ধরা যাক, কোনো একরাতে আপনি এককাপ চা হাতে নিয়ে ছাদে গেলেন। সেখানে নিজেরই হাতে বানানো এক যন্ত্র দিয়ে হঠাৎ এমন কিছু দেখতে পেলেন যা আপনার আগে এই পৃথিবীতে কেউ দেখেনি। একটু চিন্তা করুন আপনার মনের অবস্থা। খুশিতে মাথা নষ্ট হওয়ার অবস্থা হবে তখন, তাই না? ৩০ শে নভেম্বর ১৬০৯ সাল। এই দিনে ইতালীয় গণিতবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলি ঠিক এমনই কিছু লক্ষ্য করেন যা তাঁর আগে কেউ খেয়াল করেননি। সেদিন জ্যোতির্বিজ্ঞান তথা বিজ্ঞানের এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হয়। সেই দরজা দিয়ে গ্যালিলিও যা দেখেছিলেন তার ধারা আজও বহমান।
এখন আমরা বিজ্ঞানের যে বিভিন্ন শাখা দেখতে পাচ্ছি, তা অনেকক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রাচীন বিশ্বাস আর বিশ্ব-প্রকৃতি সম্পর্কে কৌতুহল থেকে উৎসারিত। প্রাকবিজ্ঞান যুগে মানুষ পৃথিবী ও প্রকৃতির বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের বৈজ্ঞানিক কারণ না জানলেও বিভিন্নভাবে সেগুলো ব্যখ্যা করার চেষ্টা করতেন। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা বিশ্বজগত সম্পর্কে বিভিন্ন ধারণা গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে আজকের এই আধুনিক বিজ্ঞানের নানা শাখার জন্ম দিয়েছে। যেমন প্রাচীন আলকেমি চর্চার সাথে আজকের আধুনিক রসায়ন শাস্ত্রের জন্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূচনালগ্নে জড়িয়ে আছে প্রাচীন জ্যোতিষ শাস্ত্র। প্রাচীনকালের এসব চর্চার বেশিরভাগই ছিল পরীক্ষা-নিরীক্ষাবিহীন, অন্ধযুক্তি ও বিশ্বাস নির্ভর। মানুষ ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে, পর্যবেক্ষণ আর পরীক্ষা নিরীক্ষাই পারে প্রকৃতির নানা রহস্যের সমাধান করতে। কোনো অন্ধ বিশ্বাস নয়। বিজ্ঞানের এই পরিবর্তনে গ্যালিলিও এবং সাথে তার টেলিস্কোপের অবদান অনেক। ৩০ নভেম্বরে তাঁর আকাশ দেখা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাগ্য পাল্টে দেয়।
এখন যেমন আমাদের মাঝে নিউটন বা আইনস্টাইনের চিন্তা ধারার প্রভাব অনেক বেশি। তেমনই তখন অ্যারিস্টটল ছিলেন মহা প্রভাবশালী দার্শনিক। তাঁর মতবাদের বিরুদ্ধাচার করা কারোর সাধ্যি ছিল না। কেননা এতে বিরুদ্ধাচারীর প্রাণ সংশয় পড়ে যেত। মানুষের অগাধ বিশ্বাস ছিলো অ্যারিস্টটলের মতবাদের উপর। তাঁর ধারনা ছিলো আমাদের এই পৃথিবী আসলে দূষিত স্থান কারণ এখানে মানুষ সহ সব প্রানীর মৃত্যু হয়। তাই তার কাছে পৃথিবীর বাইরের সব স্থান ছিলো একদম বিশুদ্ধ। সেখানে কোনো খাদ থাকতেই পারে না। সেখানে থাকতে পারে না কোনো গর্ত, কোনো গিরিখাত। সবই একদম মসৃণ। এছাড়া ঐ সময়ের একটা বড় বিশ্বাস ছিলো সূর্য বা অন্য সব মহাকাশীয় বস্তু পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। মানুষের এসব বিশ্বাস একদম ওলটপালট হয়ে যায় গ্যালিলিওর পর্যবেক্ষণে।
গ্যালিলিওর এই পর্যবেক্ষনের পেছনে একটি মজার কাহিনী রয়েছে।
সময়টা ছিলো ১৬০৯ সাল, গ্যালিলিও তখন ছিলেন ইতালীর পাডুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক । তখনকার দিনে শিক্ষকদের বেতন ছিল খুবই সামান্য। তাই গ্যালিলিও রোজগারের অন্য রাস্তা বেছে নেন। এই রোজগারের রাস্তা খুঁজতে গিয়ে তিনি লেন্স নিয়ে চিন্তা ভাবনা শুরু করেন এবং ভাবতে থাকেন এমন এক যন্ত্রের কথা যা দূরের বস্তুকে কাছে আনতে পারবে। গ্যালিলিও একদিন ইতালির ভেনিস শহরে ঘুরতে গিয়ে দেখতে পান কিছু ব্যবসায়ী উন্নত কিছু লেন্স বিক্রি করছে যা দূরের বস্তুকে বড় করে দেখায়। কিন্তু তিনি আশ্বর্য্ হন এটা দেখে যে কিছু ছোট ছোট টেলিস্কোপ ততদিনে বিক্রি হওয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। কারণ প্রথম ছোট টেলিস্কোপ আবিষ্কার করেন ১৬০৮ সালে জার্মান-ডাচ লেন্স প্রস্তুতকারক হানস লিপাসহেই। তাই ১৬০৯ সালে গ্যালিলিওর ভেনিসে টেলিস্কোপ দেখা অস্বাভাবিক নয়।
গ্যালিলিও আর কাল বিলম্ব না করে লেগে পড়লেন আরও শক্তিশালী টেলিস্কোপ বানানোর কাজে। তাঁর বানানো টেলিস্কোপের বিবর্ধণ ক্ষমতা ছিলো প্রায় তিনগুন। আর এতে ছিলো প্ল্যানো কনভেক্স লেন্স যার ব্যাস ছিলো ১.৫ ইঞ্চি বা ৩৭ মিলিমিটার। গ্যালিলিও এটি বানানোর পরপরই তা বাজারজাত করার চিন্তা করেন। সেজন্যে তিনি টেলিস্কোপটির ক্ষমতা শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দেখানোর কথা ভাবলেন। ভাবনামত তিনি তাঁর বানানো টেলিস্কোপটি স্রবপ্রথম ডজেই অব ভেনিস কে দেখানোর সিদ্ধান্ত নেন (Doge of venice বা ডজেই অব ভেনিস হলো তখনকার দিনে ভেনিসের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। একে অনেকটা Duke পদমর্যাদার মতো বলা যায়) ।
২৫শে আগষ্ট ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও তখনকার ভেনিসের ডজেই লিওনার্দো ডোনাটো এবং তাঁর কর্মকর্তাদের ভেনিসের সবচেয়ে উঁচু ইমারত ক্যাম্পেনাইল ইন ভেনিসে তাঁর টেলিস্কোপ প্রদর্শন করেন। প্রথম টেলিস্কোপের বিবর্ধন ৩ গুন হলেও, এবারেরটার বিবর্ধন ছিল ৮ গুন। ভেনিসের কর্মকর্তারা এই টেলিস্কোপের সামরিক গুরুত্ব বুঝতে পারেন। তাই তারা এটি কিনতে চান। এই ঘটনার পর গ্যালিলিওর আর্থিক অবস্থা ভালো হয়।
এতো কিছু হলেও এই টেলিস্কোপের আসল কাজ তখনো বাকি ছিলো। এই টেলিস্কোপ দিয়ে আসল ঘটনা ঘটে ৩০ শে নভেম্বর ১৬০৯ সালে। ঐদিন রাতে গ্যালিলিও তাঁর টেলিস্কোপ ক্যাথলিক চার্চ ব্যাসিলিয়া অফ সেন্ট আন্থনি এর চূড়ায় তাক করেন। তারপর তিনি তার টেলিস্কোপ একটু উপরে চাঁদের দিকে ধরেন। তারপর তিনি যা দেখতে পান তা এর আগে কেউ দেখেনি। তিনি দেখতে পান চাঁদ তেমন নয় যেমনটা তখনকার মানুষ বিশ্বাস করতো। গ্যালিলিও চাঁদের পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। তিনি লক্ষ্য করেন চাঁদের ছায়ায় এক অদ্ভূত পরিবর্তন হয়। চাঁদের টার্মিনেটর লাইন ( চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠ ও আলোকিত পৃষ্ঠের মাঝের লাইন) পরিবর্তনের সাথে সাথে তার পাশে থাকা ছোট ছোট ছায়া গুলোর আকারের পরিবর্তন হয়। এমনকি ছায়ার পরিবর্তন চাঁদের দূরের অংশেও লক্ষ্য করেন তিনি। তিনি আরো খেয়াল করেন ছায়ার এই পরিবর্তন সূর্যের আলোর কোণের পরিবর্তনের সাথে ধীরে ধীরে মোটা ও চিকন হচ্ছে। এই ঘটনা আমাদের পৃথিবীতেও ছায়ার ক্ষেত্রেও হয়। তিনি বুঝতে পারেন চাঁদ কোনো বিশুদ্ধ বা মসৃণ স্থান নয়। এতে পাহাড়, গিরিখাদ সবই আছে যার ফলে এই ছায়া উৎপন্ন হচ্ছে। তার এই পর্যবেক্ষণ সরাসরি অ্যারিস্টটলের মতবাদের বিরুদ্ধে ছিলো। এছাড়া তিনি বৃহস্পতি গ্রহের চারদিকে উপগ্রহ ঘুরতে দেখেন যা প্রমাণ করে সব মহাজাগতিক বস্তু পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে না। তাঁর এই কাজের জন্যে তাকে কঠিন মূল্যও দিতে হয়েছে যা পরে আলোচনা করা যাবে।
গ্যালিলিও তাঁর সকল পর্যবেক্ষণ “সাইডেরইয়েস নান্সিয়াসে” নামক বইয়ে প্রকাশ করেন। এখানে একটা কথা জানা থাকা দরকার গ্যালিলিওকে প্রথম মহাকাশ পর্যবেক্ষক বলা হলেও তাঁর আগে চাঁদকে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ থমাস হ্যারোট। কিন্তু হ্যারোটের পর্যবেক্ষণ প্রকাশের আগে গ্যালিলিও তাঁর বই প্রকাশ করেন। যদিও চাঁদের সবচেয়ে ভালো ম্যাপ প্রথম তৈরী করেন হ্যারোট।
গ্যালিলিওর এই বই যে সবার এতো দিনের বিশ্বাসে আঘাত আনে তা বলাই যায়। যার ফল ভালো হয়নি । এই ঘটনা এক নতুন বিজ্ঞানের জন্ম দেয় যা হলো পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানের। এই ঘটনা বিজ্ঞানে পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব বিবেচনায় আনে। খুলে দেয় মহাবিশ্বের জানালা। তাই বলাই যায় ৩০ নভেম্বর ১৬০৯ ছিলো জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভাগ্য পরিবর্তনের দিন।।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply