বইটি কেন পড়বেন

কোভিড ১৯ এ জর্জরিত সারাবিশ্ব। এই মহামারির মধ্যেও কিছু মানুষদের (Covidiot) দেখা যায় রাস্তায় শুধু শুধু ঘোরাঘুরি করতে, প্রায়ই তারা স্বাস্থ্য সচেতন থাকে না। তাদের সচেতন হতে বললে তারা বলে–

“মানুষ একদিন না একদিন মারা যাবে,  

করোনায় আক্রান্ত হলেও মারা যাবে এমনিতেও মারা যাবে। 

ভাগ্যে থাকলে মরণ হবেই [সিদ্ধান্ত]”

তাদের সিদ্ধান্ত হলো ভাগ্যে থাকলে মৃত্যু হবেই। কিন্তু তারা যে যুক্তিতে কথা বলল, তা কি ঠিক? না ঠিক না। তাদের যুক্তিতে ভুল হয়েছে যার নাম “False Analogy”। কেউ কোনো সিদ্ধান্তে আসার জন্য একটা তুলনা করল। অথচ তুলনার সাথে সিদ্ধান্তটা মিলে কিনা বা তুলনাটা কতটুকু সত্য তা না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেওয়াকে “ফলস এনালজি” বলে। 

 যেমন এখানে বলা হয়েছে মানুষ স্বাভাবিকভাবেও মারা যায়, করোনা হলেও মারা যায়। তাই মাস্ক পড়ুক, আর না পড়ুক ভাগ্যে থাকলে মৃত্যু হবে। এখানে সিদ্ধান্তটা ঠিক, ভাগ্যে থাকলে মৃত্যু হয়। 

বইয়ের প্রচ্ছদ।

কিন্তু যুক্তি ঠিক না। কারণ স্বাভাবিক একটা মৃত্যুর কারণে অন্য সবার জীবন ঝুঁকিতে পড়ে না, হয়তো যে মারা যায় তার পারিবারিক সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু সেটা সবার ক্ষেত্রে সমস্যা না। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হলে তার জীবাণুতে আরেকজনের জীবন ঝুঁকিতে পরে।  ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি যেমন মারা যায় তেমনি তার কারণে অন্য আরেকজনেরও মৃত্যু হতে পারে। দুটি পরিবারই সর্বহারা হয়ে যায়। তাই স্বাভাবিক মৃত্যুর সাথে, ভাইরাসজনিত মৃত্যুর তুলনা করা একটা কুযুক্তি। আর এভাবে সবদিক বিবেচনা না করেই একটা ভুল উপমা থেকে সিদ্ধান্ত নিলে যুক্তিতে ভুল থাকে। আর এই ভ্রান্তির নাম “False Analogy”।  

হঠাৎ করে কিছু জায়গায় একটা গুজব ছড়িয়ে ছিল। থানকুনি পাতা খেলে করোনা সেরে যায়। এখানেও যুক্তিতে ভুল হয়েছে। এটাকে বলে “Post Hoc Ergo Propter Hoc”। যার মানে একটা কিছুর পর অপর একটা কিছু হলে, প্রথমটার কারণে পরেরটা হয়েছে ধরে নেওয়া। 

যেমন কেউ থানকুনি পাতা খেল, দেখল কিছুদিন পর তার করোনা সেরে গেছে। এখন সে বলে বেড়ালো থানকুনি পাতার কারণে তার করোনা সেরে গেছে। গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন, প্রতি ৫ জন করোনা রোগীর মধ্যে ৪ জন আপনি আপনি সুস্থ হয়ে যায়। হয়তো এই কারণে লোকটা সুস্থ হয়ে গেছে। কিন্তু সে সার্বিক বিবেচনা না করে আগেরটির কারণে পরেরটা ঘটেছে ধরে নিল। যা “post hoc” এর উদাহরণ। 

বইয়ের লেখক চমক হাসান।

বইটির ভালো দিক

আমরা প্রতিনিয়ত কথা বলার সময়, কখনো নিজেকে বড় করে অন্যকে ছোট করার জন্য, স্বার্থপরের মতো বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে থাকি। যার বেশিরভাগই হয় ভুল যুক্তি। আর এমন ২৪ ধরনের যুক্তির ভ্রান্তি নিয়ে লেখা হয়েছে “যুক্তিফাঁদে ফড়িং” বইটি। বইটির নাম একটু অদ্ভুত মনে হলেও এর নামকরণের প্রেক্ষাপটটা খুবই সুন্দর। কিশোরদের মন ফড়িংয়ের মতো দুরন্ত। তাই তাদের মন যেন ভুলযুক্তির ফাঁদে না পড়ে যায় তাই এর নাম, যুক্তিফাঁদে ফড়িং। 

বইটি অসম্ভব সুন্দর। আমরা প্রতি নিয়ত কুযুক্তি ব্যবহার করি। কিন্তু বুঝতে পারি না আমাদের ভুলগুলো। এই বইটা সেই ভ্রান্তি দূর করবে। আমরা বলি যুক্তি আর বিবেক (ক্ষেত্র বিশেষে আবেগ) বিপরীত জিনিস। কিন্তু বইটা পড়লে সেই ভ্রান্ত ধারণাও কেঁটে যাবে। আমরা আমাদের আবেগ দিয়ে বুঝতে পারি অপ্রাসঙ্গিক কাউকে আক্রমণ করতে নেই। যুক্তিও আমাদের তাই শিক্ষা দেয়। যুক্তি শিক্ষায় একটা মানুষকে ছোট করার জন্য কুযুক্তি দিতে নেই। আমাদের বিবেকও তাই বলে। কিন্তু মানুষের একটা প্রবনতা হলো কোনো কিছুর অপব্যবহার করা। তাই আমরা প্রায় সময়ই আবেগের অপব্যবহার করি, তাই আমাদের যুক্তিতেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। আর এইসব ভ্রান্তির বদলে যুক্তির সঠিক প্রয়োগ শিখানো হয়েছে বইতে।

এই বইতে শুধু যে যুক্তির ভুল উঠে এসেছে তা না। এখানে লেখকের সৃজনশীলতাও বহুবার লক্ষ্য করা গেছে। বিভিন্ন বিদেশী শব্দকে বাংলা ভাষায় রূপ দিয়ে তিনি সেই সৃজনশীলতা প্রকাশ করেছেন। যা খুব সহজ কাজ নয়! আর এই কাজটা করার জন্য বেশিভাগ সময় তিনি ভাবগত দিকটা প্রাধান্য দিয়েছেন। যা এক কথায় অনবদ্য। আর আরেকটা জিনিস ভালো লেগেছে সেটা হলো উদাহরণ। একটা উদাহরণ বলা যায়– 

“শিশুদের মন কাঁদামাটির মতো নরম। মাটি যেমন পুড়িয়ে ইট বানাতে হয়। তাই শিশুদের মনে একটু কষ্ট দিলে পাপ হয় না।” 

এই কুযুক্তি বুঝাতে গিয়ে তিনি একটা কথা বলেছেন, “কাঁদামাটি যেমন বিভিন্ন আকার দেওয়া যায়। তেমনি শিশুদের মনকে শিখিয়ে পড়িয়ে নানা আকার দেওয়া যায়”

অনেক সুন্দর একটা উপমা!

বইটা যে কারণে অনেক প্রিয় তা হলো, যেসব জিনিস আগে আমি বুঝতাম ভুল, কিন্তু অন্যদের বলতে পারতাম না।এখন এই যুক্তির ভ্রান্তি পড়ে আমি অন্যদের তা বুঝাতে পারছি। এছাড়াও ভ্রান্তিগুলোর নামকরণ করার প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনাও খুব সুন্দর লেগেছে। 

সমালোচনা

এবার কিছু অতৃপ্তির কথা বলা যাক। বইটি যেহেতু যুক্তি নিয়ে লেখা তাই “যুক্তি কি, কিভাবে এলো, যুক্তির ভিত্তি” তা নিয়ে আরও বিস্তারিত লেখা হলে বইটা পুরোপুরি পরিপূর্ণতা পেত। পড়ার সময় এই বিষয়টার খুব অভাব অনুভব করেছি। কিন্তু সবমিলিয়ে বাংলা ভাষায় এমন একটা বই আসলেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যার জন্য বইয়ের সব পাঠক (আমিও) লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞ!

বইয়ের নামঃ যুক্তিফাঁদে ফড়িং 

লেখকঃ চমক হাসান

আলোচকঃ ওয়াহিদুর রহমান মোহিন 

পার্সোনাল রেটিংঃ ৮.৫/১০

লেখাটি 175-বার পড়া হয়েছে।

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।