আমরা প্রতিদিন অজস্র ছবি ও ভিডিও দেখছি। দেখতে খুবই রঙিন ও সুন্দর দেখাচ্ছে। একদম আপনার চোখ যেভাবে বস্তুটিকে দেখতে পাচ্ছে, ক্যামেরায় তোলা ছবিটিতেও বস্তুটির রঙ সেটিই দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কখনও নিজেকে প্রশ্ন করেছেন কি, ক্যামেরা আসলে কীভাবে এসব ছবি তোলে? জানতে হলে আমাদের শুরু করতে হবে সেই মধ্যযুগের ছবির ইতিহাস থেকে।
কিতাব আল মানাজির দিয়ে শুরু
সময়টা তখন ১১ শতক, মধ্যযুগের মিশর। প্রতিবছর একটা সময় পরপর নীল নদের পানির উচ্চতা অনেক বেড়ে যায়। আশেপাশের পুরো এলাকায় বন্যা হয়। অনেক মানুষের জীবন ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তাই মিশরের বাদশাহ চাচ্ছিলেন নীল নদের ঠিক সাথেই যদি একটি বাধ তৈরি করা যায় তাহলে পানির এই অস্বাভাবিক গতিকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, এই বাধ তৈরির কাজটা কেউই হাতে নিতে চাচ্ছেন না। সবার মতে, নীল নদকে বাধ দিয়ে আটকানো সম্ভব না। তবে কেউ কেউ বাদশাহকে বললেন, এ কাজ যদি কেউ করতে পারে তাহলে তা করতে পারবেন বসরার ইবন আল হাইসাম। বাদশাহ শেষমেষ সেই সূদুর ইরাক থেকে ইবন আল হাইসামকে ডেকে পাঠালেন।
ততদিনে বিজ্ঞানের পণ্ডিত হিসেবে ইবন আল হাইসামের বেশ নাম জুড়ে গেছে। ইবন আল হাইসাম বাদশাহর ডাকে সারা দিয়ে মিশরে আসলেন। বাদশাহ তাকে সমস্যার ব্যাপারে জানালেন। ইবন আল হাইসাম বাদশাহর কথায় রাজি হলেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও ইবন আল হাইসাম বাদশাহর কথা অনুযায়ী একটি বাধ তৈরি করতে সমর্থ হলেন না। তিনি বাদশাহকে এক পর্যায়ে জানান, নীল নদের উপরে বাধ তৈরি করা তার জন্য সম্ভব না। কথাটিতে বাদশাহ বেশ ক্ষিপ্ত হন এবং তাকে শাস্তি দেওয়ার কথা জানান। ইবন আল হাইসাম বাদশাহ-র এই রাগ থেকে বাঁচতে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো আচরণ শুরু করেন। ইসলামি আইন অনুসারে পাগলকে কোনো প্রকার শাস্তি দেওয়া হয় না। তাই ইবন আল হায়সামকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো না। তবে তাকে একটি অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখা হলো। আর এই অন্ধকার কক্ষেই ইবন আল হায়সাম লিখলেন তার বিখ্যাত আবিষ্কারের বই কিতাব আল মানাজির (Book of Optics)।
অন্ধকার ঘরের ক্যামেরা
অন্ধকার একটি কক্ষ। এই কক্ষেই রাখা হয়েছে ইবন হায়সামকে। কক্ষের একপাশের দেয়ালে একটি ছোট ছিদ্র। এই ছিদ্র দিয়েই ঢুকছে বাইরের আলো। এখানে খুব মজার একটি বিষয় দেখা যায়। এই ছোট ছিদ্রর মধ্য দিয়ে যত আলো ঢুকছে তা দেয়ালের অপর পাশে বাইরের জগতের প্রতিচ্ছবি তৈরি করছে। একে বলা হয় পিনহোল ক্যামেরা। অন্ধকার কোনো একটি বাক্সের মধ্যে ছোট একটি ছিদ্র করে দিয়ে আপনিও বাক্সের ভিতরের একটি দেয়ালে এমন প্রতিচ্ছবি তৈরি করতে পারেন। অন্ধকার একটি কক্ষে এটি তৈরি করা হয়েছিল বলে এই ছবি তোলার পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ‘ক্যামেরা অবস্কিউরা’ বা ‘অন্ধকার কক্ষ’। ক্যামেরা শব্দটি আরবি ‘আল-কামরা’ বা কক্ষ শব্দের ল্যাটিনকৃত নাম।
পিনহোল ক্যামেরা নিয়ে হাসান ইবন হায়সামের আগেও কেউ কেউ কাজ করেছেন বলে কিছু প্রমানাদি রয়েছে। চোখকে সুরক্ষিত রেখে সূর্যগ্রহণ দেখার জন্য কেউ কেউ এমন পিনহোল ক্যামেরা ব্যবহার করতেন বলে জানা যায়। তবে ইবন আল হায়সাম পিনহোল ক্যামেরার বিষয়ে এমন একটি প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসলেন যা এর আগে অন্য কেউ করেনি।
ইবন আল হায়সামের আগ পর্যন্ত সবাই ভাবতেন আমাদের চোখ থেকে আলো কোনো একটা বস্তুতে যায়। এরপর সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে ফেরত আসে। আমাদের চোখে এই আলো ফেরত আসলেই কেবল আমরা ঐ বস্তুটিকে দেখতে পারি। ইবন আল হায়সাম প্রশ্ন করলেন, আমি তো কক্ষের ভিতরে থাকা অবস্থায় বাইরের ঐ বস্তুটিকে দেখতে পারছি না সরাসরি। তাহলে আলোও তো আমার চোখ থেকে তার মধ্যে যাচ্ছে না। তাহলে তা আমি কীভাবে দেখছি। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি তার পূর্বের সকল জ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন। একটা সময় গিয়ে সবাই তার যুক্তি মেনে নেন এবং তার আগের লোকদের মেনে চলা ব্যাখ্যাকে পরিত্যাগ করেন। ইবন আল হায়সামের ব্যাখ্যা ছিল যে, আলো আমাদের চোখ থেকে বস্তুকে যায় না। বরং সূর্যের আলো ঐ বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আমাদের চোখে আসে। কেবল তখনই আমরা বস্তুটিকে দেখতে পারি। যখন সূর্যের আলো থাকে না, তখন বস্তুটিকে আমরা দেখতে পাই না। আর এভাবেই ‘আলোক বিজ্ঞান’-এর জগতের নতুন এক দ্বার উন্মোচন করেন এই বিজ্ঞানী।
ছবি আসলে সংখ্যা
বর্তমানে আমরা প্রায় সকলেই কোনো ডিজিটাল ক্যামেরা বা মোবাইলের ক্যামেরার মাধ্যমে ছবি তুলে থাকি। সাধারণত এসব ডিজিটাল ক্যামেরায় একটি Charged Couple Device (CCD) নামে সেন্সর থাকে। আলো কোনো একটি বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে এই সিসিডি সেন্সরে এসে পড়ে। আলোর কণার নাম ফোটন।
এই সিসিডি সেন্সর আবার অনেকগুলো সারি আর কলামে ভাগ করা থাকে। প্রতিটি সারি এবং কলাম আবার ছোট ছোট কিছু বর্গাকার ঘর তৈরি করে। এদের একেকটিকে বলা হয় একেকটি পিক্সেল। সিসিডি সেন্সর দিয়ে আসলে প্রতি পিক্সেলে কয়টি ফোটন কণা এসে আঘাত করছে তা গুনে রাখা যায়।
যেমন নিচের চিত্রে একটি সিসিডি সেন্সরের সরলীকৃত চিত্র দেওয়া আছে। সেন্সরটি ২০টি সারি ও ২০টি কলাম দিয়ে তৈরি। আর প্রতিটি ক্ষুদ্র ঘর একেকটি পিক্সেল। যেহেতু এই সিসিডিতে ২০টি সারি ও ২০টি কলাম রয়েছে তাই এই সিসিডি দিয়ে যে ছবিটি তৈরি করা হবে সেই ছবিটির রেজ্যুলেশন হবে 20×20। প্রতিটি পিক্সেলে বিভিন্ন সংখ্যা লেখা আছে। এই সংখ্যাগুলো দিয়েই বুঝানো হয় ঐ পিক্সেলে কয়টি ফোটন কণা এসে আঘাত করেছে। দেখা যাচ্ছে কিছু পিক্সেলে ১৭৮টি ফোটন কণা এসে আঘাত করেছে। আবার কিছু পিক্সেলে ৭৫টি ফোটন কণা এসেছে। আবার এমনও পিক্সেল রয়েছে যেখানে কোনো ফোটন কণা আসেই নি, তথা পিক্সেলের ভ্যলু ০।
উপরের চিত্রে যেই ডায়াগ্রামটি দেখতে পাচ্ছেন, একটি কম্পিউটারের চোখে এটিই একটি ছবি। কম্পিউটার সংখ্যা নিয়েই কাজ করে। সংখ্যা ছাড়া তার কাছে অন্য কিছুর মাহাত্ম্য তেমন একটা নেই। কিন্তু মানুষ শুধু সংখ্যা দেখে তেমন আন্দাজ করতে পারে না। যেমন উপরের এটি কীসের ছবি আপনি হয়ত আন্দাজ করতে পারছেন না। তাই সংখ্যা দিয়ে এভাবে ছবিকে প্রকাশ করলে মানুষের বুঝতে অসুবিধা হবে। এর বিকল্প পদ্ধতি বের করা প্রয়োজন।
মানুষের চোখ রঙের প্রতি খুবই সংবেদনশীল হয়। তাই সংখ্যাগুলোকে যদি কোনোভাবে বিভিন্ন রঙ দিয়ে প্রতিস্থাপন করে ফেলা যায় তাহলে মানুষের চোখ সহজের পার্থক্য ধরতে পারবে। এজন্য আমরা যেসকল পিক্সেলে কোনো ফোটন কণা এসে পড়েনি সেসকল পিক্সেলকে একদম কালো রঙ করে দেই। আর যেসকল পিক্সেলে ২৫৫টি ফোটন কণা এসেছে সেসকল পিক্সেলকে একদম সাদা রঙ করে দেই। তবে এর মাঝেও তো আরো অনেক সংখ্যার পিক্সেল রয়েছে। তাদের জন্য এই সাদা ও কালোর একটি মিশ্রণের রঙ আমরা তৈরি করেছি। ০ থেকে পিক্সের মান যতই ২৫৫ এর দিকে যাবে পিক্সেলের রঙ ততই কালো থেকে সাদার দিকে যেতে থাকবে।
প্রতিটি পিক্সেলকে এভাবে রঙ দ্বারা প্রতিস্থাপন করা হলে আমরা উপরের সংখ্যাবিশিষ্ট ছবিটিকেই নিচের মতো দেখতে পাবো –
তবে এই ছবিটির রেজ্যুলেশন খুবই বাজে। তাই অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খুবই। আমাদের কাছে যদি খুবই হাই রেজ্যুলেশনের কোনো একটি সিসিডি সেন্সর থাকে তখন আমরা সেইম বস্তুটির ছবি তুললে নিচের মতো দেখতে পেতাম। এই ছবিটির রেজ্যুলেশন 1343×1343। অর্থাৎ এই ছবিটিতে ১৩৪৩টি সারি ও ১৩৪৩টি কলাম রয়েছে।
কিন্তু এই ছবিটি মোটেও আমাদের বাস্তব ছবিগুলোর মতো রঙিন না। দেখতে সাদা-কালো দেখা যাচ্ছে। আমরা যদি রঙিন ছবি তৈরি করতে চাই তাহলে সেখানে গ্রে স্কেল তৈরি করা হয় না। এর বদলে লাল (R), সবুজ (G) ও নীল (B) রঙের তিনটি চ্যানেল তৈরি করা হয়। এরপর তিনটি চ্যানেল একসাথে যোগ করে দিলেই রঙিন ছবি তৈরি হয়ে যায়। গ্রে স্কেল নিয়ে কাজ করা ও বুঝানো সহজ। তাই এখানে কেবলমাত্র গ্রে স্কেলের ছবি নিয়েই কথা বলা হলো।
ছবির এত এত ফর্মেট কেন?
আমরা নানা সময়ই মোবাইলে বা কম্পিউটারে ছবিগুলো দেখার সময় খেয়াল করি ছবিগুলো .jpg বা .png ফর্মেটে সেইভ করা। এছাড়াও ছবির আরো অনেক ফর্মেটই রয়েছে। তবে এই দুটি ফর্মেট খুবই সচরাচর ব্যবহার করা হয়। মূল রঙিন ছবিটি সেইভ না করে এই ফর্মেটে সেইভ করে রাখার কারণ হচ্ছে, এই ফর্মেটে সেইভ করলে ছবির সাইজ কম লাগে। বিষয়টিকে আরেকটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি।
ধরুন আপনার কাছে 2592×1944 পিক্সেলের একটি ছবি আছে। তাহলে এই ছবিটিতে পিক্সেল রয়েছে মোট 5038848টি। প্রতি পিক্সেলের জন্য এই ছবিটি ৮বাইট করে আপনার ডিভাইসে স্টোরেজ নিবে। এটি শুধু একটি চ্যানেলের জন্য স্টোরেজ। যদি আমি তিনটি চ্যানেলের জন্য ছবিটির সাইজ বের করতে চাই তাহলে আমাকে পুরো সংখ্যাটিকে ৩ দিয়ে গুণ করতে হবে। তখন পুরো ছবিটির সাইজ দাড়াবে প্রায় ১৫ মেগাবাইট। একটি সাধারণ ছবির জন্য এতো বেশি স্টোরেজ নিয়ে রাখা অনেক সমস্যার। কারণ অল্প কিছু ছবি রাখলেই আপনার ডিভাইস আপনাকে ওয়ার্নিং দেওয়া শুরু করবে যে আপনার স্টোরেজে জায়গা নেই, জলদি জায়গা খালি করুন।
এমতাবস্থায় আপনার তোলা এই বিশাল সাইজের ছবিটির সাইজ ছোট করে দিতেই বিভিন্ন অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়। এদের কাজই ফাইলের সাইজ ছোট করে দেওয়া। তাই এধরণের অ্যালগরিদমকে Compression অ্যালগরিদম বলা হয়। আমরা যদি JPG Compression অ্যালগরিদম ব্যবহার করি তাহলে ঐ ১৫ মেগাবাইটের ছবিটিরই সাইজ কমে মাত্র ০.৮ মেগাবাইট দেখায়। ছবিটির সাইজ অনেক কমে গেলেও দেখতে এদেরকে হুবহু একইরকম দেখায়। যদিও আসলে এরা একই ছবি না। JPG Compression এর মাধ্যমে যদি আমরা ছবিটির সাইজ ছোট করি তাহলে ছবিটির রেজ্যুলেশন কমে যায়। কোনো একটি JPG ফর্মেটে থাকা ছবি জুম করে দেখলে দেখতে পাবেন ছবিটি ঘোলা ঘোলা দেখা যাচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে JPG Compression অ্যালগরিদমের মাধ্যমে ছবিটির রেজ্যুলেশন কমিয়ে দেয়। রেজ্যুলেশন কমিয়ে দিলে পিক্সেলের সংখ্যা কমে যায়। ফলে ছবির সাইজও ছোট হয়ে যায়।
তবে কখনও কখনও ফাইলের সাইজ ছোট করার পাশাপাশি একটি স্পষ্ট ছবিরও প্রয়োজন হয়। তখন আমরা সচরাচর PNG Compression অ্যালগরিদম ব্যবহার করে থাকি। এটির ক্ষেত্রে মানুষের ব্রেইনকে ট্রিক করা হয়। মানুষের ব্রেইন রঙের তুলনায় আলোক উজ্জ্বলতার প্রতি বেশি সংবেদনশীল। তাই সেখানে উজ্জ্বলতার জন্য একটি চ্যানেল রাখা হয়। আর রঙের জন্য তৈরি করা চ্যানেলগুলোর পিক্সেলের সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয়। ফলে ছবির সাইজ কমে যায়। আর এজন্যই আমরা আজকাল আমাদের মোবাইলের অল্প একটি স্টোরেজেও অনেকগুলো ছবি রাখতে পারছি।
Leave a Reply