ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, কানাডা স্পেস এজেন্সি ও নাসার যৌথ উদ্যোগে নির্মিত জেমস ওয়েব মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি পূর্বে উৎক্ষেপিত হাবল স্পেস টেলিস্কোপের যোগ্য উত্তরসূরী। নাসা ইতোমধ্যেই তা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং জেমস ওয়েবের দারুণ কিছু ছবিও তারা প্রকাশ করেছে। হাবল ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগত অনেকটা মিল থাকলেও গঠন, কার্যপ্রণালী ও কার্যক্ষমতার দিক দিয়ে রয়েছে বিস্তর পার্থক্য। কার্যগত দিক দিয়ে জেমস ওয়েব হাবল টেলিস্কোপকে বহুগুণে ছাপিয়ে যাবে মহাকাশপ্রেমীদের অন্তত সেটাই প্রত্যাশা। আজ আমরা বুড়ো হাবল ও তরুণ জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের গঠন ও কার্যগত পার্থক্যগুলোকে জানার চেষ্টা করবো।
পৃথিবী থেকে কে কোথায় অবস্থান করছে?
হাবল টেলিস্কোপ ইতিপূর্বে মহাকাশের দারুণ সব ছবি উপহার দিয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে- হাবল সেসব মহাজাগতিক বস্তুগুলোর খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। হাবলের অবস্থান পৃথিবীর খুব কাছেই বায়ুমণ্ডলের ঠিক উপরে নিম্ন কক্ষপথে। ভূপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫৫০ কিলোমিটার (প্রায়) উচ্চতায় হাবল পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে এবং ঘন্টায় ২৭০০০ কি.মি. গতিতে প্রতি ৯৫ মিনিটে একবার কক্ষপথ ভ্রমণ সম্পন্ন করে।
দূরত্বগত দিক দিয়ে হাবলের থেকে জেমস ওয়েব প্রায় ২৮০০ গুণ দূরে অবস্থিত। হাবলের মতো জেমস ওয়েব পৃথিবীর কক্ষপথকে প্রদক্ষিণ করে না বরং পৃথিবীর মতো-ই জেমস ওয়েব-ও সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে। জেমস ওয়েব যেখানে অবস্থান করছে সেই স্থানটিকে বলা হয় ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট-২ বা লাগ্রঁজীয় দ্বিতীয় বিন্দু (L2)। এই লাগ্রঁজীয় বিন্দুগুলো সাধারণত মহাকর্ষীয়ভাবে স্থির; এই বিন্দু ছাড়াও সূর্য-পৃথিবী সিস্টেমে এমন আরো চারটি লাগ্রঁজীয় বিন্দু রয়েছে।
এই লাগ্রঁজীয়-২ বিন্দুতে সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের পেছনে অবস্থান করার কারণে জেমস ওয়েব এদের আলো ও তাপ থেকে রক্ষা পাবে। এভাবে জেমস ওয়েবের মহাকাশ পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে (চাঁদের চেয়েও চারগুণ অধিক দূরত্ব) জেমস ওয়েব অবস্থান করছে। সর্বোপরি মহাকাশ পর্যবেক্ষণে জেমস ওয়েব বাড়তি সুবিধা পাবে। মহাজাগতিক বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতাও হাবলের থেকে বেশি হবে।
এদের গঠনগত পার্থক্যগুলো কী?
জেমস ওয়েবের প্রাথমিক ও প্রধান প্রতিফলক আয়নাটি সোনা ধাতুর প্রলেপ সহ বেরিলিয়ামের তৈরি। ১.৩ মিটার ব্যাসের ১৮ টি ষড়ভুজাকৃতির প্রতিফলক নিয়ে গঠিত দর্পণখণ্ডগুলির উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রায় এর আকারের কোনো পরিবর্তন ঘটে না। এদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- প্রতিটা খন্ডই আলাদাভাবে স্বয়ংক্রিয় প্রোগ্রামের সাহায্যে সুবধিাজনক উপায়ে নাড়াচাড়া করতে পারদর্শী। কোনো কারণে প্রাথমিক দর্পণ যদি ঠিকঠাকভাবে আলোকে প্রতিফলিত করে দ্বিতীয় প্রতিফলক দর্পণে না ফেলতে পারে তবে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দর্পণখণ্ডগুলি নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে আলোর প্রতিফলনে সামঞ্জস্যতা আনবে।
ছোট ষড়ভুজাকৃতির এই দর্পণখণ্ডগুলি একত্রে মিলে ৬.৫ মিটারের মৌচাকের মতো দেখতে একটি বড় প্রাথমিক প্রতিফলক দর্পণ গঠন করে। দর্পণটি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে ২৫ বর্গ মিটার এলাকা জুড়ে আলো সংগ্রহ করার সুযোগ করে দিবে; যার ক্ষেত্রফল হাবল দূরবীক্ষণ যন্ত্রের ২.৪ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট দর্পণটির ক্ষেত্রফলের তুলনায় ৬ গুণেরও বেশি বড়। সুতরাং ওয়েবের আলো সংগ্রহের পরিমাণও কয়েকগুন বেশি।
জেমস ওয়েবের দর্পণটি বেরিলিয়াম ধাতু দিয়ে তৈরি হওয়ার কারণে এটি হালকা কিন্তু শক্ত এবং অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায়-ও সংকুচিত না হয়ে যথাযথ আকৃতি ধরে রাখতে পারে। এছাড়া, সোনা রাসায়নিকভাবে অধিক নিষ্ক্রিয় হওয়ার কারণে দর্পণটি সোনা ধাতুপট্টাবৃত করা হয়েছে। যার কারণে অবলোহিত বিকিরণের জন্য দর্পণটি একটি উৎকৃষ্ট প্রতিফলক হিসেবে কাজ করবে।
অন্যদিকে, ৭.৮ ফুট ব্যাস বিশিষ্ট হাবলের প্রধান প্রতিফলক দর্পণে অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম ফ্লোরাইডের প্রলেপ দেয়ার কারণে এটি অতি বেগুনি রশ্মির প্রতিফলন বৃদ্ধি করে কিন্তু মধ্যম বা উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের অবলোহিত আলোয় কাজ করতে সক্ষম নয়।
হাবলের প্রথম দিকের ছবিগুলোতে স্পষ্টতা জনিত সমস্যা দেখা দিচ্ছিলো। দর্পণ নির্মান প্রতিষ্ঠানের ভুল পরিমাপের কারণে দর্পণে ছোট বিকৃতি থেকে যায় এবং হাবলের তোলা ছবিগুলোও অস্পষ্ট থাকে। পরবর্তীতে সার্ভিস মিশনের মাধ্যমে হাবলের দর্পণ সহ বেশ কিছু যন্ত্রপাতির পরিবর্তন করা হয়।
জেমস ওয়েব এ ধরণের সমস্যাগুলো থেকে ইতোমধ্যেই উতরে গিয়েছে এবং দারুণ সব ছবি পাঠাতে শুরু করেছে। তবে অপেক্ষাকৃত জটিল সব কলকব্জা ব্যবহারের কারণে এর স্থায়ীত্ব হাবলের মতো দীর্ঘকালব্যাপী হবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। যদিও জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ মিশনের সময়কাল ধরা হয়েছে মাত্র ১০ বছর।
কে কোন ধরণের আলোকে পর্যবেক্ষণ করছে?
বায়ূমণ্ডলে বাঁধার কারণে অতিবেগুনি ও নিকট-অবলোহিত রশ্মি পৃথিবীতে খুব একটা পৌঁছায় না। যার কারণে হাবলকে নিম্ন কক্ষপথে স্থাপন করা হয়; যাতে মহাজাগতিক বস্তুগুলোকে সহজে পর্যবেক্ষণ করা যায়। হাবল প্রাথমিকভাবে দৃশ্যমান আলো, অতিবেগুনি রশ্মি এবং নিকট-অবলোহিত (০.১ থেকে ১ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট) আলো পর্যবেক্ষণ করে।
অপরপক্ষে, জেমস ওয়েবকে প্রাথমিকভাবে মধ্য-অবলোহিত বা মিডল ইনফ্রারেড (০.৬ থেকে ২৮.৩ মাইক্রোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট) আলো সনাক্ত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ইনফ্রারেড আলো মানুষের পক্ষে খালি চোখে বা হাবল টেলিস্কোপ দিয়েও দেখা সম্ভব না। জেমস ওয়েব সেই আলোকে দেখার কাজটি-ই করছে।
অনেক দূরে অবস্থিত আদি ছায়াপথ, পুরোনো ও সদ্য সৃষ্ট নক্ষত্রগুলো থেকে বিকরিত রশ্মি সাধারণত দৃশ্যমান আলো নয় বরং অদৃশ্য অবলোহিত রশ্মি বা ইনফ্রারেড(এক ধরণের তাপরশ্মি) আকারে মহাকাশ ভ্রমণ করে। অবলোহিত তরঙ্গগুলি মহাকাশের গ্যাস ও ধূলিমেঘের ভেতর দিয়ে সহজেই অতিক্রম করে, যা পৃথিবীতে অবস্থিত কোনো দূরবীক্ষণ যন্ত্র কিংবা হাবল টেলিস্কোপের সাহায্যেও এ পর্যন্ত স্পষ্ট করে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু জেমস ওয়েব এসব উচ্চ লোহিত সরণবিশিষ্ট বস্তুসমূহকে অতি উচ্চমাত্রার বিভেদনক্ষমতা ও সংবেদনশীলতা বজায় রেখে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, যা আগে কখনও সম্ভব হয়নি।
উপরের ছবিতে দেখা যায় ইনফ্রারেড আলোয় প্রক্রিয়াকরণ করার পর শীতল তারা ও ছড়িয়ে থাকা ছায়পথগুলো অপেক্ষাকৃত উজ্জ্বল দেখা যায়। প্রতিটি আলাদা আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের ভিন্ন রেজুলেশন রয়েছে।
হাবল টেলিস্কোপে একই চিত্রের জন্য লাল, নীল, ইনফ্রারেড ফিল্টার ব্যবহার করতে হয়। জেমস ওয়েব যে ছবি প্রকাশ করেছে সেই ছবি হাবল থেকে পেতে হলে কমপক্ষে ৭ ধরণের ফিল্টার ও সেন্সর ব্যবহার করতে হবে। যেসব সেন্সরের তাপমাত্রার সংবেদনশীলতা বজার রাখাও কষ্টসাধ্য। জেমস ওয়েব সহজেই এই জটিলতাগুলো সম্পন্ন করে ফেলছে। কারণ সে উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট ইনফ্রারেড আলোতে সরাসরি কাজ করতে সক্ষম। এসব বৈশিষ্ট্যগুলোই জেমস ওয়েবকে অনন্য করে তুলছে।
৫ স্তরের সানশিল্ড কি জেমস ওয়েবকে ঠান্ডা রাখছে?
প্রত্যেক বস্তু থেকেই ইনফ্রারেড নিঃসৃত হয়। কতটুকু ইনফ্রারেড আলো নিঃসৃত হবে তা সেই বস্তুর তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করে। বস্তুর তাপমাত্রা যদি বেশি হয় তবে সেই বস্তু থেকে বেশি ইনফ্রারেড নির্গত হবে, যদি তাপমাত্রা কম হয় তবে ইনফ্রারেডের নির্গত হওয়ার পরিমাণ-ও কম হবে।
ইনফ্রারেড আলোর মাধ্যমে বস্তুর তাপীয় অবস্থাও নির্ধারণ করা যায়। আমরা কোনো একটি বস্তুকে যদি দৃশ্যমান আলোয় দেখি সেটি যেভাবে দেখা যাবে, একই বস্তু যদি ইনফ্রারেড আলোয় দেখি তবে সেটা ভিন্নভাবে দেখা যাবে। সবচেয়ে মজার কথা ইনফ্রারেড আলোর মাধ্যমে আড়ালে থাকা বস্তু-ও খুব সহজে বোঝা যায়। এক্ষেত্রে আমাদের ঘরে থাকা টিভির রিমোট বা রাতের অন্ধকারে সিসি ক্যামেরাকে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে।
মহাকাশের যে সব বস্তু আমাদের থেকে যত দূরে দেখতে পাবো তার মানে আমরা তত অতীতে যেতে পারবো। অনেক দূরের কোনো নক্ষত্র বা ছায়াপথ থেকে আলো ভ্রমণ করতে করতে তা আর দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের (৪০০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার) সীমার মধ্যে থাকে না। মহাবিশ্বের প্রসারণের ফলে (রেড শিফটিং) এই দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়তে বাড়তে ইনফ্রারেড আলোতে পরিণত হয়। এজন্য অবলোহিত(ইনফ্রারেড) আলো সংগ্রহের মাধ্যমে অনেক দূরের বস্তুকেও পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়। জেমস ওয়েবকে ইনফ্রারেড আলোর জন্যই ডিজাইন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে সে অনেক দূরের বস্তু তথা অতীতকে খুঁজবে।
ইনফ্রারেড আলো পর্যবেক্ষণের জন্য জেমস ওয়েবকে প্রচণ্ড শীতল থাকতে হবে; প্রায় -২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হবে। একটু খেয়াল করে দেখবেন, শীতকালে আমরা সামান্য গরম বস্তুর উষ্ণতাও খুব সহজে অনুভব করতে পারি। এর কারণ, আমাদের শরীরের তাপমাত্রা তখন খুব কম থাকে। মহাবিশ্বের অতীতের তারা থেকে নির্গত ইনফ্রারেড আলোর খুব অল্প তাপমাত্রাও জেমস ওয়েব পর্যবেক্ষণ করতে পারবে যদি ওয়েবের তাপমাত্রাও খুব কম থাকে। সে জন্য জেমস ওয়েবকে খুব ঠাণ্ডা রাখতে হবে। নয়ত সে ইনফ্রারেড বিকিরণের তাপমাত্রা সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারবে না। সুতরাং মহাকাশে জেমস ওয়েবকে ঠান্ডা রাখা অন্যতম একটি চ্যালেঞ্জ। এজন্য তিন ধরণের ব্যাবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে।
১. সূর্যের আলো থেকে জেমস ওয়েবকে আড়ালে রাখার জন্য লাগ্রঁজীয় পয়েন্ট-২ তে রাখা হয়েছে। এই ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্টগুলো মহাকর্ষীয়ভাবে স্থির হওয়ার কারণে পৃথিবী থেকে ওয়েবের দূরত্ব সবসময় সমান থাকে এবং সূর্য পৃথিবীর আড়ালে থাকে।
২. সূর্য, পৃথিবী ও চাঁদের প্রতিফলিত তাপ থেকে জেমস ওয়েবকে সুরক্ষিত ও ঠাণ্ডা রাখতে এতে ৫ স্তরের সানশিল্ড ব্যবহার করা হয়। অ্যালুমিনিয়াম ও সিলিকনের প্রলেপকৃত ক্যাপটন নামের বিশেষ ধরণের প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি এই সানশিল্ড উচ্চ মাত্রার তাপ প্রতিরোধী, ওজনে হালকা, মজবুত ও সহজেই ভাজ করা যায়।
উচ্চ তাপমাত্রা ও নিম্ন তাপমাত্রায় এই সানশিল্ড দারুণ কাজ করে। সানশিল্ডের কোনো স্তর দিয়ে তাপ প্রবেশ করলে তা যেন সহজেই বের হয়ে যেতে পারে সেজন্য পাঁচ স্তরের মধ্যে ফাঁকা রাখা হয়েছে। এই সানশিল্ডের তাপ প্রতিরোধী ক্ষমতা এতটাই যে- এর উত্তপ্ত পাশে যদি তাপমাত্রা ৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয় তবে এর অন্য পাশের তাপমাত্রা হবে -২৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। এই সানশিল্ড সূর্যের দিকে থাকার কারণে সব ধরণের তাপকে প্রতিফলিত করে জেমস ওয়েবকে ঠাণ্ডা রাখছে।
৩. জেমস ওয়েবের নিজস্ব কলকব্জায় সৃষ্ট তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখাও একটি চ্যালেঞ্জ। ওয়েবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেন্সর হচ্ছে মিড ইনফ্রারেড ইন্সট্রুমেন্ট বা MIRI; এই সেন্সর অনেক দূরের ছায়াপথ থেকে আসা স্থানান্তরিত মিড ইনফ্রারেড আলোকে সহজেই শনাক্ত করতে সক্ষম। তবে এটি মাত্র – ২৬৬.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ভালো কাজ করে। যার ফলে খুব সহজেই এই সেন্সর ওয়েবের অন্য যন্ত্রাংশগুলো থেকে তাপমাত্রা শোষণ করতে সক্ষম। সেজন্য এই MIRI-সেন্সরকে খুব নগন্য তাপমাত্রা থেকে রক্ষা করার জন্য হিলিয়ামের বিশেষ কুলিং ব্যবস্থা সম্পন্ন ক্রাইকুলার ব্যবহার করা হয়েছে।
হাবলের ক্ষেত্রে এইসব জটিল প্রক্রিয়াগুলো অনুপস্থিত। হাবলের প্রাথমিক দর্পন সাধারণ দর্পণের ন্যায় কাজ করে। অতিবেগুনি রশ্মি ও দৃশ্যমান আলো নিয়ে কাজ করে বিধায় হাবলের এরকম কোনো ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ে না।
কে কোন সেন্সর ব্যবহার করছে?
জেমস ওয়েবে কয়েক ধাপে আলো দর্পণ দ্বারা প্রতিফলিত হয়ে সর্বশেষ সেই আলো প্রবেশ করে জটিল সব সেন্সরে। প্রথমেই রয়েছে নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা বা NIRcam; যার কাজ হচ্ছে স্বয়ংক্রিয়ভাবে উজ্জ্বল বস্তুর আলোকে আড়াল করে কম উজ্জ্বল তারা বা ছায়াপথ থেকে আলো সংগ্রহ করা। তবে এই সেন্সর দিয়ে মহাজাগতিক বস্তু গুলোর গঠন নির্নয় করা যায় না। সেজন্য রয়েছে NIRSPEC নামের বিশেষ সেন্সর। যা আলোর বৈশিষ্ট্য নিয়ে কাজ করবে এবং যে সকল বস্তু থেকে আলো আসছে সেসকল বস্তুর ভর, তাপমাত্রা ও রাসয়নিক গঠন সম্পর্কেও বিশ্লেষণ করে। এই সেন্সরের আকর্ষণীয় কাজ হচ্ছে, বহুসংখ্যক তারার মধ্যে সে একটি নির্দিষ্ট বস্তুকে নিয়ে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম।
ফাইন গাইডান্স সেন্সরের(FDS) সাহায্যে জেমস ওয়েব একই সময়ে বিভিন্ন বস্তুর প্রতি নজর রাখতে পারবে। এছাড়াও রয়েছে মিড ইনফ্রারেড ইন্সট্রুমেন্ট (MIRI)। যা অনেক দূরের ছায়াপথ থেকে আসা স্থানান্তরিত মিড ইনফ্রারেড আলোকে সহজেই শনাক্ত করতে সক্ষম। এসব সেন্সরগুলো অত্যন্ত তাপ সংবেদনশীল হওয়ার কারণে সেগুলোকে সানশিল্ডের শীতল পাশে স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির মধ্যে রেডিও কমিউনিকেশন অ্যান্টেনা, সোলার প্যানেল সহ নানা সব যন্ত্রপাতি ও সেসব সচল রাখার মেকানিজম রয়েছে সানশিল্ডেরর উষ্ণ প্রান্তে।
জেমস ওয়েবের মতো হাবলেরও রয়েছে ফাইন গাইডান্স সেন্সর (FDS), ক্যামেরা সেন্সরের মধ্যে WFC3 ও অ্যাডভান্স ক্যামেরা ফর সার্ভে (ACS), অজানা উৎস থেকে নির্গত অতিবেগুনি রশ্মি বিশ্লেষণের জন্য রয়েছে কসমিক অরিজিন স্পেকটোগ্রাফ(COS) ও স্পেস টেলিস্কোপ ইমেজ স্পোকটোগ্রাফ (STIS) যা একই সাথে ক্যামেরা ও স্পেকটোগ্রাফির কাজ করে। এছাড়া নিকট অবলোহিত আলো বিশ্লেষণের জন্য রয়েছে নিয়ার ইনফ্রারেড ক্যামেরা অ্যান্ড মাল্টি অবজেক্ট স্পেকটোমিটার (NICMOS)। যদিও এই সেন্সর এখন আর কাজ করছে না।
JWST কে কি হাবলের মতো রক্ষণাবেক্ষণ করা যাবে?
হাবল টেলিস্কোপ উৎক্ষেপণ করার পরপর-ই দর্পণ বিকৃতি, সেন্সর ও ক্যামেরায় তাপ সম্প্রসারণ জনিত সমস্যা সহ কতগুলো প্রধান সমস্যা দেখা দেয়। পৃথিবী থেকে খুব কাছে হওয়ার কারণে সার্ভিস মিশন পরিচালনার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত হাবলকে পাঁচ বার মেরামত করা হয়েছে। সেগুলো সম্ভব না হলে হাবল এতদিন টিকে থাকতে পারতো না এবং জটিল সব জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক গবেষণাগুলোও আলোর মুখ দেখতো না।
অপরপক্ষে, জেমস ওয়েব পৃথিবী থেকে ১৫ লক্ষ কিলোমিটার দূরে মহাকর্ষীয়ভাবে স্থিতিশীল স্থানে ভ্রমণ করবে যা সূর্য ও পৃথিবীর ল্যাগরেঞ্জ পয়েন্ট 2 (L2) নামে পরিচিত। সেখানে হাবলের মতো সার্ভিস মিশন পরিচালনা করা সম্ভব না। সুতরাং খুব সহজেই বলা যায়, জেমস ওয়েবের কোনো ত্রুটি দেখা দিলে তা মেরামত অযোগ্য থেকে যাবে।
যদিও দীর্ঘদিনের গবেষণা ও কর্ম পরিকল্পনার মাধ্যমে জেমস ওয়েবকে যথেষ্ট টেকসই ও মজবুত করে তৈরি করা হয়েছে এবং নাসা দাবী করছে জেমস ওয়েবে মিশন চলাকালীন সময়ে তেমন কোনো ত্রুটি-ই দেখা যাবে না। তবে সূক্ষ্ম কোনো ত্রুটির কারণেই ধূলিস্যাৎ হতে পারে এই অপার সম্ভাবনাময় মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রটির। ভবিষ্যতে মহাকাশ বর্জ্যও এর জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
১১ জুলাই ২০২২ নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক দিন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের প্রথম রঙিন ছবির মোড়ক উন্মোচন করেন। মুহূর্তেই মহাকাশের ক্ষুদ্র অংশের এক ছবিতেই স্পষ্ট হয়ে উঠে ১৩০০ কোটি বছরের পুরোনো হাজারো ছায়াপথ। উৎক্ষেপনের পর থেকে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের।
২০২১ সালের ২১ ডিসেম্বর আরিয়ানা মহাকাশ কেন্দ্র থেকে আরিয়ানা-৫ রকেটে মহাকাশ অভিমুখে যাত্রা শুরু করে জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। নাসা কর্তৃক পরিচালিত জেমিনি, বুধ ও অ্যাপোলো মিশনের সাবেক প্রশাসক জেমস এডুইন ওয়েবের নামে এই মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের নামকরণ।
সমগ্র বিশ্বজুড়ে এখন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের জয়জয়কার। আধুনিক পৃথিবীর অত্যাধুনিক এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রের চমকপ্রদ ছবিগুলো মানুষকে বিস্মিত করছে। দূর আকাশের নক্ষত্র ও গ্যালাক্সির বিশাল সন্নিবেশ স্পষ্ট হচ্ছে। যার শুরুটা হয়েছিলো হাবল মহাকাশ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের মাধ্যমেই।
হাবলের মাধ্যমেই মহাকাশের প্রকৃত সৌন্দর্য্য মানুষের চোখে একটু একটু করে ধরা দিতে শুরু করে। মানুষের মহাকাশ ভাবনা ও মহাকাশের প্রতি প্রেম তৈরিতে হাবলের ভূমিকা অপরিসীম। নতুন নতুন প্রযুক্তির স্পেস টেলিস্কোপের উৎক্ষেপন ভবিষ্যতেও হবে; তবে হাবল টেলিস্কোপের প্রতি ভালোবাসা নিশ্চয়ই যুগ যুগান্তর থেকে যাবে। সর্বোপরি- হাবল, জেমস ওয়েব কিংবা অন্য কোনো যন্ত্র একটু একটু করে বিশ্ববাসীর কাছে মহাবিশ্বের সৌন্দর্য্য ফুটিয়ে তুলুক সেটাই প্রত্যাশা।
তথ্যসূত্র:
- What Is the Hubble Space Telescope? | NASA
- James Webb’s record-breaking first science image: explained – Big Think
- Comparison: Webb vs Hubble Telescope – Webb/NASA
- James Webb telescope vs Hubble | Canadian Space Agency
- James Webb Space Telescope vs. Hubble: How will their images compare?
- JWST versus Hubble: How are they different? | The Planetary Society
- What’s the difference between the Hubble and James Webb telescopes? – SpaceQ
- Orbit – Webb/NASA
- What are the differences between the Webb and Hubble space telescopes?
- Hubble’s Mirror Flaw | NASA
- Mirrors Webb/NASA
Leave a Reply