অতীতে খাবারের স্বাদ কি অনেক ভালো ছিল?

বাসা-বাড়িতে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে কিংবা চায়ের দোকানের আড্ডায় আমাদের অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগে- পুরনো দিনের খাবারের স্বাদই কি বরং ভালো ছিল? আড্ডার সবচেয়ে বয়স্ক ব্যক্তিটি তো আরেক কাঠি সরেস,”এখনকার খাবারে কি আর স্বাদ আছে নাকি?” তবে বাস্তবিক অর্থে নূতন-পুরাতনের এ লড়াইয়ের সমাধান করা বেশ দুরূহ ব্যাপারই বটে! চাইলেই তো আর ৫০ বছর আগের কোনো ফলের দোকানের ফলের স্বাদ ও বর্তমানে সুপার মার্কেটের কোনো ফলের স্বাদ মিলিয়ে দেখা সম্ভব না। যদি এটি করা সম্ভবও হয়,তবু অতীতের ফলটিই যে সুস্বাদু- এ বিষয়েও হয়তো সকলে একমত হবেন না! 

আমরা সাধারণত পাঁচ ধরনের স্বাদ অনুভব করতে পারি। এগুলো হলো- মিষ্টি, টক, তেতো, নোনতা এবং উমামি। জিহ্বায় অবস্থিত নির্দিষ্ট কিছু স্বাদকোরক বা স্বাদকুঁড়ির জন্যই আমরা ভিন্ন ভিন্ন খাবারের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ পেয়ে থাকি। আমরা খাবার খেলে খাবারের স্বাদ নির্দিষ্ট স্বাদকোরক থেকে স্নায়ুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের স্বাদ কেন্দ্রে পৌঁছায়। ফলে আমরা স্বাদটি অনুভব করি।

খাবারের স্বাদ অনেকাংশেই ব্যক্তিনির্ভর

এক জনের খুবই পছন্দের একটি খাবার আরেকজনের কাছে একদমই অপছন্দের হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না! খাবারের স্বাদ তাই অনেকাংশেই ব্যক্তিনির্ভর। ব্যক্তির স্বাস্থ্যগত অবস্থা,মানসিক স্বাস্থ্য কিংবা জিনগত নানা বিষয় খাবারের স্বাদকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। অনেকেই দেখা যায় তেতো খাবারের প্রতি বেশ সংবেদনশীল। ফলে দেখা যায় একটু তেতো খাবারও তাদের কাছে অখাদ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। আর এই তেতো খাবারের প্রতি তাদের সংবেদনশীলতার নেপথ্যে জিনগত একটি কারণ লুকিয়ে আছে। TAS2R38 জিনের উপস্থিতির জন্যই ব্যক্তি তেতো স্বাদের প্রতি বেশি মাত্রায় সংবেদনশীল হয়ে থাকেন। 

একদম শৈশবে বাচ্চাদের পুরো মুখ গহ্বরে ৩০,০০০ এর কাছাকাছি স্বাদকোরক থাকে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে এসব স্বাদকোরকের সংখ্যা কমতে থাকে। শেষমেশ পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় শৈশবের এক তৃতীয়াংশ স্বাদকোরক অবশিষ্ট থাকে, যার অধিকাংশই থাকে শুধু জিহ্বায়। স্বাদকোরকের এ সংখ্যা হ্রাস শৈশব ও পূর্ণবয়স্ক অবস্থায় স্বাদ অনুভবে বিস্তর ব্যবধান তৈরি করে দেয়। 

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়- গর্ভাবস্থায় মায়ের গৃহীত খাবারের স্বাদ ভ্রূণে একেক রকম মুখাবয়বের উদ্ভব ঘটায়! ৩২ থেকে ৩৬ সপ্তাহের গর্ভবতী মায়েদের উপর গবেষণায় এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। এখানে প্রত্যেক মাকে একটি গাজর ও বাঁধাকপির স্বাদযুক্ত ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। এরপরে ভ্রূণের মুখমণ্ডলের নড়াচড়া রেকর্ড করা হয়। এখানে গাজরের স্বাদযুক্ত ক্যাপসুল খাওয়ার পরে ভ্রূণের হাসিমাখা মুখায়ব দেখা যায়, অন্যদিকে বাঁধাকপির ক্ষেত্রে দেখা যায় ভ্রূণের কান্নারত মুখায়ব!

বামে ভ্রূণের হাসিমাখা মুখাবয়ব ও ডানে কান্নারত মুখাবয়ব!

আবার বয়ঃসন্ধিতে শৈশবের মিষ্টি স্বাদের প্রাধান্যতাকে ভুলে একটু তিক্ত স্বাদের সন্ধানে চা, কফির মুগ্ধতায় ধরা দিতে শুরু করে কেউ কেউ। এভাবে খাবার উপভোগের প্রতি আমাদের উপলব্ধির প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু পরিবর্তন হচ্ছে। 

ব্যক্তিভেদে স্বাদের এ ভিন্নতায় হরমোনের নীরব ভূমিকার কথাও জানা যায়। ২০০৯ সালে একটি গবেষণায় দেখা যায়- মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় মিষ্টি ও টক স্বাদের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। অর্থাৎ মেয়েদের সমপরিমাণ মিষ্টি ও টক স্বাদ অনুভব করতে ছেলেদের খাবারে মিষ্টি ও টক স্বাদের পরিমাণ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। ব্যক্তির মানসিক অবস্থাও অনেক সময় খাবারের স্বাদে পার্থক্য তৈরি করে দেয়। ২০১৫ সালে Appetite জার্নালের এক গবেষণায় খাবারের স্বাদের সাথে মানসিক অবস্থার সংশ্লিষ্টতার একটা প্রমাণ পাওয়া যায়। হকি খেলার এক মৌসুমে ৪টি জেতা,২ টি হেরে যাওয়া ও ১ টি ড্র হওয়া খেলার সাক্ষী হওয়া ৫৫০ জনের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এখানে দেখা যায়- খেলার সময় ব্যক্তির মানসিক প্রফুল্লতা মিষ্টি স্বাদের প্রতি আগ্রহকে বাড়িয়ে দেয় ও পাশাপাশি টক স্বাদের প্রতি আগ্রহকে কমিয়ে দেয়! অন্যদিকে, খেলার সময় মানসিক বিষণ্ণতা উলটো টক স্বাদের প্রতি আগ্রহকে বাড়িয়ে দেয়। 

খাবারের গুণাগুণ: অতীত বনাম বর্তমান

বিগত ৫০ বছরে খাবার উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ব্যক্তিভেদে খাবারের স্বাদের ভিন্নতার পাশাপাশি তাই সত্যিকার অর্থে খাবারের গুণগত মানেও বেশ পরিবর্তন হয়েছে,যার ফলে খাবারের স্বাদেও এসেছে ভিন্নতা।

 খাবারের স্বাদ মানুষের উপলব্ধির এক জটিল ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফসল। আমরা মুখ দিয়ে যা উপলব্ধি করি তাই ‘স্বাদ’ নয়! বরং আমরা জিহ্বা দিয়ে যা অনুভব করি,নাক দিয়ে যা গন্ধ নেই,আর চোখ দিয়ে খাবারের যে অবস্থা অবলোকন করি তার সম্মিলিত রূপই একটি খাবারের ‘স্বাদ’ নির্ধারণ করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৮০ সালের একটি স্বাদ গবেষণায় দেখা যায়- কোমল পানীয় খেয়েও চোখ বাধা অবস্থায় সেটিকে শনাক্ত করতে পারেননি অনেকেই। অথচ যখন তাদের দেখতে দেয়া হয়েছে যে, তারা কি খাচ্ছেন, তখন তারা সহজেই সেটি শনাক্ত করে ফেলেছেন। একটি লেবু স্বাদের পানীয় কমলা রঙে পাল্টে ফেলার পর ৫০ শতাংশ অংশগ্রহণকারী ভাবছিলেন- এটা কমলা স্বাদের পানীয়। কিন্তু একই পানীয় স্বাদ অক্ষুণ্ণ রেখে যখন শুধু রং পাল্টে সবুজ রঙ করে ফেলা হয়, তখন সেই স্বাদ অংশগ্রহণকারীদের কেউ আর তা শনাক্ত করতে পারেননি। খাবার উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের ফলে বিগত কয়েক দশকে স্বাদের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনকে বুঝতে টমেটো হতে পারে একটি আদর্শ উদাহরণ। বিশ্বব্যাপী সবসময়ই সবজি হিসেবে টমেটোর তুমুল জনপ্রিয়তা ছিল। টমেটোর স্বাদ নির্ধারণ করে এক ধরণের এসিড ও চিনিজাতীয় পদার্থ যা আমাদের স্বাদকোরকে অনুভূতি জাগায় এবং কয়েক ধরণের উদ্বায়ী পদার্থ যা আমাদের নাকের গন্ধ সংবেদী কোষে উদ্দীপনা দেয়। এভাবে নাক ও জিহ্বার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি টমেটোর পরিপূর্ণ স্বাদ আমরা পেয়ে থাকি। সময়ের পরিক্রমায় বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করেন- টমেটোর ঐসব উদ্বায়ী পদার্থই এর স্বাদকে অনেকাংশে বৃদ্ধি করে।

বর্তমানে টমেটো উৎপাদনের সময় উৎপাদন স্থল থেকে এর পরিবহনের বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হয়। দীর্ঘপথের যাত্রায় গাড়িতে যাতে এটি অল্পেই নষ্ট না হয়ে যায়  এজন্য সেভাবেই এর জেনেটিক পরিবর্তন করা হয়। ২০১৭ সালে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়- এভাবে টমেটোর জেনেটিক পরিবর্তনের ফলে এর উদ্বায়ী পদার্থের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কমে যায়। ফলে টমেটোর যে স্বতন্ত্র এক স্বাদ তা আমরা আর পুরোপুরি পাই না। এভাবে টমেটোর মতোই বর্তমানে বেশিরভাগ খাবার উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণে আধুনিক চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর মানে পুরনো দিনের খাবারের স্বাদেও কিছু না কিছু পরিবর্তনও হচ্ছে! খাবারের স্বাদের জটিল রহস্যের নেপথ্যে তাই একদিকে যেমন ব্যক্তিনির্ভরতা প্রাধান্য পায়,অন্যদিকে এর সাথে যুক্ত নানা বিষয়ও প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এভাবে বয়স কিংবা সময়ের পরিক্রমায় আমরা বেছে নেই সেই স্বাদ যা আমাদের পরিতৃপ্তি দেয়!

তথ্যসূত্রঃ

লেখাটি 228-বার পড়া হয়েছে।


আলোচনা

Responses

  1. Dhonnobad apnake….onk kisu janlam.

    1. আগ্রহ নিয়ে লেখাটি পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ! লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে পারেন!

  2. ধন্যবাদ ভাই💖

Leave a Reply

ই-মেইলে গ্রাহক হয়ে যান

আপনার ই-মেইলে চলে যাবে নতুন প্রকাশিত লেখার খবর। দৈনিকের বদলে সাপ্তাহিক বা মাসিক ডাইজেস্ট হিসেবেও পরিবর্তন করতে পারেন সাবস্ক্রাইবের পর ।

Join 897 other subscribers