এই সুবিশাল মহাবিশ্বে আমরা একা কিনা এটা বহু পুরোনো প্রশ্ন। এর সদুত্তর এখনো আমরা পাইনি। প্রাণের সন্ধান জানতে আগে জানা প্রয়োজন আমাদের সৌরজগতের বাইরে পৃথিবীর মতো গ্রহ আছে কিনা। শতবছর ধরেই দার্শনিক, বিজ্ঞানীরা এটা জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে তা আর জানা হয়ে উঠেনি। ইতালির বিখ্যাত দার্শনিক এবং সৃষ্টিতত্ত্ববিদ জিওনার্দো ব্রুনো ষোলো শতকেই সৌরজগতের বাইরেও প্রাণ থাকার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে বহির্গ্রহ খুঁজে পাওয়ার বিভিন্ন দাবি আসতে থাকে। অনেক সায়েন্স ফিকশন বই, সিনেমাতেও পৃথিবীর মতো গ্রহের গল্প উঠে আসতে থাকে। কিন্তু বাস্তবে বহির্গ্রহের সন্ধান পাওয়াই যাচ্ছিল না। বলা চলে একেবারে সাম্প্রতিক সময়ে, ১৯৯২ সালে আমরা প্রথম বহির্গ্রহ দেখতে পাই। তারপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক গ্রহ বের হয়ে আসতে থাকে। এখনও পর্যন্ত পাঁচ হাজারের বেশি বহির্গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে।
এসব গ্রহ শয়ে শয়ে ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে কাছের গ্রহ প্রক্সিমা সেন্টুরাই প্রায় চল্লিশ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। আপনি যদি আলোর বেগেও ভ্রমণ করেন তাহলে সেখানে পৌঁছাতে লক্ষ বছর পার হয়ে যাবে ৷ প্রশ্ন হল, বিজ্ঞানীরা এতদূরের গ্রহের সন্ধান পান কি করে?
সরাসরি ছবি তোলা
প্রথমে গ্রহ খোঁজার যে পদ্ধতিটার কথা আপনার মাথায় আসবে তা হলো সরাসরি ছবি তোলা। আমাদের সৌরজগতের গ্রহ বৃহস্পতি, শনির ছবি এভাবেই তোলা। সৌরজগতের বাইরে ছবি এভাবে তোলার ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। একে তো গ্রহগুলো কয়েক ট্রিলিয়ন দূরে অবস্থিত। তার উপরে গ্রহগুলো যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে তার উজ্জ্বলতা গ্রহের তুলনায় বিলিয়ন গুণ বেশি। এই উজ্জ্বলতার সমুদ্রে গ্রহের নিভুনিভু জ্যোতি খুঁজে বের করা কষ্ট সাধ্য। অনেকটা তীব্র আলোকিত ঘরে জোনাকির আলো খোঁজার মতো। তবে হতাশ হওয়ার কারণ নেই। এই সমস্যা সমাধানে সানগ্লাস নীতির সাহায্য নিতে পারি। রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে আমরা সানগ্লাস পড়লে চারপাশ করে ভালো দেখতে পারি। সানগ্লাস কি করে? রোদের উজ্জ্বলতাকে কমিয়ে দেয়। তেমনিভাবে গ্রহকে দেখার জন্য এমন যন্ত্রপাতি দরকার যা নক্ষত্রের উজ্জ্বলতাকে কমিয়ে দিবে । এতে করে আমরা নক্ষত্রের আশেপাশের বস্তুকে ভালো করে দেখতে পারবো।
এই কাজটা করতে পারে এমন একটি যন্ত্র হলো হলো স্টারশেড। চিত্রের মতো দেখতে এই যন্ত্রটি টেলিস্কোপে আলো প্রবেশের পথ বন্ধ করে দেয়। এটা আলাদাভাবে একটি মহাকাশযানে করে পাঠানো হয়। টেলিস্কোপের সামনে নির্দিষ্ট কোণ করে এমন দূরত্বে বসানো হয় যাতে নক্ষত্র থেকে আসা আলো আটকে দিতে পারে।
এছাড়া ক্রোনোগ্রাফি নামক আরও একটি পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। এই নীতিতে তৈরি যন্ত্রটি টেলিস্কোপে লাগানো থাকে। এটি টেলিস্কোপের ডিটেক্টরে নক্ষত্রের আলোর প্রবেশের পথ রুখে দেয়।
সরাসরি ছবি তোলার পদ্ধতি এখনও শুরুর পর্যায়ে আছে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে এখনও পর্যন্ত ৬৯ টি গ্রহের সন্ধান মিলেছে। তবে এখনও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের অনেকটা বাকি। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি বহির্গ্রহ খোঁজার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ টুল হবে।
ট্রানজিট মেথড
মনে করুন আপনি আলোর উৎস থেকে কিছু দূরে আছেন। হঠাৎ করে এর সামনে দিয়ে কোনো কিছু চলে গেলে, আপনি কি বুঝতে পারবেন কি গেলো? পারার কথা কারণ বস্তুর আকার আকৃতি অনুসারে আলোর সামান্য বা বেশি তারতম্য দেখা যাবে। সূর্যগ্রহণের উদাহরণ দিলে হয়ত বিষয়টা আরও ভালো বোঝা যাবে। সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদ সূর্য আর পৃথিবীর মাঝখানে চলে আসে। এতে করে সূর্যের সবটুকু আলো পৃথিবীতে পৌঁছতে পারে না। ফলে কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীর উপর চাঁদের ছায়া নেমে আসে।
বহির্গ্রহ খোঁজার সময়ও এইরকম পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এটাকে বলে ট্রানজিট মেথড বা অতিক্রমণ পদ্ধতি। যখন গ্রহ নক্ষত্রের সরাসরি সামনে চলে আসে তখন কিছু সময়ের জন্য উজ্জ্বলতা কিছুটা কমে যায়। উজ্জ্বলতার এই সামান্য পরিবর্তন থেকেই গ্রহের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যায়। এই পরিবর্তন কতটুকু হচ্ছে তা থেকে গ্রহের আকার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। যদি বেশি পরিমাণ আলোকে বাঁধা দেয় তার মানে হচ্ছে গ্রহটি আকৃতিতে বড়। আবার কতটুকু সময় ধরে হচ্ছে তা থেকে গ্রহের দূরত্ব সম্পর্কে জানা যায়। আতিক্রমনের সময়কাল যত বেশি গ্রহটি ততদূরে অবস্থিত।
এভাবে গ্রহ খোঁজার পাশাপাশি গ্রহের আবহাওয়া সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। নক্ষত্র থেকে আলো আসার সময় কিছু কিছু আলো গ্রহের বাতাস ভেদ করে আসে। বিজ্ঞানীরা এই আলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে গ্রহের তাপমাত্রা, আবহাওয়া, গ্রহের গঠন উপাদান সম্পর্কে জানতে পারেন।
বহির্গ্রহ খোঁজার ক্ষেত্রে ট্রানজিট মেথড হলো সবচেয়ে সফল পদ্ধতি । চার হাজারের বেশি গ্রহের সন্ধান মেলেছে এই পদ্ধতিতে। ২০০৯ সালে উদ্বোধন হওয়া নাসার কেপলার টেলিস্কোপ এই পদ্ধতিতে গ্রহ অনুসন্ধান করত। এই প্রজেক্টের প্রথম ছয় সপ্তাহের মধ্যেই পাঁচটি গ্রহের সন্ধান মিলেছিল। ২০১৩ সাল পর্যন্ত কেপলার আমাদেরকে হাজারখানেক গ্রহের তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য বহির্গ্রহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে বিস্তৃত করেছে।
ডপলার শিফট
গ্রহ নক্ষত্র কেন্দ্রকে ঘুরে। গ্রহ এবং নক্ষত্র উভয়ের উপরেই কিন্তু মহাকর্ষ বল কাজ করে। নক্ষত্র যে একদমই স্থির হয়ে আছে তা কিন্তু না। নক্ষত্রও নিজ কক্ষপথে ঘুরছে। গ্রহের মধ্যাকর্ষণ শক্তি নক্ষত্রের তুলনায় অতি নগণ্য। কিন্তু একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। গ্রহের মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবে নক্ষত্র নিজের কক্ষপথ থেকে সমান্য কিছুটা সরে যায়। গ্রহ আকারে বড় হলে এর মধ্যাকর্ষণের জোরও বেশি হয়।
নক্ষত্রের নিজ কক্ষপথ থেকে বিচ্যুতি হয় অতি সামান্য। আমরা কীভাবে এই ক্ষুদ্র বিচ্যুতি নির্ণয় বের করতে পারি? উত্তর হচ্ছে ডপলার শিফট। মনে করুন আপনি রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন। ট্রেন যখন আপনার দিকে এগিয়ে আসছে তখন কিন্তু শব্দের তীক্ষ্ণতা ধীরে ধীরে তীব্র হবে। আবার যখন ট্রেন দূরে চলে যেতে লাগবে শব্দের তীক্ষ্ণতাও কমতে থাকবে ৷ বিষয়টাকে যদি তরঙ্গ আকারে প্রকাশ করা হয় তাহলে প্রথম ক্ষেত্রে তরঙ্গটি চেপে যাবে আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তরঙ্গ বিস্তৃত হবে। শব্দ, তাপ, আলো সবকিছু তরঙ্গ আকারে চলে। তাহলে আলোর ক্ষেত্রেও ডপলার শিফট খাটবে। মহাকাশে যখন কোনো বস্তু আমাদের দিকে আসতে থাকে তখন তরঙ্গ সংকুচিত হয়, কম্পাঙ্ক বৃদ্ধি পায়। দৃশ্যমান আলোর যে স্পেকট্রাম
তাতে সবচেয়ে বেশি কম্পাঙ্ক নীল রঙের আর সবচেয়ে কম লাল রঙের। কম্পাঙ্ক বাড়তে থাকলে নীল রঙের দেখা মিলতে থাকে। এটাকে বলা হয় ব্লু শিফট। তেমনিভাবে কোনো নক্ষত্র বা মহাকাশের অন্যকোনো বস্তু দূরে সরে যেতে থাকলে, তরঙ্গ বিস্তৃত হয়, কম্পাঙ্ক কমে যায়, ধীরে ধীরে লাল
রঙের দেখা মেলে। এটাকে বলে রেড শিফট। এই ডপলার শিফট মহাজাগতিক স্পিডোমিটারের মতো কাজ করে। যদি আমরা মহাকাশে কোনো বস্তুর রেড শিফট দেখতে পাই, তার মানে বস্তুটি আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর যদি ব্লু শিফট দেখতে পাই, তাহলে বুঝতে হবে বস্তুটি আমাদের দিকে আসছে।
এই ডপলার শিফট দেখে গ্রহের অনুসন্ধান হয় কি করে? যেহেতু গ্রহ নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘুরছে তাই ডপলার শিফট এলোমেলো না বরং পর্যায়ক্রমিক হবে। নক্ষত্র দূরে গেলে রেড শিফট আবার কাছে আসলে ব্লু শিফট এভাবে চলতে থাকবে। এখন এই পর্যায়ক্রমের বিশ্লেষণ করলেই গ্রহের পর্যায়কাল, ভর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
এই পদ্ধতিকে বলে কৌণিক বেগ পদ্ধতি। সর্বপ্রথম বহির্গ্রহ আবিষ্কার করা হয় এই পদ্ধতিতেই। গ্রহ খোঁজার অন্যতম জনপ্রিয় একটা পদ্ধতি এটি। এখনো অবধি এই পদ্ধতিতে হাজারের খানেক গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। পৃথিবী জুড়ে বহু টেলিস্কোপে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেই গ্রহের খোঁজ চালানো হয়। তবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেক টেলিস্কোপ আর চিলিতে অবস্থিত লা শিলা মানমন্দির থেকে।
অ্যাস্ট্রোমেট্রি
গ্রহ অনুসন্ধানের আরেকটি পদ্ধতি হলো অ্যাস্ট্রোমেট্রি। এক্ষেত্রে নক্ষত্রের বিচ্যুতি হওয়ার মূল ধারণা কৌণিক বেগ পদ্ধতির মতই হবে। কিন্তু নক্ষত্রের নিজ কক্ষপথের উপর নড়াচড়া ডপলার শিফট দিয়ে বের করা হয় না। এটা করা হয় বিশেষ টেলিস্কোপ এবং যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। নিদিষ্ট নক্ষত্রকে সপ্তাহ, মাস, বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়, ছবি তোলা হয় এবং অন্য নক্ষত্রের সাপেক্ষে নক্ষত্রের নির্ভুল অবস্থান নির্ণয় করা হয়। দীর্ঘসময় ধরে নেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই নক্ষত্রের গতিপথের বিন্যাস বের করা হয়। তথ্য বিশ্লেষণ করে নক্ষত্রের নিজ কক্ষপথ থেকে কতটুকু বিচ্যুতি ঘটেছে এবং তার ব্যাপ্তি কত সময় ছিল হয়েছে তা দেখা হয়। এর মাধ্যমেই একে কেন্দ্র করে ঘূর্ণায়মান গ্রহের উপস্থিতি সম্পর্কে জানা যায় ৷ এই পদ্ধতিতে খুব নিখুঁত পরিমাপের দরকার পড়ে। পৃথিবীতে বসে এত নিখুঁত মাপজোখ করাটা কঠিন ব্যাপার। তাই এই পদ্ধতিতে এতটা জনপ্রিয় না। এখন পর্যন্ত মাত্র দুইটি গ্রহের সন্ধান মিলেছে এই পদ্ধতির মাধ্যমে।
গ্রহ আবিষ্কারের একদম প্রাথমিক ধাপে আছি আমরা। সামনে অনেক লম্বা পথ পাড়ি দেওয়া বাকি। এসব গ্রহের উপস্থিতি সুবিশাল মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের জ্ঞানের নগণ্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়। মহাবিশ্বের কতকিছুই না জানার বাকি আছে, তা আমাদের কল্পনারও বাইরে। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আমরা বাসযোগ্য কোনো গ্রহের খোঁজ পাবো। হয়ত সেখানে থাকতে পারে প্রাণের স্পন্দনও।
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply