিষ্কার কি ভবিষ্যতে পেইনকিলার তৈরিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে নেবে? সম্ভবত না। কারণ, বিষয়টা এতটাও সোজা নয়। ব্যথার সংকেত প্রবেশের পথ বন্ধ করে দিলে এর মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। ব্যথার প্রক্রিয়াটি শুধুমাত্র একটি অংশের ওপর নির্ভর করে না। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ একে অপরের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে ব্যথার নেটওয়ার্ক তৈরি করে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক বেথ ডার্নাল বলেন,

‘ব্যথা অত্যন্ত জটিল একটি প্রক্রিয়া। এটা পীড়াদায়ক অনুভূতি। এর সঙ্গে মানসিক অবস্থাও জড়িত থাকে। ব্যথার প্রেক্ষাপট, নিজস্ব অর্থ, চিন্তাভাবনা, আবেগ, বয়স, রাতে ঘুমের গুণগতমান- এসব কিছু আমাদের ব্যথার অভিজ্ঞতার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।’

আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে ব্যথার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। দুঃখ, হতাশা, ভয় ইত্যাদি মানসিক অনুভূতি মানুষকে শারীরিকভাবে অসুস্থ করে ফেলতে পারে। অনুভূতি এবং ব্যথার এই সম্পর্কটা বেশ জটিল। মানুষের দর্শন ও শ্রবণের জন্য চোখ ও কান থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্ত একটি নিদিষ্ট অঞ্চল স্নায়ুপথ আছে। এটাতে প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমেই আমরা দেখতে ও শুনতে পাই। কিন্তু ব্যথার এমন নির্দিষ্ট কোনো পথ নেই। দুঃখ-হতাশার কারণে যে পীড়ার সৃষ্টি হয় তার কোনো শারীরিক কারণ নেই। কিন্তু এটা মোটেও শারীরিক পীড়ার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। শারীরিক এবং মানসিক উভয় ব্যথার ফলেই মস্তিষ্কের একই অঞ্চল অর্থাৎ ইনসুলা, থ্যালামাস, অ্যানটেরিয়র সিনগুলেট কর্টেক্স উত্তেজিত হয়।

ইনসুলা, অ্যানটেরিয়র সিনগুলেট।

আবেগ এবং ব্যথার সম্পর্ক বুঝতে পারা খুবই জরুরি। তাহলে সহজেই মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলো দূর করা যাবে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার সমস্যায় আক্রান্ত রোগীর ৭৫ ভাগই বিষণ্ণতায় ভুগছেন। জার্মানির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব মুনিখের অধ্যাপক ফেলিক্স ব্রান্ডল ও তার সহকর্মীরা মিলে একটি গবেষণা পরিচালনা করেন। সেখানে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা এবং বিষণ্ণতায় ভুগছে এমন ৩২০ জনকে বেছে নয় পরীক্ষার জন্য। তাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে দেখা যায়, দুই ধরনের রোগীর মস্তিষ্কে একই ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন: মস্তিষ্কের আকার ছোট হওয়া, মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশের সঙ্গে যুক্ত স্নায়ুর প্যাটার্ন পরিবর্তন হওয়া ইত্যাদি। এটা প্রমাণ করে, দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ও বিষণ্ণতা দুটো সমস্যার জন্যই একই ধরনের নিরাময় পদ্ধতি বের করা সম্ভব।

২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চুং উয়ান য়ু ও তার দল শারীরিক এবং মানসিক ব্যথার স্নায়ুর কার্যক্রমের মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারেন। কয়েকজন ব্যক্তির ওপর একটি পরীক্ষা চালানো হয়। তাদের হাতের ওপর তাপ দেয়া হয় এবং ধীরে ধীরে বাড়ানো হয় তাপ। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, তাপ যতই বাড়ানো হয়, মস্তিষ্কের নিদির্ষ্ট কিছু অঞ্চল ততই সচল হয়। এর নাম দেয়া হয় নিউরোলজিক পেইন সিগনেচার।

পরীক্ষাটি পুনরায় চালানো হয় কিন্তু এবার কোনো তাপ দেয়া হয় না বরং সবাইকে ফোস্‌কা পড়ার মতো গরমের কথা চিন্তা করতে বলা হয়। নিউরোলজিক পেইন সিগনেচার মোটামুটি একই থাকে। কিন্তু সঙ্গে নতুন একটি সিগনেচারের দেখা মেলে। এই দুই পরীক্ষায় পাওয়া নিউরোলজিক পেইন সিগনেচারের মধ্যে তুলনা করার মাধ্যমে শারীরিক এবং মানসিক ব্যথার স্নায়ুর কার্যক্রমের মধ্যে পার্থক্য বোঝা যায়।

২০১১ সালে একদল গবেষক অ্যাসিটামিনোফেন নামে নতুন এক ওষুধ আবিষ্কার করেন। সেটা শারীরিক পীড়া কমানোর পাশাপাশি মানসিক পীড়াও লাঘব করে। ভবিষ্যতে আমরা হয়তো সব ধরনের ব্যথা উপশম করার আরও কার্যকরী উপায় খুঁজে বের করতে পারব।

বি. দ্র.: লেখাটি পূর্বে দৈনিক বাংলা পত্রিকার ইউরেকা পাতায় ছাপা হয়েছিল।

তথ্যসূত্রঃ নিউ সায়েন্টিস্ট

লেখাটি 96-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 904 other subscribers