আপনাকে যদি কয়েকজন পদার্থবিদ বা জ্যোতির্বিদের নাম বলতে বলা হয় তাহলে অনেক দ্রুত কয়েকজনের নাম বলতে পারবেন। কিন্তু যদি কিছু কালোবর্ণের জ্যোতির্বিদের নাম বলতে বলা হয় তাহলে হয়ত সহজে পারবেন না। কারণ কালো বর্ণের জ্যোতির্বিদ সহজে আপনার চোখে পরেনি। এই লেখায় এমনই একজনের সম্পর্কে জানবো। তাকে প্রথম প্রতিষ্ঠিত কৃষ্ণবর্ণের জ্যোতির্বিদও বলা যায়।
১৭০০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্র ছিল ইংরেজদের কলোনি। যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে তখন কেবল জাহাজ তৈরি ও নানা কারখানা গড়বার কাজ শুরু করেছে ইংরেজরা। মেরিল্যান্ডে তখন তামাকের চাষ শুরু হয়েছে। আর এসব করতে ইংরেজরা কাজে লাগাচ্ছে আফ্রিকা থেকে নিয়ে আসা কালোদাসদের।এইসময়েই ৯ নভেম্বর ১৭৩১ সালে জন্ম হয় বেঞ্জামিন বেনেকারের। তবে তাঁকে অবশ্য দাসত্বের জীবন কাটাতে হয়নি। তাঁর মা মেরি বেনেকি ছিলেন একজন মুক্তমনা কৃষ্ণাঙ্গ নারী আর পিতা রবার্ট ছিলেন নিজেকে দাসত্ব থেকে ছাড়ানো কৃষ্ণাঙ্গ। বেনেকারের বাবার বিশাল তামাক চাষের জমি ছিল। সে সেই কম সংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেদের মাঝে একজন ছিলেন যে পড়তে ও লিখতে জানতো। বেনেকারের স্কুলজীবন পড়াশোনা সম্পর্কে বেশি জানা যায়নি। তবে এটুকু ধারণা করা হয় যে, খুবই অল্প বয়সে তাঁর পড়ালেখার পাঠ চুকে গিয়েছিল।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/02/image-11.png?resize=555%2C390&ssl=1)
বিশ বছর বয়সেই বেনেকারের মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। নিজের পকেট ঘড়ির সাহায্যেই একটি কাঠের দেয়াল ঘড়ি বানিয়ে ফেলে তাক লাগিয়ে দেন সকলকে। ঘড়িটি ঠিকঠাক সময় দিতো। তখন যে ঘড়ি পাওয়া যেতো না তা নয়। তবে সেটা শুধুমাত্র অভিজাত ইংরেজ বাড়িতেই শোভা পেতো। আর অন্যরা বালি ঘড়ি ব্যবহার করতো। তাই বেনেকারের তৈরি এই ঘড়ি তাঁকে এলাকায় পরিচিত করে তোলে। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ তাকে দেখতে আসতে থাকে। কিছুদিন পরই ১৭৫৯ সালে তাঁর বাবা মারা যান। এর ফলে পুরো চাষবাস, ফার্ম ও পরিবারের দায়িত্ব বেনেকারের কাঁধে এসে পরে। তিনি তখন পুরোপুরি একজন কৃষক এবং শখের বসে নানা গবেষণা করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/02/image-9.png?resize=692%2C507&ssl=1)
তাঁর গল্প এখানে এভাবেই শেষ হয়ে যেতে পারত যদি না মেরিল্যান্ডে এলিকট (Ellicott) পরিবারের আবির্ভাব না হতো। ১৭৭২ সালে এন্ড্রু এলিকট, জন এলিকট এবং জোসেফ এলিকট পেলসিনভেনিয়া থেকে মেরিল্যান্ডে বেনেকারের তামাকের জমির কাছে একটি গ্রিস্ট মিল স্থাপন করেন। আজকের এলিকট সিটি তাঁদের নামেই । এন্ড্রু এলিকটের আত্মীয় জর্জ এলিকটের ছিল বেনেকারের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক। এলিকটরা ছিলেন আসলে অ্যাবোলিসোনিস্ট (Abolitionist)।এর মানে তাঁরা এই কালোদের দাস প্রথার বিলুপ্তি চাইতো। জর্জ এলিকট তাঁর কাছে থাকা জ্যোতির্বিজ্ঞানের বই ও যন্ত্রপাতি বেনেকারকে ব্যবহার করতে দেন। এই ছোট্ট সাহায্য বেনেকারের জীবনে পরিবর্তন এনে দেয়।
বেনেকারের বয়স যখন ৫৮ বছর, অর্থাৎ ১৭৮৯ সালে, মানে যে সালে জর্জ ওয়াশিংটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় সেই সময় বেনেকার সূর্যগ্রহণের সঠিক সিদ্ধান্ত দিতে পেরেছিলো। এই ঘটনা তাকে কিছুটা খ্যাতি এনে দেয়। ১৭৯১ সালে ইউএস সেক্রেটারি অফ স্টেট থমাস জেফারসন মেয়র এন্ড্রু এলিকটকে দেশের ফেডারেল ডিস্ট্রিক্টের জন্যে ভূমি পরিমাপ করতে বলেন। এন্ড্রু এলিকট নিজে একজন সার্ভেয়ার ছিলেন তাই তিনি নিজেই এই পরিমাপ শুরু করেন। ততোদিনে বেনেকারের সূর্যগ্রহণের ফলাফল মিলে যাওয়ায় তার দক্ষতা প্রমাণ হয়ে যায়। তাই এন্ড্রু বেনেকারকে এই ভূমি পরিমাপে নিয়োগ দেন। তারা যে শহরের সীমানা নির্ধারণ করে সীমানা পাথর বসিয়েছিলেন সেই শহর হলো ওয়াশিংটন ডিসি। বেনেকার পুরো পরিমাপে না থাকলেও অনেকটা সময় এই প্রজেক্টে ছিলেন যা একজন কালো বর্ণের হিসেবে অনেক বড় অর্জন।
![](https://i0.wp.com/bigganblog.org/wp-content/uploads/2024/02/image-10.png?resize=352%2C351&ssl=1)
এরপর বেনেকার তাঁর চাষাবাদের কাজে ফেরত আসেন। এবার তিনি পঞ্জিকা তৈরির কাজ শুরু করে দেন। অনেক আগে থেকেই তাঁর এই পঞ্জিকা তৈরির শখ ছিল। কিন্তু নানা কারণে করতে পারেননি। বেনেকার একা একা সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয়ের সময়, জোয়ার ভাটার সময়, ঋতু পরিবর্তনের সময় এমনকি ক্ষেতে কখন পোকার উপদ্রব হতে পারে তার হিসেবও করেন। তিনি তার পঞ্জিকা “Benjamin Banneker’s Pennsylvania, Delaware, Maryland and Virginia Almanack and Ephemeris, for the Year of Our Lord 1792 বা বাংলা করলে দাঁড়ায় বেঞ্জামিন বেনেকারের ১৭৯২ সালের জন্যে পেনসিলভেনিয়া, ডেলওয়্যার, মেরিল্যান্ড এবং ভার্জিনিয়ার পঞ্জিকা এবং এপিমেরিস” প্রকাশ করেন। নানা মজাদার ও গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ, এলিকটদের সাহায্য এবং যারা দাস প্রথার বিলোপ চায় তাঁদের সাহায্যে বেনেকারের পঞ্জিকা সাফল্যের মুখ দেখে। বিখ্যাত আমেরিকান জ্যোতির্বিদ ডেভিড রিটেন হাউজ তার পঞ্জিকার গণনা নিশ্চিত করে দেন।
বেনেকার তাঁর কাজের ১৪০০ পাতার পাণ্ডুলিপি তখনকার সেক্রেটারি থমাস জেফারসনকে পাঠান আর চিঠিতে লেখেন, “পৃথিবীর প্রায় সবাই আমার মতো দেখতে মানুষদের খারাপ ও অপারক দৃষ্টিতে দেখে’’।
জেফারসনের উত্তর ছিল, ‘’কালোদের সম্ভাবনাকে অগ্রাহ্যকারীদের জন্যে বেনেকারের এই পাণ্ডুলিপি একটি প্রমাণস্বরূপ। এই পাণ্ডুলিপি কালোদের নিয়ে করা নানা অনিশ্চয়ার বিরুদ্ধে আরেকবার ভাবতে বাধ্য করবে। ‘’
বেনেকারের এই পাণ্ডুলিপি ১৭৯৭ সাল পর্যন্ত চলে। তাঁর এই কাজ কালোদের মাঝে এক আশার আলোর মতো কাজ করে। আর তারা বিশ্বাস করতে থাকে তাদের দাঁড়াও সম্ভব। এই কাজ সাহায্য করে সেই সকল মানুষদের যারা এই দাস প্রথা বিলুপ্তে কাজ করছিলেন। তার এই পঞ্জিকা প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায় যে কালোরাও বিজ্ঞানে অবদান রাখতে পারে। শুধু যুক্তরাষ্ট্র না তার কাজ গ্রেট ব্রিটেনেও পৌঁছে যায়। সেখানে পার্লামেন্টের সদস্য এবং বিখ্যাত দাস বিলোপের আন্দোলনের নেতৃত্বকারী উইলিয়াম উইলবারফোর্স তাকে নিয়ে পার্লামেন্টের আলোচনা করেন।
জীবনের বাকি সময় বেনেকার চাষের জমিতে আর কেবিনে কাটিয়ে দেন। ১৯ অক্টোবর ১৮০৬ সালে বেনেকারের মৃত্যু হয়। রহস্যজনকভাবে তার কেবিনে তার শেষ কাজের দিনে আগুন লাগে যায়। যাতে তার বেশির ভাগ কাজ জ্বলে যায়। কিন্তু বেনেকার যে নতুন এক আসর আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন তা কিন্তু জ্বলেনি। বেনেকার সবাইকে এটা বুঝাতে সক্ষম হন যে কালো বা সাদা সবাই বিজ্ঞানে অবদান রাখতে পারে।
তথ্যসূত্র-
Leave a Reply