আমরা নবম-দশম শ্রেণীতে “বস্তুর অবস্থা ও চাপ” অধ্যায় পড়ার সময় হরহামেশা একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। সেটি হলো:
“লোহা ও রাবারের মধ্যে কোনটি বেশি স্থিতিস্থাপক?”
যখন আমরা উক্ত সমস্যার সমাধান করতে বসি অর্থাৎ দুটি পদার্থের মধ্যে কোনটি বেশি স্থিতিস্থাপক নির্ণয় করতে চাই তখন স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মাথায় সর্বপ্রথম রাবারের কথা আসে । কারণ আমরা রাবারকে টানলে সেটাকে পুরোপুরি আগের অবস্থায় ফিরে যেতে দেখি । আবার, আমরা যারা স্থিতিস্থাপকতার গুনাঙ্ক সম্পর্কে জানি তারা প্রথমে হুকের সূত্রের কথা চিন্তা করি।
হুকের সুত্রানুসারে, স্থিতিস্থাপক সীমার ভিতরে কোনো বস্তুর উপর প্রযুক্ত পীড়ন উক্ত বস্তুতে সৃষ্ট বিকৃতির সমানুপাতিক।
অর্থাৎ, পীড়ন ∝ বিকৃতি
বা, পীড়ন = E × বিকৃতি
এ ক্ষেত্রে যে ধ্রুবক E পাওয়া যায় তা হলো স্থিতিস্থাপক গুনাঙ্ক (Modulus of Elasticity)। আমাদের পাঠ্যবই অনুসারে যে বস্তুর স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মান যত বেশি উক্ত বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা তত বেশি। এজন্য আমরা স্থিতিস্থাপকতার গুণাঙ্ক নির্ণয় করি, অতঃপর যার গুণাঙ্ক বেশি তাকে বেশি স্থিতিস্থাপক বলে ঘোষণা করি। এজন্য লোহা, রাবার অপেক্ষা বেশি স্থিতিস্থাপক।[1] এই পদ্ধতি অনুসরণের পিছনে যুক্তিও অটুট। যার স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্কের মান (E) বেশি, তার উপর পীড়ন প্রয়োগে প্রাপ্ত বিকৃতির পরিমাণ কম। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায়। পীড়ন প্রয়োগে বিকৃতি কম হওয়া কি আসলেই স্থিতিস্থাপকতা বেশি হওয়াকে নির্দেশ করে? স্থিতিস্থাপকতার সংজ্ঞা কি আমাদের সেটা বলে?
এবার আসা যাক স্থিতিস্থাপকতার সংজ্ঞায় ;
“কোনো বস্তুতে বাহ্যিক বল প্রয়োগ করে এর আকার অথবা আকৃতির পরিবর্তন ঘটালে বস্তুর যে গুণের জন্য বল অপসারণের পর এটি পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে বা আসতে চায় তাই ঐ বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা। [2]
বিভিন্ন জায়গায় সরলীকরণ করে উক্ত সংজ্ঞার আরেকটি রূপ তুলে ধরা হয়। “কোনো বস্তু বাহ্যিক বলের বিপরীতে যে প্রতিরোধ সৃষ্টি করে তা হলো উক্ত বস্তুর স্থিতিস্থাপকতা।” সরলীকৃত এই সংজ্ঞা অনুসারে, লোহা বেশি স্থিতিস্থাপক। কারণ লোহার নিজস্ব আকৃতি ধরে রাখার সক্ষমতা এবং বাহ্যিক বলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা রাবারের তুলনায় অধিক। কিন্তু সরলীকৃত এই সংজ্ঞা কি স্থিতিস্থাপকতা নির্দেশ করে? নাকি বস্তুর আরেকটি ধর্ম “দৃঢ়তা” (stiffness) নির্দেশ করে?
দৃঢ়তার সংজ্ঞানুসারে কোনো বস্তুর উপর প্রয়োগকৃত বলের বিপরীতে যে প্রতিরোধ সৃষ্টি হয় তাই ঐ বস্তুর দৃঢ়তা। অর্থাৎ, দৃঢ়তা কোনো বস্তুর বিকৃতি প্রতিরোধকারী ধর্মের নাম। আমরা আবার হুকের সূত্রে ফিরে যাই।
পীড়ন = E × বিকৃতি
বা, F/A = E × (ΔX / X)
বা, F = E× A / X × ΔX
বা, F = (E × A/X )×∆X
∴ F = K × ΔX
এখানে, F হলো বাহ্যিক বল।
A হলো পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল।
X হলো আদি অবস্থা।
ΔX হলো অবস্থার পরিবর্তন।
K হলো দৃঢ়তার গুণাঙ্ক।
যেহেতু, K=EA/X; সেহেতু স্থিতিস্থাপকতার গুণাঙ্ক E বৃদ্ধির সাথে সাথে দৃঢ়তার গুণাঙ্ক K ও বৃদ্ধি পায়। ফলে বস্তুর বিকৃতি প্রতিরোধক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়। বস্তুতে সামান্য বিকৃতি ঘটাতে অনেক বেশি পীড়নের প্রয়োজন হয়। বিকৃতি ঘটতে না দেওয়ার এই গুণকে বলে দৃঢ়তা, স্থিতিস্থাপকতা নয়। [3]
তাহলে একটা বিষয় পরিষ্কার যে, আমরা স্থিতিস্থাপক গুণাঙ্ক নির্ণয় করে কখনোই কার স্থিতিস্থাপকতা বেশি বা কার কম সেই মতামত দিতে পারব না। কে অধিক স্থিতিস্থাপক তা নির্ণয়ের জন্য আরেকটি বিষয় জানতে হবে, সেটি হলো স্থিতিস্থাপকতার সীমা। যে সীমা অবদি কোনো বস্তু নিজের বিকৃত অবস্থা হতে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারে তাকে বলে স্থিতিস্থাপকতার সীমা। স্থিতিস্থাপকতার সংজ্ঞা যদি আমরা ভালোভাবে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারবো যে বস্তু যত বেশি বিকৃতি অতিক্রম করতে পারবে সে তত বেশি স্থিতিস্থাপক বলে গণ্য হবে। উদাহরণস্বরুপ, রাবার বলের উপর বল প্রয়োগ করলে তা অনেকখানি সংকুচিত হয় এবং বল অপসারণে পুনরায় আগের অবস্থায় ফিরেও আসে। কিন্তু লোহার বলের উপর বল প্রয়োগে সামান্য পরিবর্তন ঘটালে তা আর আগের অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনা। অর্থাৎ লোহার স্থিতিস্থাপকতার সীমা রাবার অপেক্ষা অনেক কম। যেহেতু রাবার বেশি বিকৃতি পরাস্ত করে নিজের পূর্বের অবস্থায় ফিরতে পারে তাই রাবারই বেশি স্থিতিস্থাপক।
কিছু কিছু মানুষ স্থিতিস্থাপক সংঘর্ষের সাথে বস্তুর উপাদানের স্থিতিস্থাপকতা ঘুলিয়ে ফেলেন। তারা যুক্তি দেন, লোহা লোহার সংঘর্ষে যেহেতু শক্তিক্ষয়ের পরিমাণ রাবারের বলের সংঘর্ষ অপেক্ষা বেশি তাই লোহা অধিক স্থিতিস্থাপক। এই ধারণা ভুল। কোনো সংঘর্ষে শক্তিক্ষয় কম অর্থ হলো এই সংঘর্ষ অধিক স্থিতিস্থাপক, বস্তুর উপাদান নয়। [4]
অনেকে লোহার স্থিতিস্থাপকতা বেশি হওয়ার পিছনে আরেকটি যুক্তি দিতে চান। “স্থিতিস্থাপকতার সংজ্ঞা অনুযায়ী বাইরে থেকে কোনো বল প্রয়োগের পরে কোনো বস্তু যত তাড়াতাড়ি তার পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসে তাকে স্থিতিস্থাপকতা বলে। রাবার ও লোহার মধ্যে লোহা বল প্রয়োগের পরে রাবারের চেয়ে দ্রুত তাঁর পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। এই জন্য লোহা রবারের চেয়ে বেশী স্থিতিস্থাপক।” এই যুক্তি কোনোদিক থেকে গ্রহণযোগ্য না। প্রথমত, স্থিতিস্থাপকতা বেশি কম হওয়ার সাথে সময়ের কোনো সম্পর্ক নেই। তাড়াতাড়ি আগের অবস্থায় ফিরুক কিংবা দেরীতে, কিছুই যায় আসেনা। দ্বিতীয়ত, বিকৃতি ঘটালে লোহা মোটেও তাড়াতাড়ি আগের অবস্থায় ফিরে না, বরং লোহার বিকৃতি স্থায়ী হয়ে থাকে, রাবার ফিরে আসে।
উপর্যুক্ত আলোচনা হতে কী সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি?
i) প্রচলিত অর্থে আমরা যেটাকে স্থিতিস্থাপকতা বলি সেটা মুলত দৃঢ়তা। লোহার বিকৃতি ঘটাতে বেশি বল লাগে মানে এর দৃঢ়তা বেশি।
ii) কোন বস্তু স্থিতিস্থাপক তা জানতে অবশ্যই স্থিতিস্থাপকতার সীমা বিবেচনায় আনতে হবে।
iii) স্থিতিস্থাপকতার সাথে সময়ের সম্পর্ক নাই। স্থিতিস্থাপক ক্লান্তি বিবেচনায় নিলেও সেটা স্থিতিস্থাপকতার সীমা হ্রাস করে, এখানেও সময়ের ভূমিকা নেই।
সুতরাং শেষ সিদ্ধান্ত এই যে, রাবারের স্থিতিস্থাপকতা লোহা অপেক্ষা বেশি আর লোহার দৃঢ়তা রাবার অপেক্ষা বেশি।
তথ্যসূত্র:
[1] নবম-দ্বাদশ শ্রেণীর যেকোনো পদার্থবিজ্ঞান বই (২০২২-২৩)।[2] “Elasticity is the ability of a deformed material body to return to its original shape and size when the forces causing the deformation are removed.” – Britannica
[3] Strength of Materials, Andrew Pytel, F.L. Singer
[4] Physics stackexchange, question number 397576
Leave a Reply