একদম ফাঁকিবাজি নেই, এমন একটা স্বাস্থ্যবিষয়ক (বা বলা যেতে পারে জনপ্রিয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের) বই পড়লাম। শেষ জনপ্রিয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনটা পড়েছি? আম্মুর রোগের কথা মনে রেখে স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞ অরুণকুমার মিত্রের কন্যা জায়া ও জননী কেনা ও আংশিক পড়া। সংহত গদ্য, তবে রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি। অনেক কিছুই এসেছে বইটিতে, তবে আম্মুর রোগটার বিস্তারিত বিবরণ পাই নি। বইটির নতুন জীবন (পড়ুন সংস্করণ) কামনা করি। ডা. দেবাঞ্জন সেনগুপ্তের কম্পিউটার থেকে অসুখ বিসুখ (২০০৪) বইটির গদ্যও সংহত, তবে রক্ষণশীল নয়। তবে এ বইটিরও নতুন সংস্করণ দরকার হয়ে পড়েছে।
চিকিৎসক-সাহিত্যিক দেবাঞ্জন বেশ খেটেখুটে বইটি লিখেছেন। চোখ, হাত, শিরদাঁড়া, বিকিরণ, সংক্রমণ, মন, এবং অন্যান্য, ব্যায়াম, আসবাব, কর্মসংস্কৃতি—এ কয়টি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি। শিরোনাম থেকেই অনুমেয় অধ্যায়গুলো কী নিয়ে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই লেখক বিভিন্ন জর্নালে প্রকাশিত গবেষণার ফলাফল টেনেছেন; বেশ কয়েক জায়গায় গবেষণার সূত্র ও অসুস্থতার বা মৃত্যুর কেসও উল্লেখ করে দিয়েছেন। তথ্যসূত্র আছে প্রতি অধ্যায় শেষেই। ঘরে বসে যতটুকু প্রতিকার সম্ভব, তার কথা বলেছেন; তৎপরবর্তী অগ্রগামী চিকিৎসার উল্লেখও করেছেন—তবে তার আগে যথেষ্ট তথ্য-তত্ত্ব পরিবেশন করেছেন, অন্যান্য স্বাস্থ্য লেখকদের তুলনায় বেশ গভীরেই নিয়ে গেছেন পাঠককে। লেখাটা শুরু করেছি লেখক ফাঁকিবাজি করেন নি বলে—তার কারণ, লেখক কিছু দূর লিখেই ‘ডাক্তারের শরণ নিন’ এমন কথা লেখেন নি। একটা পর্যায়ে অবশ্যই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, তবে তার আগেও প্রাথমিক জ্ঞানগম্যির ব্যাপার আছে এবং সে কারণেই জনপ্রিয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের বইগুলো প্রণীত হয়।
দেখুন, অন্তত নিজের ব্যথার অঞ্চলের অঙ্গের ঠিকঠাক নামটুকু জানলে চিকিৎসককে কার্যকরভাবে নিজের অসুবিধার কথা জানানো যায়। তাছাড়া ‘মাজার এখানে ব্যথা করে’ বললে ডাক্তার বুঝে নেন ঠিকই, কিন্তু নিজের কায়ার একটা বিমূর্ত ছবিই থেকে যায় আমাদের মনে: ‘কোমরের ওউদিকে আমার বেদনা হইছিল গত বছর’ আড্ডায় গল্প করছেন আপনি—ডাক্তারকে কাপড় উঁচু করে দেখাতে লজ্জা করে নি ঠিক, তবে আড্ডার শ্রোতাবর্গের সামনে সংকোচটা না আসার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। দেবাঞ্জন আমাদেরকে সেই প্রাথমিক জীববিজ্ঞানটুকু পড়িয়েছেন। বছর চারেক পর উচ্চমাধ্যমিক জীববিজ্ঞান দ্বিতীয় পত্র কিছুটা ঝালাই করে নেওয়ার পাশপাশি নতুন কিছুও শিখলাম।
‘চোখ’, ‘হাত’ ও ‘শিরদাঁড়া’ অধ্যায়ে অঙ্গগুলোর প্রাথমিক পরিচয়ের পাশাপাশি এগুলোর রোগের বিজ্ঞান ও প্রতিকার নিয়ে যা লেখা হয়েছে, তা কম্পিউটার ব্যবহার বাদেও অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রের কমন জরুরি উপদেশ। ‘শিরদাঁড়া’ অধ্যায়ে যেমন এসেছে: শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালে কশেরুকার মধ্যের ডিস্কের (আন্তঃকশেরুকা চাকতি—ইন্টারভার্টেব্রাল ডিস্ক) ওপর এক ঝটকায় ২০০ শতাংশ চাপ বেড়ে যায়; আরামকেদারায় ধপ করে গা এলিয়ে দিলে চাপ বেড়ে যায় ৪০০ শতাংশ। দীর্ঘক্ষণ ঠায় কাজ করে গেলে পেশি এবং লিগামেন্টের ওপর চাপ পড়ে এবং লাগাতার এই চাপে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে (পৃ. ৪৬)—লেখক এতটুকু লিখলেও স্বাস্থ্যের বই বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু লেখক আরেকটু এগিয়ে নেপথ্যের চিকিৎসাবিজ্ঞানটা জানাচ্ছেন: আন্তঃকশেরুকা চাকতিগুলোই আমাদের কঠোর পরিশ্রম আর সহ্যক্ষমতার পেছনে প্রধান সহায়ক ভূমিকা রাখে; ঝাঁকি বা শককে শুষে নেয় (শক অ্যাবজর্পশন)। সেই চাকতির দুটি অংশ—নিউক্লিয়াস পালপোসাস আর অ্যানুলাস ফাইব্রোসাস। খাটনির ফলে শিরদাঁড়ায় চাপ পড়লে নিউক্লিয়াস পালপোসাসের জিলাটিন অংশের জলীয় অংশ কমতে থাকে, ঝাঁকি শুষে নেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়।
আর এদিকে অ্যানুলাস ফাইব্রোসাস—যা কি না নিউক্লিয়াস পালপোসাসকে বেড় দিয়ে রাখে—চাপে ক্ষয়ে যেতে থাকে, ফলে নিউক্লিয়াস বেরিয়ে পড়তে থাকে স্পাইনাল ক্যানালের মধ্য দিয়ে। কশেরুকার মধ্যকার ফোরামেন বা ফাঁকা জায়গাগুলো দিয়ে যে সুড়ঙ্গ চলে গেছে বা খাল তৈরি করেছে—ওটাই স্পাইনাল ক্যানাল। এই ক্যানালের দিকে রয়েছে নানান স্নায়ুতন্তু। চাপের ফলে স্নায়ুতন্তু আর তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত দেহের অংশে গোলমাল দেখা দেয়। গোলমাল আরো আছে, চাকতি ছিঁড়ে গেলে ওপরের কশেরুকা নিচের কশেরুকার দিকে চেপে বসবে। ফলে কশেরুকা থেকে কশেরুকার মধ্যপথের স্নায়ুতন্তুও ক্ষতির শিকার হবে। ‘আসবাব’ অধ্যায়ে (কাজ-স্টেশনের (ওয়ার্কস্টেশনের) আসবাবপত্রের সাথে দেহের সুরক্ষার ব্যাপারটা জরুরি বলে এই অধ্যায়) পেলাম হাত অধ্যায়ে আরো পেলাম, যত তাড়াই থাকুক, ফোনটা কাঁধ আর কানের মাঝে চেপে ধরা যাবে না। এ অভ্যাসটা রপ্ত হয়ে গেলে ঘাড়ের নাকি আর রক্ষা নেই! স্পন্ডিলাইটিস হতে পারে নাকি। তবে সুপারিশ এই, শিরদাঁড়ার পরেই মস্তিষ্ক নামে পৃথক এক অধ্যায় হওয়া দরকার। নতুন যে সংস্করণটা হতে পারে, যাতে কি না ছোটো কম্পিউটার, মানে স্মার্টফোন ঢুকতে বাধ্য—তাতে মস্তিষ্কের ওপর ডিজিটাল পর্দার প্রভাব নিয়ে আলোচনা থাকা দরকার, আলোচনা থাকবে নবতর প্রযুক্তির কম্পিউটার পর্দা নিয়েও।
‘হাত’ অধ্যায়ে মজার একটা ঘটনা পড়লাম। নিহনে, মানে জাপানের তরুণ প্রজন্ম নাকি সেলফোনে (বাটন ফোনই হবে আর কী!) বুড়ো আঙুলে এসএমএস পাঠাতে এমন অভ্যস্ত হয়ে গেছে (এটা ২০০৪ সালের বই, আজ আমরা সবাই-ই অভ্যস্ত), তারা কোনো জায়গা নির্দেশ করতে হলেও নাকি বুড়ো আঙুলে দেখাচ্ছে! (কই আমরা বাংলাদেশিরা তো দেখাই না এমন করে!) এ ঘটনার তথ্যসূত্রটা দিলে ভালো হতো। যদিও প্রতি অধ্যায়ের শেষে তথ্যসূত্র দেওয়া হয়েছে, পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্যসূত্র না দেওয়া বইটির এক কমতির দিক। তবে ক্রস-রেফারেন্স (আড়াআড়ি তথ্যনির্দেশ) কাজে লেগেছে। পরের সংস্করণে আরেক কাজের জিনিস নির্ঘণ্টও আসবে আশা করি।
এক্স-রে, ইনফ্রারেড রে (অবলোহিত রশ্মি), আল্ট্রাভায়োলেট রে (অতিবেগুনি রশ্মি) তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ থেকে পৃথক কোনো তরঙ্গ নয়; বরং প্রত্যেকটিই তড়িচ্চুম্বক তরঙ্গ, তাদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য একেক রকম। কিন্তু বইয়ে এগুলোকে আলাদা করে দেখানো হয়েছে। বিকিরণ দুই রকম আছে: তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ ও নিউট্রিনো-অ্যান্টিনিউট্রিনো বিকিরণ (যেগুলো আলোর বেগে চলে, স্থির ভর শূন্য) আর বস্তু বিকিরণ (ইলেক্ট্রন, প্রোটন, নিউট্রনের মতো যেগুলো আলোর বেগের চেয়ে কম বেগে শক্তি বয়ে নিয়ে যায়, স্থির ভর শূন্য নয়)। স্থির তড়িৎ বা আল্ট্রাসাউন্ডে ব্যবহৃত শব্দ তরঙ্গ ‘বিকিরণ’ করে না, যে দুটোকে বইয়ে বিকিরণ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। বইয়ে ক্ষতিকর মনে করা বেশি নিম্ন কম্পাঙ্ক (৩ কিলোহার্ৎস থেকে ৩০ কিলোহার্ৎস) মূলত বেতার তরঙ্গ আর অতি বেশি নিম্ন কম্পাঙ্ক (১ হার্ৎস থেকে ৩০০ হার্ৎস) পরিবর্তী বিদ্যুৎপ্রবাহের ক্ষেত্র (ফিল্ড) থেকে পাওয়া যায়। হেলথ ফিজিক্স সোসাইটি বলছে, কম্পিউটার-স্মার্টফোন থেকে আসা অন-আয়নীকরণ বিকিরণ (নন-আয়োনাইজিং রেডিয়েশন) এক্স-রের মতন আয়নীকরণ বিকিরণ নয়, তাই ক্ষতিকর নয়, গর্ভবতীদের জন্যও নয়। এদিকে আর্কাইভস অফ এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড অকুপেশনাল হেলথ জর্নালে একদল ইতালীয় বিজ্ঞানী ২০১২ সালে Exposure to Electromagnetic Fields From Laptop Use of “Laptop” Computers (কোলের ওপরে ব্যবহারে ল্যাপটপ কম্পিউটারের তড়িচ্চুম্বক ক্ষেত্রের সম্মুখীন হওয়া) গবেষণা অভিসন্দর্ভে জানাচ্ছেন, গর্ভবতী সহ সকলেরই ল্যাপটপ আর এর পাওয়ার সাপ্লাই (চার্জার) থেকে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।
বইটিতে আরো আছে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিসের কথা (দীর্ঘক্ষণ কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে পায়ের শিরায় রক্তের ডেলা বা থ্রম্বাস জমে যাওয়া, যার ফলে ২০০২ সালে দুজন এশীয়র মৃত্যুর কথা রেকর্ডে আছে), নানান রকম ব্যায়ামের কথা (যার কিছু কিছু আগেই বলা হয়েছিল সংশ্লিষ্ট অঙ্গের অধ্যায়ে), কম্পিউটার-উদ্ভূত মানসিক সমস্যার কথা আর কর্মসংস্কৃতির কথা। বইয়ে এক জায়গায় (পৃ. ১০৩) লেখা, স্পেস বার প্রান্তটি নাম্বার সারি থেকে উঁচুতে থাকা উচিত। এটা তো বরং অসুবিধাজনক। নিউ ইয়র্ক প্রেসবিটেরিয়ান লিখছে, টাইপিংয়ে কনুই সমকোণে বাঁকা থাকাটাই স্বাস্থ্যকর।
বইটির বহুল পাঠ আশা করি, তার আগে নতুন সংস্করণ হওয়া আবশ্যক।
কম্পিউটার থেকে অসুখ বিসুখ
দেবাঞ্জন সেনগুপ্ত
আনন্দ পাবলিশার্স
২০০৪
Leave a Reply