গত ২৩ শে আগষ্ট সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা রাখে ভারতীয় নভোযান চন্দ্রযান-৩। এরই মধ্য দিয়ে পৃথিবীর প্রথম দেশ হিসেবে চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয় করার তকমা পেল ভারত। এর আগে গত ১০ আগষ্ট ২০২৩ তারিখে, রাশিয়ার মহাকাশযান লুনা-২৫ চাঁদের দক্ষিণ দিকের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। কিন্তু তাদের এই প্রয়াস ব্যর্থ হয়। ভারতের এই চন্দ্রজয় পৃথিবীবাসী বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের জন্যে এক বড় মাইলফলক। কারণ বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় এই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ যে একধাপ এগিয়েছে এই চন্দ্রজয় তা প্রমাণ করে। এই প্রবন্ধে আমরা চন্দ্রযান-৩ সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত ধারণা নেয়ার চেষ্টা করবো।
চন্দ্রযান-৩ এর যাত্রা পথ
চন্দ্রযান-৩ এর যাত্রা পথকে সহজ ভাষায় বলতে গেলে তিন ভাগে ভাগ করা যায়-
- পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশ
- চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ
- বিক্রম ল্যান্ডারের সফলভাবে চাঁদে অবতরণ
প্রথমেই দেখা যাক পৃথিবীর কক্ষপথে প্রবেশের বিষয়টা। চন্দ্রযান-৩ কে গত ১৪ই এপ্রিল ভারতের তৈরী ৪৩.৫ মিটার লম্বা এলভিএম৩ (LVM3) রকেটে করে ইপিও (EPO) অরবিট বা আর্থ পার্কিং অরবিট এ প্রেরণ করা হয়। ইপিও থেকে কোনো মহাকাশযান কে অন্য কক্ষপথে প্রেরণ করা হয়। এখানে একটা মজার ব্যাপার হলো, চন্দ্রযান-৩ এর মোট বাজেট ছিলো ৬১৫ কোটি রুপি বা ৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে রাশিয়ার পাঠানো লুনা-২৫ এর বাজেট ছিলো প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভারত কি করে এত কম খরচে চন্দ্রজয় করল? এর কারণ চন্দ্রযান-৩ কে মহাকাশে পাঠাতে ইসরোর (ISRO) বিজ্ঞানীরা সরাসরি কোনো রকেট ব্যবহার করেন নি। তারা যে পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন তার নাম হলো হোহম্যান ট্রান্সফার অরবিট থিওরি (Hohmann transfer orbit theory)। এই থিওরির সারকথা হলো, কোনো মহাকাশযানকে কক্ষপথে ঘুরিয়ে তার গতি বৃদ্ধি করে তাকে অন্য গ্রহের দিকে ছুড়ে মারা। তখন অন্য গ্রহের মধ্যাকর্ষণ সেই যানকে তার কক্ষপথে টেনে নিবে। যেহেতু এতে সরাসরি মহাকাশযানকে চাঁদে পৌছে দেয়া হচ্ছে না তাই এতে বাজেট কম লাগে।
সেই মোতাবেক ১৪ই এপ্রিল পাঠানো চন্দ্রযান-৩ ১৫ই আগষ্ট তার পৃথিবীর চারপাশে প্রথম আবর্তন শেষ করে। এভাবে ১৬ ও ৩১ তারিখ চন্দ্রযান-৩ তার ২য় ও ৩য় আবর্তন শেষ করে। এরপর আগষ্টের এক তারিখে এটি শেষ কক্ষপথে পৌঁছায় এবং চাঁদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। চন্দ্রযান-৩ ৫ই আগষ্ট সফলভাবে চাঁদের কক্ষপথে প্রবেশ করে। ১৪ ই আগষ্ট চাঁদের সবচেয়ে কাছের কক্ষপথে চলে আসে। সতেরো তারিখে মূল প্রোপালসন থেকে বিক্রম ল্যান্ডার তার ভেতরে থাকা ছাব্বিশ কেজি ওজনের রোভার প্রজ্ঞানসহ আলাদা হয়ে যায়। এই মিশনের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ছিল বিক্রম ল্যান্ডারের সফলভাবে চাঁদে অবতরণ। এই কাজ সম্পন্ন হতে সময় লেগেছে পুরো ঊনিশ মিনিট। চন্দ্রযান-৩ যখন চাঁদ থেকে সাড়ে সাত শ কিমি. উপরে ঘণ্টায় ত্রিশ কিলো বেগে ঘুরছে তখন ল্যান্ডিং প্রক্রিয়া শুরু হয়। শুরুতে নভোযানটির গতিবেগ কমিয়ে ঘণ্টায় প্রায় দুই কিলো করা হল। গতি কমাতে ব্যবহৃত হয় চারটি ইঞ্জিন। সময় লেগেছে বারো মিনিট। সাথে সাথে এটি চাঁদের সাত কিলো দূরে চলে আসে। পরের কাজটা আরও কঠিন। বিক্রমকে চাঁদের কোন জায়গায় ল্যান্ড করানো হবে সেটা ঠিক করা। সেজন্যে চন্দ্রযান-৩ তার আটটা ছোট থ্রাস্টার ব্যবহার করে এটি চাঁদের নিম্নকক্ষপথে স্থির হয়। উদ্দেশ্য ল্যান্ডিং সাইট ভালো মতন পর্যবেক্ষণ করা।
উচ্চতা মাপার জন্যে ব্যবহার করা হয় দুটো উচ্চতামাপক যন্ত্র। এই যন্ত্রদ্বয় দিয়ে উচ্চতা মাপতে ব্যবহার করা হয় লেজার ও মাইক্রোওয়েব তরঙ্গ। এই ধরণের উচ্চতামাপক যন্ত্র প্রায় সব যানেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ১৫ই এপ্রিলে জাপানের পাঠানো এক রোভার উচ্চতা মাপার ক্ষেত্রে ভুল করে। মাটিতে নামার আগেই এর জ্বালানি ফুরিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া চন্দ্রযান-২ এর বিফলতার পেছনেও দায়ী এই উচ্চতা মাপার ভুল। তাই এবার দুটো যন্ত্র দেয়া হয়েছে যাতে আগের মতন ভুল না হয়। তাছাড়া এবার বিক্রম ল্যান্ডারে লেজার ডপলার ভেলুসিমিটার ব্যবহার করা হয়েছে, যা চাঁদের উচ্চতার সাথে সাথে তার বেগও মাপতে পারবে। ফলে মহাকাশযানের গতি কমাতে ভুল কম হবে। এবার বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের মাটি থেকে সাড়ে আট শ মিটার কাছে চলে আসে এবং এই অবস্থানে এসে তার ল্যান্ডিং সাইটের ছবি তোল। তারপর তা স্যাটেলাইটের সাথে মিলিয়ে দেখে। বিক্রম ল্যান্ডারের ল্যান্ডিং এরিয়া প্রায় আড়াই কিলো এবং ইসরোর বিজ্ঞানীরা এটাকে তিন হাজার নয় শ সেকশনে ভাগ করেছিলেন। এর একটিতে চন্দ্রযান-৩ কে নামতে হতো। বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের মাটির প্রায় দেড় শ মিটার কাছে চলে এসে আধা মিনিট অপেক্ষা করে। পুনরায় চেক করে নেয় ল্যান্ডিং সাইটে কোনো ঝুঁকি আছে কিনা। তারপর অবশেষে বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের ম্যানজিনাস (Manzinus) নামক গর্তে পা রাখে। যে স্থানে এটি অবতরণ করেছে তার নাম রাখা হয়েছে শিব শক্তি পয়েন্ট। এই শ্বাসরুদ্ধকর ঊনিশ মিনিটের অপেক্ষার পর চতুর্থ দেশ হিসেবে চাঁদে পা রাখে ভারত। সেই সাথে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পা রাখা প্রথম দেশের তকমাও মেলে ভারতের।
চন্দ্রযান-৩ এ ব্যবহৃত যন্ত্রাংশ
চন্দ্রযান-৩ এর সাথে পাঠানো হয়েছে নানা রকম যন্ত্রাংশ। এর এক একটা নানা রকম পরীক্ষা চালানোর জন্যে ব্যবহৃত হয়েছে। চন্দ্রযান-৩ এ কি কি যন্ত্রাংশ ব্যবহৃত হয়েছে তা জেনে নেয়া যাক।
প্রথমেই আসি বিক্রম ল্যান্ডারের প্রোপালসন মডিউলে। বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদে নামার পরও এর প্রোপালসন মডিউল চাঁদের কক্ষপথেই থাকবে। তাই এতে বসানো হয়েছে নাসার তৈরী স্পেকট্রো-পোলারিমেট্রি অব হেবিটেবল প্লানেট আর্থ (SHAPE)। এই যন্ত্র পৃথিবীকে একটি এক্সোপ্ল্যানেট হিসেবে পর্যবেক্ষণ করবে। উদ্দেশ্য সৌরজগতের বাইরে পৃথিবীর মতো গ্রহ খুঁজতে কি কি তথ্য আমলে নিতে হবে তা খুঁটিয়ে দেখা।
ল্যান্ডার বিক্রমেও রয়েছে মোট চারটি যন্ত্র। যন্ত্রগুলোর নামও তাদের কাজ দেখে নেয়া যাক-
- রেডিও এনাটমি অব মুন বাউন্ড হাইপারসেনসিটিভ আয়নোস্ফিয়ার এন্ড এটমস্ফিয়ার, সংক্ষেপে (RAMBHA): এই যন্ত্রের কাজ হলো কিভাবে চাঁদে থাকা লোকাল গ্যাস ও প্লাজমা সময় সময় পরিবর্তিত হয় তা দেখা।
- চন্দ্রস সার্ফেস থার্মোফিজিক্যাল এক্সপেরিমেন্ট (ChaSTE): এর কাজ হলো চাঁদের মাটির তাপমাত্রা পর্যবেক্ষণ করা।
- ইন্সট্রুমেন্ট ফর লুনার সিসেমিক অ্যাকটিভিটি (ILSA): এর কাজ হলো চাঁদের পৃষ্ঠে হওয়া ভূমিকম্পের পরীক্ষা করা।
- লেজার রেট্রোফ্ল্যাক্টর অ্যারে (LRA): নাসার দেয়া এই যন্ত্র আসলে চাঁদের দক্ষিণ পৃষ্ঠের সঠিক দুরত্ব মাপতে সাহায্য করবে।
এবার আসা যাক বিক্রম ল্যান্ডারে থাকা রোভার প্রজ্ঞানে। প্রজ্ঞানে দুটো যন্ত্র রয়েছে এলআইবিএস এবং এপিএক্সএস। এলআইবিএস বা লেজার ইন্ডিউসড ব্রেকডাউন স্পেকট্রোস্কোপ, এর কাজ হলো চাঁদের মাটির রাসায়নিক উপাদান খুঁজে বের করা। আর এপিএক্সএস বা আলফা পার্টিকল এক্স-রে স্পেকট্রোমিটার, এর কাজ হলো চাঁদের মাটিতে নতুন পদার্থ খুঁজে বের করা। সম্প্রতি দেয়া তথ্যে ইসরো জানিয়েছে যে প্রজ্ঞান রোভার চাঁদের মাটিতে সালফারের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছে।
চন্দ্রযান-৩ এর স্থায়িত্ব কাল
চন্দ্রযান-৩ মাত্র এক চন্দ্রদিন কাজ করতে পারবে। শুনতে কম মনে হতে পারে। কিন্তু এক চন্দ্রদিন পৃথিবীর চৌদ্দ দিনের সমান। এর কারণ চন্দ্রযান-৩ এর শক্তির উৎস হল সূর্যের আলো। চৌদ্দ দিন পর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে রাত্রি নেমে আসবে। তাই তখন চন্দ্রযান-৩ আর কাজ করতে পারবে না।
কেনো দক্ষিণ মেরুতেই অবতরণ?
প্রথমে রাশিয়ার লুনা-২৫ কে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে নামানোর চেষ্টা। রাশিয়া ব্যর্থ হলেও ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয় করেই ফেললো। কিন্তু কেনো সবাই চাঁদের দক্ষিণ জয় করতে উঠে পড়ে লাগলো? চাঁদে পানির অস্তিত্বের প্রথম প্রমাণ মেলে চন্দ্রযান-১ এর মাধ্যমে। এই পানিই সবাইকে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সেই সাথে আছে চাঁদে কলোনি বানানোর স্বপ্ন। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর তাপমাত্রা কম তাই সেখানে পানি বরফ আকারে জমা আছে। মহাকাশে পানিকে বলা হয় তরল সোনা। কারণ এর সাহায্যে অক্সিজেন তৈরী করা সম্ভব, রকেটের জ্বালানী তৈরী করা সম্ভব। যা মহাকাশে মানুষের বসতি স্থাপনের প্রধান সাহায্যকারী হবে। আশা করা যায় চন্দ্রযান-৩ চাঁদের অনেক অজানা রহস্য সমাধান করতে পারবে।
তথ্যসূত্রঃ
- All you need to know about Chandrayaan–3 – The Hindu BusinessLine
- Chandrayaan-3: A complete guide to India’s third mission to the moon | Space
- Chandrayaan-3, India’s Moon lander and rover | The Planetary Society
- Chandrayaan-3 Makes Historic Touchdown on the Moon – Scientific American
- India’s Chandrayaan 3 Reaches for the Moon (Updates with Video) – Sky & Telescope
Leave a Reply