ভাইরাস, এই ক্ষুদ্র জিনিসটার সাথে পুরো মানবজাতি অঙ্গা-অঙ্গি জড়িত। যে পৃথিবীতে আমরা বিদ্যমান আছি, এই থাকার পেছনে মূল্যবান অবদান তাদের। আবার সময়ে সময়ে দুরারোগ্য ব্যাধি ও মহামারীর মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষের দুঃখ, লক্ষ লক্ষ পরিবারের কান্নার কারণও তারা। এরা যেমন রোগ বাধায় তেমনই দেহকে রোগ থেকে বাঁচায়ও।
জগতে এমন কোনো প্রাণী নেই যাদের শরীরে তাদের বসবাস নেই। দুনিয়ার এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে তাদের অস্তিত্ব নেই। সাগরের তলদেশ কি আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তর, হাজার বছরের জমাট বরফ কি দূর মহাকাশ- সবখানেই তাদের উপস্থিতি। মানুষের অন্ত্রে কি যন্ত্রে, মগজে কি রক্তে সবখানেই তাদের পদচারণা।
এদের জগৎটা এত বিশাল যে, কল্পনাও করা যায় না। তার উপর এরা এতই ক্ষুদ্র যে এদেরকে চোখেও দেখা যায় না। এই বিশাল জগৎ সম্বন্ধে পাঠককে ধারণা দেওয়া সহজ কথা নয়। কিন্তু এই কাজটি করেছেন মার্কিন বিজ্ঞান লেখক কার্ল জিমার। তিনি অনেকদিন ধরে জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দারুণ দারুণ বই ও সুন্দর সুন্দর প্রবন্ধ লিখছেন। কোনো বিষয়কে তিনি এত সুন্দর করে উপস্থাপন করেন যে পড়লে মনে হয় এটা একটা আর্টপিস। ভাইরাস নিয়ে তার লেখা ছোট বই A Planet of Virusesও তেমন একটি কাজ। বইটিতে তিনি ভাইরাসকে এত সুন্দর করে উপস্থাপন করেছেন যে, পড়তে তো কোনো বেগ পেতে হয়ই না বরং আনন্দ হয়, ইচ্ছে হয় উনার অন্যান্য বইগুলোও পড়ে ফেলার।
চমৎকার এই বইটির অত্যন্ত চমৎকার অনুবাদ করেছেন সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ। তিনি নিজেও অণুজীববিজ্ঞানের ছাত্র। অনেকদিন ধরেই লিখছেন বিজ্ঞান ব্লগ, জিরো টু ইনফিনিটি ম্যাগাজিন, রোর বাংলা সহ অন্যান্য মাধ্যমে। খুবই সুন্দর লিখেন, তার লেখা মাত্রই উপভোগ্য। তার করা এই অনুবাদটিও দারুণ। পড়ার সময় মনে হচ্ছিল, মূল বইটি পড়লেও হয়তো এত সুন্দর উপভোগ করতে পারব না। পড়া শেষে খুব তৃপ্তি পেয়েছি, বেশ সুন্দর একটা বই পড়া হলো।
বইয়ের আলোচনার ধরনটা বেশ সোজা। পরিচিত ও গুরুত্বপূর্ণ কিছু কিছু ভাইরাসকে নিয়ে অধ্যায়ভিত্তিক আলোচনা। একেকটি ভাইরাস নিয়ে একেকটি অধ্যায়। আলোচনা এমন পথ ধরে এগোয়নি যার কারণে তা জনবোধ্য হবে না। বিজ্ঞানে আগ্রহ আছে এমন যেকোনো পাঠক, যার সাধারণ কিছু বিষয় যেমন ডিএনএ, জিন, এন্টিবডি ইত্যাদি সম্পর্কে ধারণা আছে সে মাত্রই বইটির আলোচনার শ্রোতা হতে পারবে।
বইয়ের আলোচনায় প্রবেশ করলে চোখের সামনে ভেসে উঠবে ভাইরাসের অদৃশ্য জগৎ। রান্নাঘরের মামুলি শাকের পাতায় থাকা ফুটফুটে দাগগুলোকে আর নেহাত দাগ বলে মনে হবে না, মনে হবে পাতার মাঝে ঘটে চলছে বিশাল যজ্ঞ। যেমনটা অনুবাদক তার ভূমিকায় বলেছেন-
“আমরা …ক্ষুদ্র জগতের বাসিন্দাদের সম্বন্ধে খুব একটা মাথা ঘামাই না। সেই ক্ষুদ্র জগতের অন্যতম মহারথী হলো ভাইরাস। ভাইরাসের সেই পৃথিবী আমাদের সচরাচর পৃথিবীর চেয়ে কম বৈচিত্র্যের নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে তা আরও বেশি রোমাঞ্চকর। ভাইরাসের পৃথিবীর সীমানা নির্ধারণ করা আসলেই খুব কঠিন কাজ। কোথায় নেই সে! সমুদ্রে গভীর তলদেশ থেকে শুরু করে মানুষের শরীর সব জায়গাতেই তার রাজত্ব। কিছু কিছু ভাইরাস হয়েছে আমাদের শরীরে স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের জিনোমেও তারা যোগ হয়ে এক হয়ে গিয়েছে আমাদের সাথে। তাই মানুষসহ সব জীবের সাথে ভাইরাসের সম্পর্ক খুব গভীর।”
সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ বই নিয়ে আরো কাজ করুক। কার্ল জিমারের অন্যান্য বইগুলোও বাংলাভাষী পাঠকের জন্য অনুবাদ করুক এই আশা রইলো।
করোনাভাইরাসের মহামারি পার করেছি আমরা। ভাইরাস নিয়ে মানুষের আলাদা আগ্রহ জন্মেছে। বাংলাভাষী পাঠকের জন্য সেই আগ্রহের খোঁড়াক হতে পারে সহজ-সুন্দর ভাষায় লেখা এই বইটি।
বই: ভাইরাসের পৃথিবী (A Planet of Viruses) || লেখক: কার্ল জিমার || রূপান্তর: সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ || প্রকাশক: প্রকৃতি-পরিচয় || প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০১৭ || পৃষ্ঠা: ১১৯ || মূল্য: ১৫০ টাকা
Leave a Reply