বিজ্ঞান পড়তে যান, কি সাহিত্য—ভূগোলের বিষয়আশয় সবখানেই বিস্তৃত। উপযুক্ত বইপত্র পেয়েছিলেন (আর ঘেঁটেছিলেন) বলেই বিভূতিভূষণ আফ্রিকা মহাদেশে পা না রেখেই চাঁদের পাহাড় লিখতে পেরেছিলেন। সে চাহিদা থেকেই ভূগোল অভিধানের খোঁজ করতে থাকি; ইংরেজিতে তো আছেই, বাংলায় কী সংস্থান বা রিসোর্স আছে, তার খোঁজ করি। পেয়ে যাই দে’জ পাবলিশিং-এর ভূগোল অভিধান। সংকলন করেছেন যোগনাথ মুখোপাধ্যায়।
আচ্ছা, দে’জের কর্ণধার কি বাঙাল? দে’জের প্রয়াসে, বইগুলোর মধ্যে দেখি বাংলাদেশি পাঠকদের মাথায় রেখে নির্মাণ করার প্রবণতা। এই যেমন এ বইটাই। বাংলাদেশের জেলাগুলোও ভুক্তির (এন্ট্রি) মধ্যে এসেছে। বেশ আরাম লাগে কোশগ্রন্থটা ব্যবহার করে তাই। অবশ্য এ-ই তো হওয়ার কথা: টার্গেট পাঠকগোষ্ঠীর সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা। অথচ অপরাপর পশ্চিমবঙ্গীয় প্রকাশনালয়গুলোর বড়ো অংশের বাংলাদেশ-উদাসীনতার কারণে এ বৈশিষ্ট্যকেই বাড়তি সুবিধা বলে মনে হচ্ছে। বইটাতে চট্টগ্রাম নিয়ে লেখা হয়েছে:
বাংলাদেশের একটি বিভাগ, একটি জেলা ও তার সদর শহর। সুপ্রাচীন জনপদ, পুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রে চট্টল, বৈষ্ণব সাহিত্যে চাটিগ্রাম নামে উল্লেখিত। দেশভাগ হওয়ার সময় চট্টগ্রাম জেলা গঠিত ছিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার মহকুমা নিয়ে। এখন কক্সবাজার একটি স্বতন্ত্র জেলা। চট্টগ্রামের পূর্ব সীমান্ত পর্বতময়, সর্বোচ্চ চন্দ্রনাথ পাহাড়, উচ্চতা ৩৪৬ মিটার/১,১৫৫ ফুট। পর্বতচূড়ায় চন্দ্রনাথ শিবের মন্দির, ৭০০ সিড়ি ভেঙে উঠতে হয়। ওঠার পথেই উষ্ণ প্রস্রবণ সীতাকুণ্ড। চট্টগ্রামের নদীগুলির মধ্যে আছে ফেনি, কর্ণফুলি, সেঙ্গু, মাতামুহারি। কর্ণফুলি নদীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম শহর দেশের প্রধান বন্দরও। বঙ্গোপসাগর থেকে চট্টগ্রাম শহর ও বন্দর কর্ণফুলি নদীর ১৬ কিমি/১০ মাইল উজানে। প্রধান শিল্প ইস্পাত, ইঞ্জিনিয়ারিং, রাসায়নিক, টেক্সটাইল। লোকসংখ্যা ১৫ লক্ষ। (পৃষ্ঠা ১০৭)
কর্ণফুলি, পদ্মা, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি বাংলাদেশের কিছু নদীও ভুক্তি হিসাবে আছে।
দুর্বলতার কথা যদি বলি, সিলেট ধরে খুঁজলে কোনো ভুক্তি পাওয়া যাবে না। কারণ সিলেটকে আদি নাম শ্রীহট্ট হিসাবে পরিচিত করানো হয়েছে। গ্রন্থটির প্রথম প্রকাশকাল ১৯৯৯-এও এ কাজ অগ্রহণযোগ্য, দ্বিতীয় সংস্করণ হয় ২০১০-এ এসে। এর পরেও পুনর্মুদ্রণ হয়েছে, আইএসবিএন পালটেছে। এ সময়ে এ বেখেয়ালকে প্রশ্রয় দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ধরা যাক, মৌসুমি বায়ু সম্পর্কে আপনি জানতে চান। বইটার ২২৯ পৃষ্ঠায় আছে:
মৌসিম একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ ঋতু। তবে সারা বছর নয়, গ্রীষ্ম ও শীত ঋতুতে আরবসাগর থেকে যে আর্দ্র বায়ু ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলিতে প্রবাহিত হয় তাকে মৌসুমি বায়ু বলে। ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিম অঞ্চলে যে মৌসুমি বায়ু বৃষ্টিপাত ঘটায় তাকে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বলে। একইভাবে বঙ্গোপসাগর থেকে যে আর্দ্র বায়ু উত্তর-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে পূর্ব ভারত, বাংলাদেশ, বর্মা থাইল্যাণ্ডে বৃষ্টিপাত ঘটায় তাকে দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ু বলে। শীতের মৌসুমি বায়ু বয় স্থলভাগে থেকে যখন সমুদ্রর তুলনায় স্থলভাগের তাপ হ্রাস পায়। স্থলভাগ থেকে বয় বলে তাতে প্রথমে জলভাগ থাকে না, কিন্তু বঙ্গোপসাগরের উপর দিয়ে বওয়ার সময় তাতে জলকণা প্রবেশ করে ও তার ফলে শীতকালে অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাডু, কেরল, শ্রীলঙ্কায় বৃষ্টিপাত হয়। মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত এলাকার সব সমভূমি পলিমাটির সৃষ্টি, তাই ওইসব স্থানে স্থানে ধান, গম, তুলা, আখ, তামাক, তৈলবীজ প্রচুর জন্মায়, পাহাড়ের ঢলে চা বাগিচা সতেজ হয়। মৌসুমি-সেবিত এলাকায় চাষ অল্প পরিশ্রমে হয় ও ফলন ভালো হয় তাই সেখানে জনবসতির ঘনত্ব বেশি। গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি গৃহপালিত পশুরও প্রাধান্য দেখা যায়। মৌসুমি এলাকায় সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয় মেঘালয় অঞ্চলে। খাসিয়া পাহাড়ে চেরাপুঞ্জি ও তার সন্নিকটবর্তী মৌসিনরাম গ্রামে বছরে গড় বৃষ্টিপাত ৫০০ ইঞ্চি। মৌসিনরাম গ্রামে কোনো কোনো বছর বৃষ্টিপাত সাতশ ইঞ্চির কাছাকাছি পৌঁছয়।
দীপংকর লাহিড়ীর সংসদ ভূ-বিজ্ঞান কোষ (২০০৬)-এর ২৬০ পৃষ্ঠায় আছে:
ঋতু অনুযায়ী ভূভাগ এবং ভূভাগের চারিপাশে জলভাগের উপর উর্ধ্বচাপ ও নিম্নচাপের ব্যতিক্রমী পরিবর্তনের ফলে উৎপন্ন সাময়িক বায়ুপ্রবাহকে মৌসুমিবায়ু বলে। আগে শুধু বায়ুপ্রবাহ, বিশেষত আরব সাগরে উৎপন্ন বায়ুপ্রবাহ, সম্বন্ধে শব্দটি ব্যবহৃত হত। কিন্তু আধুনিক প্রয়োগে মৌসুমিবায়ু বলতে সমুদ্র থেকে আসা আর্দ্র বায়ুপ্রবাহ ও তার সঙ্গে বৃষ্টি এবং বিভিন্ন ধরনের জলবায়ু বোঝায়। আবার মৌসুমিবায়ু বলতে বোঝায় ভূভাগ ও জলভাগের উত্তপ্ত এবং শীতল হওয়ার হারের তারতম্যজনিত বায়ু এবং গ্রীষ্মকালে বায়ুবলয়ের মেরুর দিকে সঞ্চার। এশিয়ার মৌসুমিবায়ু উর্ধ্ব পশ্চিমাবায়ুর উপর তিব্বতীয় মালভূমির প্রভাবে বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়, যার ফলে গ্রীষ্মকালে উর্ধ্ব পশ্চিমাবায়ুর সঞ্চারপথ তিব্বতীয় মালভূমির উত্তর দিকে বিচ্যুত হয়।
ফলে আমরা দেখলাম, আরব সাগরের আর্দ্র বায়ুকে মৌসুমি বায়ু রূপে সংজ্ঞায়িত করাটা সেকেলে। ভূ-বিজ্ঞান (আর্থ সায়েন্স) ও ভূগোল (জিয়োগ্রাফি) কোশগ্রন্থের বা রেফারেন্স বইয়ের মধ্যে তুলনা করছি না। মৌসুমি বায়ু বওয়া অঞ্চলে কী কী শস্যাদি হয়, তা ভূ-বিজ্ঞানের এখতিয়ারে পড়ে না। ভূগোল (যার বাংলা দীপংকর করেছেন ‘ভূ-সংস্থান’) মানুষের সাথে পৃথিবীর আন্তঃসম্পর্ক, অর্থনীতি প্রভৃতি বিজ্ঞানের এখতিয়ারের বাইরের প্রপঞ্চ অন্তর্ভুক্ত করে, তাই শস্যাদির বিবরণ এসেছে উপরের ভুক্তিতে। কিন্তু মূল সংজ্ঞাটায় সামঞ্জস্য থাকা চাই তো। দীপংকরের ভূ-বিজ্ঞান তাই অপেক্ষাকৃত বেশি যথার্থ ও সুসংহত। তবে এর কোনোটাই, আমি যত প্রাঞ্জলভাবে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফির এজুকেশন অংশে পড়েছি (গ্রীষ্মকালীন, শীতকালীন ও উত্তর আমেরিকা, এশীয়-অস্ট্রেলীয় মৌসুমি বায়ু—ভাগ করে সুনির্দিষ্ট করে লিখিত), তার মতো নয়।
বন্দর কী? ‘সমুদ্রতীরে অথবা সমুদ্রগামী নদীর মোহানায় বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়।’ (পৃ. ১৮৬) এর পর বন্দরের অর্থনীতি আর ভারতের বন্দর নিয়ে বলতে চলে গেছেন সংকলক। বন্দরের সংজ্ঞা নেই। শিশিরাঙ্ক কী? জিয়োস্পেশিয়াল প্রযুক্তি কী? জীববৈচিত্র্য কী? কার্বন পদছাপ (ফুটপ্রিন্ট) কী? গোলকায়ান/বিশ্বায়ন কী? নাই। দেখা যাচ্ছে, ভৌগোলিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ স্থানের ভুক্তিই বেশি, ভৌগোলিক পরিভাষার তুলনায়।
প্রতিবর্ণীকরণে অযথা ইংরেজির অনুকরণ
স্থানের নামের বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে অ-ইংরেজি (এবং অ-ভারতীয়) অঞ্চলের ক্ষেত্রেও ইংরেজির অনুকরণ হয়েছে, ফরাশি বাদে। এটি শ্রতিকটু, পড়তেও খটোমটো লাগে। তিউনিসিয়াকে টিউনিসিয়া, সাকার্তভেলো বা জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসিকে (ব-টা হালকা অনুচ্চারিত হবে) টিবলিসি, তানজানিয়াকে টানজানিয়া, বাব-আল মানদিব প্রণালিকে বার এল মান্দের উদাহরণ হিসাবে দেওয়া যায়।
সচিত্র হওয়া উচিত
আজ পর্যন্ত সচিত্র একখানা বিশ্ব অ্যাটলাস বাংলাদেশ থেকে বের হয় নি, দুঃখের বিষয়। ভারত থেকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা পশ্চিমবঙ্গকে ফোকাস করে বাংলায় একটা করেছে। ভূগোল-ভূবিজ্ঞান বিষয়টা ছবি ছাড়া অসম্পূর্ণ লাগে। অ্যাটলাসের পাশাপাশি সচিত্র ভূগোল অভিধানও তাই জরুরি।
যোগনাথ কি ভূগোলের অধ্যাপক?
যোগনাথ মুখোপাধ্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত পরিচয় বইটির কোথাও নেই। তিনি এ ছাড়া রাষ্ট্র অভিধান ও ইতিহাস অভিধান সংকলন করেছেন। আমার মতে, অভিধান সংকলনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বা ডিসিপ্লিনের অভিজ্ঞ ব্যক্তিরই অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা।
তবে এত শব্দ খরচ কেন?
নিন্দামন্দের ভাগটাই আমার লেখায় বেশি, তো প্রায়-ব্যর্থ একটি বই নিয়ে এত শব্দ খরচ কেন? শুরুতে বইটি নিয়ে ভালো লাগা জানিয়েছি। আরেকটি অনুভূতি যোগ করি। সুয়েজ খাল নিয়ে যোগনাথ লিখছেন:
…১৬০ কিমি/১০০ মাইল দীর্ঘ খালটি কাটার ফলে এশিয়া ও আফ্রিকার মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আফ্রিকা একটি বিরাট দ্বীপের রূপ নেয়।
শেষ বাক্যটা পড়ার পর দারুণ একটা উপলব্ধি হয় আমার। আচ্ছা, এশিয়া-আফ্রিকা দুই ভাই তাহলে একই ভূখণ্ডে ছিল! অযৌক্তিকভাবে মিসর এশিয়া আর আফ্রিকায় দু-ভাগ হয়ে যায়। বই পড়ার উদ্দেশ্য কেবল তথ্য হজম করা নয়; সেই তথ্যকে আত্মস্থ করা, তথ্য লাভের পর বিশ্বের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পালটে যাওয়া, কিছুটা হলেও। ভূগোল অভিধান এই ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সফল।
দ্বিতীয়ত, বাংলায় পূর্ণাঙ্গ ভূগোল অভিধান ও ভূবিজ্ঞান অভিধান জরুরি [এ ক্ষেত্রে জানিয়ে রাখি, কে আশরাফুল আলমের ভূগোল ও পরিবেশকোষ-এর বেশ কিছু ভুক্তি দীপংকর লাহিড়ীর সংসদ ভূ-বিজ্ঞান কোষ থেকে নকল করা, কঠিন বাংলায় ‘কুম্ভীলকবৃত্তি’, প্লেজিয়ারিজম]। সেটি করতে হলে একজন আমপাঠক (লেম্যান—মানে আমার পড়াশোনার বিষয় ভূবিজ্ঞান বা ভূগোল কোনোটাই নয়, তবু এ দুটি বিষয়ের কিছু কিছু জিনিস জানতে-পড়তে আমি আগ্রহী) হিসাবে কী চাই, কী চাই না—তার একটি খতিয়ান রূপে থেকে যেতে পারে এ লেখাটিকে।
ভূগোল অভিধান
যোগনাথ মুখোপাধ্যায়
দে’জ পাবলিশিং, ২০১০
Leave a Reply