হিপ্পোক্যাম্পাসের সময়-ভ্রমণ: স্মৃতি ফিরে দেখা

ঘুম, যে কাজে আমরা জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় ব্যয় করি, বেঁচে থাকার জন্য তার অতীবগুরুত্ব ভূমিকা থাকতেই হবে। না হয় সে কাজ বিবর্তনের দৃষ্টিকোণ থেকে বোধগম্য না। 

ঘুমের অনেকগুলো জরুরী কাজের মধ্যে সম্ভবত অন্যতম প্রধান হলো স্মৃতি সংহতিসাধন (Memory consolidation)। নিউরোসায়েন্সের ভাষায় মেমরি কনসলিডেশন বলতে বোঝায় নতুন গঠিত হওয়া স্মৃতিকে দৃঢ়করণ, স্থিতিশীলতা বাড়ানো, ও স্বল্পমেয়াদী স্মৃতি থেকে দীর্ঘমেয়াদী স্মৃতিতে স্থানান্তর।

মস্তিস্কে স্মৃতির সংহতিসাধন ঠিক কিভাবে হয়?

এ প্রক্রিয়াটি বোঝার জন্য মস্তিষ্কে দুইটি প্রধান খেলোয়ারের সাথে আমাদের পরিচিত হতে হবে। একটি হলো কর্টেক্স, যা মস্তিষ্কের প্রধান কার্যনির্বাহী কেন্দ্র। কর্টেক্সে আমাদের যাবতীয় চিন্তা ঘটে থাকে, এটি স্মৃতি ও ভাষার জায়গা। কর্টেক্সকে চিন্তা করা যায় একটা গুদামঘর, অথবা একটা বিরাট লাইব্রেরির সাথে। দ্বিতীয় খেলোয়ার হলো মস্তিষ্কের গভীরে থাকা হিপ্পোক্যাম্পাস, যার সাথে আমরা আগেই পরিচিত হয়েছি। হিপ্পোক্যাম্পাস কর্টেক্সের সাথে গভীর সম্পর্কে সংযুক্ত। কর্টেক্স যদি লাইব্রেরি হয়, তাহলে হিপ্পোক্যাম্পাস হলো লাইব্রেরিয়ান। লাইব্রেরিতে নতুন কোন বই যুক্ত করতে হলে লাইব্রেরিয়ান যেমন সিদ্ধান্ত নেন যে বইটা কোথায় যাবে, দরকার হলে তাকে থাকা বইগুলো পুনর্বিন্যাস করেন, তেমনি হিপ্পোক্যাম্পাস নতুন স্মৃতিকে সংরক্ষণের জন্য কাজ করে থাকে। হিপ্পোক্যাম্পাস ও কর্টেক্সের মধ্যকার এই দ্বিমুখী যোগাযোগ তাই গবেষকদের মধ্যে বিশেষ আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।

আমরা যখন ঘুমাই, মস্তিষ্ক তখন কিন্তু বন্ধ হয়ে যায় না। ঘুমের মধ্যে দেহ বিশ্রাম নিলেও মস্তিস্কের স্নায়ুসমূহ তড়িৎ-রাসায়নিক সংকেত লেনদেন করতেই থাকে। তবে মস্তিষ্ক জেগে থাকার সময় যেভাবে সক্রিয় থাকে, ঘুমের সময়ে এ সক্রিয়তার ধরণ বদলে যায়। এই সময় ঠিক কি ঘটে তা বোঝার জন্য চলুন আগে দেখি দিনের বেলা জাগ্রত অবস্থায় ঠিক কি ঘটে। 

ধরা যাক, ল্যাবে একটি ইঁদুর দিনের বেলা কোন খাঁচার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তখন এর কর্টেক্স থেকে হিপ্পোক্যাম্পাসে বিভিন্ন সংকেত আসছে ক্রমাগত। এসব সংকেতের মধ্যে রয়েছে ইঁদুরটির দৃষ্টি, ঘ্রাণ, চার-পায়ের স্পর্শানুভূতিসহ বিভিন্ন ইন্দ্রিয় থেকে আসা তথ্য। এসব ইন্দ্রিয় থেকে আসা সংকেতের ভিত্তিতে ইঁদুরটির মস্তিষ্ক বিভিন্ন গণনা সম্পন্ন করছে, যা কি না এর চারপাশের স্থানে ঠিকমতো ঘুরে বেড়ানোর জন্য অতীব দরকারী। এসব ইন্দ্রিয় থেকে আসা তথ্যের ভিত্তিতে ইঁদুরটির হিপ্পোক্যাম্পাস মূলত একটা মানসিক ম্যাপ তৈরি করছে (স্থান-কোষের ভিত্তিতে কিভাবে এই মানসিক ম্যাপটি তৈরি হয় তা জানার জন্য আগের লেখাটি পড়ুন)।

দিনের বেলা ইঁদুরটি যে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, হিপ্পোক্যাম্পাসের স্থান-কোষগুলোও অনুরূপ অনুক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠছে। এখন চলুন দেখা যাক রাত্রে কি হয়। রাত্রে কর্টেক্স আর হিপ্পোক্যাম্পাসের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের দিকটা যায় উল্টে, তখন হিপ্পোক্যাম্পাস থেকে কর্টেক্সের দিকে বেশিরভাগ তথ্য প্রবাহিত হয় । হিপ্পোক্যাম্পাস রাত্রে প্রধান-প্রাপক থেকে প্রধান-প্রেরক হয়ে উঠে। তবে কর্টেক্সে তথ্যপ্রেরণ প্রক্রিয়াটা টানা ক্রমাগত হয় না। বরং হিপ্পোক্যাম্পাস ছোট ছোট প্যাকেজে তথ্যগুলো পাঠায়। ইলেকট্রোড দিয়ে রেকর্ড করলে হিপ্পোক্যাম্পাসের এই তথ্য-প্রেরণ প্যাকেজগুলোর একটা বিশেষ আকৃতি লক্ষ্য করা যাবে। আপনি ঘুমন্ত ইঁদুরের হিপ্পোক্যাম্পাসে যদি ইলেকট্রোড দিয়ে সক্রিয়তা পরিমাপ করেন, তখন এর মধ্যে একটা বিষ্ফোরক ধরনের সক্রিয়তা দেখতে পারবেন – যেন হঠাৎ করে হিপ্পোক্যাম্পাস সামগ্রিকভাবে ব্যস্ত হয়ে ওঠে, আর আস্তে আস্তে একটা তরঙ্গের মতো করে এটা কমতে থাকে। এই তরঙ্গের মধ্যে আবার একটা উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির আন্দোলনও রয়েছে, অনেকটা কোন লেকে পানির পৃষ্ঠতলে পাথর ছুড়ে মারার কারণে সৃষ্টি হওয়া ঢেউয়ের মতোই। এজন্য ঘুমন্ত অবস্থায় হিপ্পোক্যাম্পাসে তৈরি হওয়া এসব সক্রিয়তাকে বলা হয় শার্প ওয়েভ রিপল (বা তীব্র তরঙ্গ ঢেউ)। হিপ্পোক্যাম্পাসে তীব্র তরঙ্গ ঢেউ আবিষ্কৃত হওয়ার পর থেকেই বিজ্ঞানীদের মধ্যে এটা একটা আগ্রহের বিষয় ছিলো। 

শার্প ওয়েভ রিপল দেখতে যেমন

বিজ্ঞানীরা দেখলেন, ইঁদুরটিকে কোন নতুন খাঁচায় নতুন পরিবেশে নিয়ে গেলে সেদিন দিবাগত রাত্রে হিপ্পোক্যাম্পাস থেকে তীব্র তরঙ্গ ঢেউ উৎপন্নের হার বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে আরো দেখা গেল, যদি কৃত্রিমভাবে এই তীব্র তরঙ্গ ঢেউকে বাঁধাগ্রস্থ করা যায়, তাহলে ইঁদুরের শেখার হার আর কর্মদক্ষতাও কমে যায়।এ থেকে বোঝা যায় যে হিপ্পোক্যাম্পাসের এই রাত্রিকালীন “আতশবাজি” স্মৃতি সংহতিসাধনের (বা মেমরি কনসলিডেশন) জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু, এই “তীব্র তরঙ্গ ঢেউ” উৎপন্ন হওয়ার সময়ে মস্তিষ্কে আসলে কী ঘটে?

আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা এসব “স্পাইক-ঢেউ” ঠিক কি দিয়ে গঠিত সেটা বিস্তারিতভাবে দেখতে পারি। যেমন দেখা সম্ভব যে ঠিক কোন স্নায়ু, কখন স্পাইক তৈরি করছে, কার পরে কে সক্রিয় হয়ে উঠছে। স্নায়ু-স্পাইকের সুনির্দিষ্ট অনুক্রম সম্ভবত সবচেয়ে আগ্রহোদ্দীপক। আগের লেখা থেকে আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে দিনের বেলা ইঁদুর যে পথে হাঁটে, স্থান-কোষও একই অনুক্রমে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ইঁদুরেটি গোলকধাঁধায় কোন পথে গেলে পুরস্কার পাওয়া যাবে, সেটার স্মৃতিটাকে আমরা কিন্তু কোন স্থান কোষের পর কোন স্থান কোষ সক্রিয় হয়ে উঠছে, তার অনুক্রমের সাথে তুলনা করতে পারি। 

কোন স্থানে ভ্রমণের সময় হিপ্পোক্যাম্পাসের নির্দিষ্ট কিছু স্নায়ুকোষ সক্রিয় হয়ে ওঠে যাদের প্লেস সেল বা স্থান কোষ বলা হয়।

ইঁদুরটি দিনের বেলা কোন পথে হাঁটার সময় যে স্থানকোষ সক্রিয় হয়ে উঠেছে, তার সাথে ওই দিন দিবাগত রাত্রে হিপ্পোক্যাম্পাসে উৎপন্ন স্নায়ু-স্পাইকের অনুক্রম তুলনা করি, তাহলে অত্যন্ত বিস্ময়কর একটা বিষয় লক্ষ্য করা যাবে। তা হলো, রাত্রে উৎপন্ন স্নায়ু-স্পাইকের অনুক্রম আসলে দিনের বেলা স্থান-কোষের সক্রিয় হয়ে ওঠার অনুক্রমের সাথে পুরোপুরি মিলে যায়! ঘুমন্ত হিপ্পোক্যাম্পাসে “তীব্র তরঙ্গ ঢেউ” উৎপন্ন হওয়ার সময় একই স্নায়ু একই অনুক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠছে, যেগুলো দিনের বেলাতেও ওই রাস্তায় পথ খুঁজে বের করার সময় সক্রিয় হয়েছিলো! এটা রূপকার্থে ভাবা যেতে পারে রুমিন্যান্ট অর্থাৎ চার-পাকস্থলী বিশিষ্ট প্রাণীদের (যেমন গরু, মহিষ) একটু আগে খাওয়া খাবার জাবর কাটার মতো।

কিন্তু দুইটার মধ্যে পার্থক্য গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে। হিপ্পোক্যাম্পাসের স্নায়ু-সক্রিয় হওয়ার অনুক্রমটা উল্টো। অর্থাৎ, ঘুমন্ত হিপ্পোক্যাম্পাস যেন একটা গানের ট্র্যাক পেছন দিকে “রিওয়াইন্ড” বাটন দিয়ে চালাচ্ছে! আরেকটা পার্থক্য হলো, ঘুমের মধ্যে এই অনুরূপ স্নায়ু সক্রিয় হওয়ার ব্যপারটা খুব দ্রুত ঘটছে। এই প্রক্রিয়কে নাম দেয়া হয় হিপ্পোক্যাম্পাল রি-প্লে (হিপ্পোক্যাম্পাসের পুনঃচালনা) বা ফাস্ট-রিভার্স রি-প্লে (দ্রুত বিপরীত পুনঃচালনা)। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, কোন বিশেষ ঘটনার এই দ্রুত বিপরীত পুনঃচালনাই স্মৃতি তৈরি ও সংহতিসাধনের ক্ষেত্রে মূল প্রক্রিয়া।

মূল ছবি: Nature Reviews Neuroscience

এই “দ্রুত বিপরীত পুনঃচালনা” বা  “তীব্র তরঙ্গ ঢেউ” যে কেবল ঘুমন্ত অবস্থায়ই হয় এমন না। সাধারণত গভীর  (নন-রেম স্লো ওয়েভ স্লিপ দশা) ঘুমের সময় এগুলো সবচেয়ে বেশি পরিমাণে দেখা যায়। তবে দিনের বেলাতেও যখন ইঁদুর স্থির অবস্থায় আছে, তখনও এদের দেখা মেলে। যেমন ইঁদুরটি যখন গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে সফলভাবে পথ খুঁজে পুরস্কার (খাবার) খুঁজে পায়, আর বসে সেটা উপভোগ করে, তখনও কিন্তু হিপ্পোক্যাম্পাস সক্রিয় হয়ে এই রাস্তার স্থান-কোষগুলোর অনুক্রম ঝালিয়ে নেয়, সম্ভবত যাতে পরের বার এই রাস্তাটা খুঁজে পাওয়া সহজতর হয়। 

কখনো কখনো আপনি এমন কোন ঢেউ দেখবেন যা পূর্ববর্তী কোন অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। বরং ইঁদুরটির বিশ্রামরত অবস্থায় স্থান-কোষগুলো এমন অনুক্রমে সক্রিয় হয়ে উঠছে, যে রাস্তায় ইঁদুরটি ভবিষ্যতে ভ্রমণ করবে। মজার ব্যপার, এই ক্ষেত্রে ভ্রমণ করার সময়ে ইঁদুরে হিপ্পোক্যাম্পাসের স্থান-কোষগুলোর সক্রিয় হওয়ার অনুক্রম তুলনা করলে দেখা যায় যে এটা উল্টো বা বিপরীত নয়। এ পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে হিপ্পোক্যাম্পাসের এই “প্রি-প্লে” বা “ফাস্ট ফরোয়ার্ড” (প্রি-প্লে কে পূর্ব-অনুধাবন বলা যেতে পারে) দিয়ে ইঁদুর মূলতঃ নিকট ভবিষ্যতে কোন রাস্তায় ভ্রমণ করবে তার পরিকল্পনা করে।

মূল ছবি: ইউনিভার্সিটি অব মিশিগান

হিপ্পোক্যাম্পাসের এই দুই ধরণের রি-প্লে ও প্রি-প্লো মূলত একই পয়সার দুই দিক। এদের কাজও প্রায় একই রকম। হিপ্পোক্যাম্পাস ঘুমের মধ্যে “রি-প্লে” করে অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্মৃতির মণিকোঠায় যত্ন করে রেখে দেয়, অন্যদিকে জাগ্রত অবস্থায় “প্রি-প্লে” এর মাধ্যমে নিকট-ভবিষ্যতে ঘটতে পারে এমন ঘটনার বিভিন্ন সম্ভাবনা তলিয়ে দেখে। যদিও স্মৃতি কিভাবে তৈরি হয়, কিভাবে সংরক্ষিত হয়, সেটা ভালো ভাবে বুঝার এখনো অনেক বাকি, কিন্তু হিপ্পোক্যাম্পাসের এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা মস্তিষ্ক-কম্পিউটারের একটা গুরুত্বপূর্ণ লজিক সম্পর্কে ধারণা পেতে পারি।

তথ্যসূত্র:

হিপ্পোক্যাম্পাস সিরিজের লেখাগুলো মূলত আর্টেম কিরসানোভ এর ইউটিউব ডকুমেন্টারি থেকে অনুপ্রাণিত। 

Artem Kirsanov Memory Consolidation: Time Machine of the Brain

আগ্রহী পাঠকরা নিচের গবেষণাপত্রগুলো ঘাঁটতে পারেন।


আরাফাত রহমান Avatar

মন্তব্য

  1. কে. এম. শরীয়াত উল্লাহ Avatar

    সুন্দর লিখেছেন ভাই। সাথে ছবিগুলোতে বাংলা লেখা থাকায় আরো সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

    1. আরাফাত রহমান Avatar

      অনেক ধন্যবাদ! ছবি বাংলা করতে খুব বেশি সময় লাগে না আসলে।

Leave a Reply