প্রতি বছরের মতো এবারও নোবেল পুরস্কার নিয়ে আগ্রহ কম ছিল না। নোবেল নিয়ে মানুষের এত কৌতূহলের বড় কারণ হলো নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণার আগে তা জানা অসম্ভব। যে-সব বিষয়ে নোবেল দেওয়া হয় তার মধ্যে পদার্থবিজ্ঞান একটি। এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের পিয়ের আগোস্তিনি, জার্মানির ম্যাক্স প্লাংক ইন্সটিটিউট অফ কোয়ান্টাম ওপটিক্সের ফেরেন্স ক্রাউজ এবং সুইডেনের ল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যান লিয়ের। আলোর অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের মাধ্যমে ইলেকট্রনের গতিবিধি নির্ণয়ের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্যে তাঁদের এ পুরস্কার দেওয়া হয়।
স্পন্দন ও অ্যাটোসেকেন্ড
এবারের নোবেলজয়ী তিন বিজ্ঞানীর গবেষণা বুঝতে হলে, আলোর স্পন্দন ও অ্যাটোসেকেন্ড সম্বন্ধে জানা জরুরি। প্রথমেই আসি অ্যাটোসেকেন্ডের ব্যাপারে। অ্যাটোসেকেন্ড শব্দটা বেশিরভাগ মানুষের কাছেই হয়ত অজানা। এর একটি বড় কারণ হলো অ্যাটোসেকেন্ড সময়ের এতো ছোট একক যে এটা নিয়ে কাজ হয় না বললেই চলে। সময়ের এতো ক্ষুদ্র এককে পৌঁছানো সম্ভব সে ব্যাপারে এর আগে ভাবনা ছিল না কারোরই। কিন্তু কতটা ক্ষুদ্র এই অ্যাটোসেকেন্ড ?
আমরা সাধারণত দূরত্ব পরিমাপ করি কিলোমিটারে। একটু ছোট দূরত্ব হলে মিটারে, আরো ছোটো হলে সেন্টিমিটার বা মিলিমিটারে। কিন্তু যদি অণু, পরমাণু পর্যায় হয় তাহলে কিন্তু আর সেন্টিমিটার বা মিলিমিটারে থাকি না। একদমে চলে যাই মাইক্রোমিটার কিংবা ন্যানোমিটার স্কেলে। এবার সময়ে আসা যাক। আমরা সাধারণত জানি সময়ের সবচেয়ে ছোট একক হল সেকেন্ড। কিন্তু সেকেন্ড যদি আরো ছোট হতে থাকে যেমন এক সেকেন্ডকে দশ দিয়ে ভাগ করলে হয় ০.১ সেকেন্ড। এবার আমি এক সেকেন্ডকে যদি এক মিলিয়ন দিয়ে ভাগ করি তাহলে দাঁড়ায় ১÷১০০০০০০ বা ১০-৬ বা ১ মাইক্রোসেকেন্ড। এবার আর মিলিয়ন না, এবার এক সেকেন্ডকে সরাসরি এক বিলিয়ন দ্বারা ভাগ করি তাহলে দাঁড়ায় ১÷১০০০০০০০০০ বা ১০-৯ বা ১ ন্যানোসেকেন্ড।
এবার আরো ছোট করি সেকেন্ডকে, এবার একদম এক হাজার বিলিয়ন বা এক কোয়াড্রিলিয়ন দিয়ে ভাগ করি তাহলে হবে ১÷১০১৫ বা ১০-১৫। যাকে বলা হয় ১ ফেমটো সেকেন্ড। মজার ব্যাপার হল এখনো আমরা অ্যাটোসেকেন্ডে পৌঁছাইনি। আমি যদি এক সেকেন্ডকে বিলিয়ন বিলিয়ন ভাগ করি বা এক হাজার কোয়াড্রিলিয়িন দিয়ে ভাগ করি তাহলে হবে ১÷১০১৮ বা ১০-১৮ সেকেন্ড। আর একেই বলা হয় এক অ্যাটোসেকেন্ড। মাথা নষ্ট করার মতো ছোট এই অ্যাটোসেকেন্ড। বিস্ময়কর ব্যাপার হল, এক অ্যাটোসেকেন্ড হলো এক সেকেন্ডের ততো গুলো ভাগ যতগুলো সেকেন্ড এই মহাবিশ্বের জন্মের পর আজ অবধি অতিক্রান্ত হয়েছে।
এবার আসা যাক স্পন্দনের ধারণায়। স্পন্দন শব্দটা আমরা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করি নাড়ির স্পন্দনের হার মাপতে। নাড়ির স্পন্দন একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর হয়। ঠিক সেই রকমই আলোর পালস বা স্পন্দন হলো একটা ছোট্ট সময় পর পর বিচ্ছুরণ। আলোর যেহেতু তরঙ্গ ধর্ম রয়েছে তাই এর স্পন্দনও রয়েছে। আলোর স্পন্দনের স্থায়িত্বকাল অনেক ক্ষুদ্র হয়। একে মাইক্রোসেকেন্ড, পিকোসেকেন্ড বা ফেমটো সেকেন্ডে মাপা হয়। তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত ছোট হয় পালস তত কমে। যেমন লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ৭০০ ন্যানোমিটার, এর পালস ৪.৩ ˟ ১০১৪ সেকেন্ড। আমরা যত ক্ষুদ্র সময়ের পালস ধরতে পারবো তত ক্ষুদ্র আলোর সন্ধান পাবো। এবারের নোবেল বিজয়ীরা অ্যাটোসেকেন্ড লেভেলে আলোর স্পন্দন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের আলোর কাজ কি
আপনি যখন ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করেন তখন কিন্তু যে বস্তুর ছবি তোলেন তার দিকে অনেকক্ষন ক্যামেরা ধরে থাকেন। কিন্তু বস্তু দ্রুত গতির হলে খুব দ্রুত ক্লিক করতে হয়। ক্যামেরার এক্সপোজার সময় হতে হয় দ্রুত গতির বস্তুর মতোই দ্রুত। এবার বিষয়টা একদম পরমাণু লেভেলে চিন্তা করি। একটি পরমাণুর চলার বেগ হিসেব করা হয় ফেমটো সেকেন্ডে। আর ফেমটোসেকেন্ড কত তা আমরা আগেই জেনেছি। পরমাণুকে তো তাও তার ভারী নিউক্লিয়াসকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। তাই একটু বেশী সময়ই লাগে। এবার পরমাণুর ভেতরে থাকা ইলেক্ট্রন এর কথা চিন্তা করা যাক। একটি ইলেক্ট্রন পরমাণুর এক শক্তিস্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে যাচ্ছে। তাহলে এর সময় হবে আরো কম মানে অ্যাটোসেকেন্ডে। যদি অ্যাটোসেকেন্ডের আলো তৈরি সম্ভব হয়, তাহলে ছবি তোলা সম্ভব ইলেকট্রনের এক কক্ষপথ থেকে অন্য কক্ষপথে যাওয়ার অবস্থারও।
কি করে তৈরি করা হল অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের আলো
এত ক্ষুদ্র স্পন্দনের আলো তৈরি করা হয় লেজার রশ্মি দিয়ে। বলা যায় এই আলোগুলো হলো লেজার বিম বা রশ্মি। ১৯৮০ সালের আগ অবধি ফেমটোসেকেন্ড স্পন্দনের আলো তৈরি করার পদ্ধতি জানা ছিল। কিন্তু ইলেক্ট্রনের গতিবিধি জানতে হলে, এর চাইতেও ছোট অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের আলো তৈরি করতে হবে। এই ক্ষুদ্র স্পন্দনের আলো তৈরি করা সম্ভব কেবল মাত্র অতিক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর সাহায্যে। আলোকে এতো ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্যের বানানো কিন্তু সহজ কাজ নয়। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় ওভারটোন পদ্ধতি। আমরা যদি গিটারে কোনো নোট বাজাতে চাই তাহলে গিটারের তারকে আঘাত করতে হবে। এতে ঐ তারে একটি নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শব্দ উৎপন্ন হবে। এবার আমি আমার নোট অনুযায়ী যদি গিটারের কোনো ফ্রেটে (গিটারের হাতলের খাঁজকাটা অংশগুলোকে ফ্রেট বলে) হাত রাখি তাহলে আমার নোট অনুযায়ী সুন্দর শব্দ শুনতে পাবো। এর কারণ হলো ফ্রেটে হাত রাখার সাথে সাথে তার থেকে এক ভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের শব্দ উৎপন্ন হয়েছে, যা আগের শব্দের সাথে মিলে নোট অনুযায়ী এই সুন্দর শব্দ তৈরি করেছে। এটা আসলে মূল শব্দই, কিন্তু একটার সঙ্গে আরেকটা উপরিপাতিত হয়ে নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্য উৎপন্ন হয়েছে। এই ঘটনাকে বলে ওভারটোন।
এই একই পদ্ধতি ব্যবহার করে অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যও তৈরি করা সম্ভব। ১৯৯০ এর দিকে পদার্থবিদ অ্যান লিয়ের একটি পরীক্ষা চালান। তিনি অবলোহিত আলোর লেজারকে গ্যাসের ভেতর চালনা করেন। এই লেজার গ্যাস কণাগুলোর সামনে তড়িৎচৌম্বকীয় কম্পন তৈরি করে। ফলে পরমাণুর ইলেকট্রন শক্তি সঞ্চয় করে পরমাণু থেকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু কম্পনের দিক পরিবর্তিত হলে ইলেকট্রন আবার পরমাণুতে ফিরে আসে। এই শক্তি সঞ্চয় করে চলে যাওয়া এবং সেটা বর্জন করে ফিরে আসার সময় কিছু নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো তৈরি হয়। এই আলোগুলি একে অপরের সাথে ওভারটোন করে অতিবেগুনী আলো তৈরি করে। অতিবেগুনী আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য দৃশ্যমান আলোর চাইতে কম। তাঁর এই গবেষণাই অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের আলো তৈরির রাস্তা খুলে দেয়। তাঁকে এই অ্যাটোসেকেন্ড ফিজিক্সের দিকপালও বলা যায়।
এর পর পিয়ের আগোস্তিনি ও তাঁর গবেষণা দল ফ্রান্সে একটি পরীক্ষা চালান। একটা বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করে তারা ওভারটোন করা আলোকে একটু সময় পর মূল আলোর সাথে মিলিয়ে দেন। এভাবে পাওয়া স্পন্দনগুলোকে একটা ট্রেনের সাথে তুলনা করা যায়। তারা খেয়াল করলেন এই স্পন্দনগুলোর স্থায়িত্বকাল ২৫০ অ্যাটোসেকেন্ড।
অন্যদিকে ফেরেন্স ক্রাউজ ও তাঁর দল আরো সূক্ষ্মভাবে এই স্পন্দন নির্ণয় করতে সক্ষম হন। পিয়ের আগোস্তিনি যদি একটা ট্রেনের জন্যে বের করেন তাহলে ফেরেন্স ক্রাউজ বের করেছেন ট্রেনের বগির জন্যে। এক্ষেত্রে ক্রাউজ যে মান পান তা হলো ৬৫০ অ্যাাট্টোসেকেন্ড। ক্রাউজ শুধু মানই বের করেননি, কি করে এই আলো ব্যবহার করা যায় সেই উপায়ও বাতলে দিয়েছেন। এই তিন বিজ্ঞানীর আবিষ্কার অ্যাটোসেকেন্ড পদার্থবিজ্ঞান নামের এক নতুন শাখার জন্ম দিয়েছে। এই অ্যাটোসেকেন্ড স্পন্দনের আলো পরমাণুর অনেক গভীরের রহস্য জানতে সাহায্য করবে। এভাবে তাঁরা কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানকে আরো একধাপ সামনে নিয়ে গেলেন। পাশাপাশি চিপ গবেষণাসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানেও অবদান রাখবে তাঁদের আবিষ্কার।
তথ্যসূত্র-
Attosecond spectroscopy wins 2023’s Nobel Prize in Physics – Big Think
Press release: The Nobel Prize in Physics 2023 – NobelPrize.org
Leave a Reply