সময়িন্দ্রজাল প্রকৃতির ভয়াল এক রহস্যের গল্প। প্রকৃতি চায় না এই গল্প ফাঁস হোক, তাই যারাই এই গল্প সম্পর্কে জেনেছে তাদের উপরই নেমে এসেছে প্রকৃতির ভয়াল থাবা।
সময়টা ১৯৯৭। সান জুয়ানের রাডার থেকে মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল ফ্লাইট এস.জে ১৩। আকাশপথে বিপদের সম্মুখীন হলে প্লেনটা অবশ্যই পুয়ের্তো রিকোর কন্ট্রোল টাওয়ারের সাথে যোগাযোগ করত। নিকটবর্তী অন্য প্লেনকেও আসন্ন সমস্যার কথা জানাতে পারত। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এমন কিছুই ঘটেনি প্লেনটার ভাগ্যে। বাতাস কেটে কর্পূরের মতো উবে গেছে এস.জে. ১৩। সুবিশাল প্রকৃতির কোন অদ্ভুত রহস্যের জালে জড়িয়ে পড়েছে প্লেনটা, কেউ জানে না। কেউ খবর রাখে না। এদিকে এস.জে ১৩ প্লেনের যাত্রীদের গন্তব্য ছিল কানাডার মন্ট্রিলে। অথচ যান্ত্রিক ফড়িংটার হেডিং ইন্ডিকেটর নির্দেশ করছিল সম্পূর্ণ ভিন্নধারার এক জায়গা। নিযুক্ত পাইলট, স্কট কিন্তু প্লেনের যাত্রাপথ পরিবর্তন করেনি। কো-পাইলট, জ্যাক আর সেকেন্ড অফিসার, বেনিটাও প্লেনের কোর্স পরিবর্তনের ব্যাপারে অজ্ঞ। তাহলে পাইলটের নির্দেশ অমান্য করে কোন রহস্যজনক উপায়ে নির্ধারিত গন্তব্যের পথ থেকে সরে এসেছে এস.জে ১৩?
তাছাড়া কানাডা থেকে অনেক দূরে, সম্ভাব্য নতুন গন্তব্যে এসে এস.জে. ১৩ প্লেনের যাত্রীদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরেকটা নতুন ধাক্কা। দীর্ঘ ৩৭ বছরের টাইমজাম্পের ধাক্কা! কিছুটা অদ্ভুত ঠেকলেও, ততক্ষণে টাইম ট্রাভেলের বিতর্কিত তত্ত্বটার বাস্তব রূপায়ণ দেখে ফেলেছে আলোচিত প্লেনের সমস্ত যাত্রী। কিন্তু সময়িন্দ্রজালের ঘোর কাটতে না কাটতেই প্রকৃতি যেন নতুন নতুন বাজি ছুঁড়ে দিল। শুরু হয়ে গেল দানশীল প্রকৃতির প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠার গল্প।
বাহারি বিস্ময়ের পসরা সাজিয়ে বিমোহিত করার কাজে প্রকৃতির জুড়ি মেলা ভার। চমকপ্রদ তার সৃষ্টি, অপার তার দান। নিখাঁদ মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ তার অফুরন্ত সম্পদের ভাণ্ডার। কিন্তু প্রকৃতি কি কেবলই সৌন্দর্যমণ্ডিত, স্বস্তিদায়ক একটি সত্ত্বা? নাকি মুগ্ধতার আড়ালে কলকাঠি নাড়ছে ভয়ঙ্কর কিছু রহস্য? যে রহস্যের নেই কোনো যৌক্তিক ব্যাখা। নেই কোনো সমাধান। কে জানে, হয়তো এমনই এক ব্যাখাতীত সত্ত্বার পানে ছুটে গিয়েছিল আলোচিত উপন্যাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলিমেন্ট, ফ্লাইট এস.জে. ১৩। উন্মোচিত করেছিল বিচিত্র প্রকৃতির লুক্কায়িত রহস্য। আর রহস্যের উন্মোচন হবে অথচ প্রকৃতির তরফ থেকে কোনো বাঁধা আসবে না- আদৌ কি তা সম্ভব? আবহমান কাল ধরে আগলে রাখা রহস্যের চাদরে যখন চিড় ধরে, অবমুক্ত হয়ে যায় লুক্কায়িত ভবিষ্যতের স্বরূপ; তখন স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখার জন্য প্রকৃতিও প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠে। আর প্রকৃতির প্রতিশোধ যে কী পরিমাণ ভয়াবহ হতে পারে, তা আলোচিত উপন্যাসের অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটা দিক।
শুরুটা হয়েছিল সময়িন্দ্রজালে আটকে যাবার মধ্য দিয়ে। প্রকৃতপক্ষে মন্ট্রিল অভিযানের ইতি ঘটলেও সময়ের গোলকধাঁধায় ভ্রমণের কোনো শেষ ছিল না এস.জে. ১৩ প্লেনের যাত্রীদের। প্রত্যেক টেক অফে দুঃসময়ের কালো মেঘ ঘিরে ধরত প্লেনটাকে। টাইম লুপে প্রবেশের সাথে সাথেই বদলে যেত স্থান। পাল্টে যেত সময়। আর যাত্রীদের ভাগ্যে জুটত বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। কইম্ব্রার পুলিশ স্কোয়াড, পামিউতের মেরু ভালুকের পাশাপাশি ভবিষ্যতের পৃথিবীটাকে এক ঝলক দেখার অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতার গল্পগুলো একদিকে যেমন রোমাঞ্চকর, অন্যদিকে অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় মোড়ানো। সাইফাই ধাঁচে লেখা থ্রিলারধর্মী এই বইয়ের মূল ভিত্তি হিসেবে বেশ পুরনো একটা আরবান মিথের প্রসঙ্গ উঠে আসে। লেখক মূলত ❝রিডল অফ ফ্লাইট ৯১৪❞ শিরোনামের সুপরিচিত সেই মিথের ফিকশনাল একটা রূপায়ণ করেছেন সময়িন্দ্রজাল উপন্যাসে। কাহিনির প্লট যথেষ্ট চমকপ্রদ, স্কট কিংবা অ্যানার মতো চরিত্রগুলোর সফল প্রয়োগ সেখানে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে।
আর সময়িন্দ্রজালের মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে একটি প্লেনকে কেন্দ্র করে। এস.জে ১৩ নামের এই প্লেনের রহস্যময় অন্তর্ধান এবং তার পরবর্তী প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় পুরো বই জুড়ে। সেক্ষেত্রে পাইলট, স্কট নিঃসন্দেহে বইয়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য চরিত্র। লেখক তাকে বেশ যত্নের সাথেই গড়ে তুলেছেন বলা যায়। কারণ স্কট একদিকে যেমন ঘৃণ্য খুনি, অন্যদিকে পরম শ্রদ্ধার পাত্র- বীর। জ্যাকের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটবে। একগুঁয়ে, বদমেজাজী স্বভাবের কো-পাইলট, জ্যাককে কেউ তেমন পছন্দ করত না। কিন্তু জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে মানবিকতার যে চূড়ান্ত স্বরূপ দেখিয়ে গিয়েছে জ্যাক, তা সবসময় সবার হৃদয়ে গেঁথে থাকবে। রিভেরা, হেইলি কিংবা হেনরির মতো চরিত্রগুলোও সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে সময়িন্দ্রজালের এই অভিযানে উইলিয়ামের ভূমিকা ছিল চোখে পড়ার মতো। তার সাহায্য ছাড়া কিছুই সম্ভব হত না। প্রখর বুদ্ধিমত্তা ও অসাধারণ দূরদর্শিতার কারণে উইলিয়ামকে কমবেশি সবাই পছন্দ করবে।
সময়িন্দ্রজাল উপন্যাসের বর্ণনাশৈলীর ক্ষেত্রে একাধিক পুরুষ প্রয়োগের ব্যাপারটা ছিল খানিকটা দুর্বোধ্য। তবে কাহিনি যত সামনের দিকে এগিয়েছে, ভাষার জটিলতা তত কমে এসেছে। বীভৎস কিছু দৃশ্যের বর্ণনা ছিল রীতিমতো ভয়াবহ। বইয়ের অ্যাকশন সিকোয়েন্সগুলো লেখক বেশ চমৎকারভাবে টেনেছেন। তাছাড়া রিসার্চের পরিমাণও যথেষ্ট ভালো। প্লেন উড্ডয়নের দৃশ্যগুলোর সফল চিত্রায়ণ তার প্রমাণ দেয়।
সাইফাই জনরার বই হিসেবে সময়িন্দ্রজালকে বেশ ভালো একটা প্রচেষ্টা বলা যায়। বিজ্ঞানের ভারী ভারী বিশ্লেষণের কারণে যারা এ ধরনের বই এড়িয়ে চলেন, তারা চাইলে এই বইটিকে নির্দ্বিধায় বেছে নিতে পারেন। কারণ বিশ্লেষণের তুলনায় গল্পটাই এখানে মূল উপজীব্য হিসেবে অভিহিত হয়েছে। যেখানে উঠে এসেছে অদ্ভুত এক সময়িন্দ্রজালের গল্প। চিরচেনা প্রকৃতির প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠার গল্প। তাছাড়া অদ্ভুতুড়ে ধারার অ্যাডভেঞ্চারধর্মী বই যাদের পছন্দ, সময়িন্দ্রজাল পড়তে পারেন তারাও।
বই : সময়িন্দ্রজাল
লেখক : সামসুল ইসলাম রুমি
ধরন : সাইফাই, অ্যাডভেঞ্চার
প্রকাশনী : বাতিঘর প্রকাশনী
Leave a Reply